মাঘী পূর্ণিমা



Updated: 24 February, 2024 4:22 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

ভারতীয় ক্যালেন্ডারের প্রত্যেক মাসেই অন্তত একটি করে পূর্ণিমা আসে। পূর্ণিমার দিনটি সনাতন সংস্কৃতিতে পবিত্র বলে মানা হয়। পূর্ণিমা গুলির মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল বৈশাখী পূর্ণিমা, আষাঢ় পূর্ণিমা বা গুরু পূর্ণিমা, শ্রাবণ পূর্ণিমা বা রাখী পূর্ণিমা, কার্তিক পূর্ণিমা বা শরত পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা এবং ফাল্গুন পূর্ণিমা বা দোল পূর্ণিমা। মাঘী পূর্ণিমা বা মাঘ পূর্ণিমা হলো মঘানক্ষত্রাযুক্ত মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথি ।এই দিনে চন্দ্র, বৃহস্পতি এবং শনি তিনটি গ্রহই অশ্লেষা নক্ষত্রে তাদের নিজস্ব রাশিতে উপস্থিত থাকে। এই দিনটি সনাতন হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসবের দিন।

সনাতন ধর্ম অনুযায়ী এই তিথিতে দেবতারা মর্ত্যলোকে ভ্রমণ করতে আসেন। এই তিথিতে কোনো তীর্থ বা গঙ্গা স্নান ও দান করলে ভগবান প্রসন্ন হন। তাই এই তিথিতে মন্দির দর্শন ও গঙ্গা স্নান করার প্রচলন আছে । আমরা জানি যে ভারতের চারটি নগরে ( হরিদ্বার, প্রয়াগরাজ , নাসিক ও উজ্জ্বয়ীনি) পূর্ণ কুম্ভ আয়োজিত হয় । পুর্ণ কুম্ভমেলা প্রতি বারো বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয় এবং মাঘী পূর্ণিমার সময় মাঘ মেলাটি বার্ষিক ভিত্তিতে তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে বা ত্রিবেণী সঙ্গমের চারপাশে প্রয়াগরাজের মতো নগরে অনুষ্ঠিত হয়।

গৌতম বুদ্ধের জীবনেও এই তিথির বিশেষ গুরুত্ব আছে। তিনি এই তিথিতে তাঁর পরিনির্বাণের কথা ঘোষণা করেন। কথিত আছে যে পঁয়তাল্লিশ বর্ষাবাস অর্থাৎ অন্তিম বর্ষায় তিনি রাজগৃহের বেনুবনে অধিষ্ঠান করেন। সে সময় তিনি ভীষণ রোগে আক্রান্ত হন। পরে প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর ধ্যানবলে রোগমুক্ত হন। বর্ষাব্রত শেষ করে দেশ পরিভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি ক্রমে বৈশালীর চাপালচৈত্যে উপস্থিত হন। তখন তার বয়স পূর্ণ হয় আশি বছরে। এ সময় তিনি চাপালচৈত্যে ধ্যানস্থ হয়ে ভাবলেন তার পরিনির্বাণের সময় সন্নিকটে। এই পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার দিনে তিনি আনন্দকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আনন্দ, অচিরেই তথাগত পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হবেন। এখন থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই আমি পরিনির্বাপিত হব। ‘ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ঘোষণা শুনে তার শিষ্য-প্রশিষ্যগণ সবাই ব্যথিত হন, কান্না করেন। তখন বুদ্ধ তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘অনিচ্চা বত সঙখারা, উপ্পাদা বয ধম্মিনো, উপ্পাজিত্বা- নিরুজ্জন্তি ততো উপ সম সুখো।’
অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিলয় জগতের নিয়ম। উৎপত্তি হয়ে নিরুদ্ধ হওয়া জাগতিক ধর্ম। এই মহাসত্যটি জীবন ও জগতের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মাঘী পূর্ণিমা হল বুদ্ধের পরিনির্বাণ ঘোষণার তিথি।

মাঘী পূর্ণিমা বিষয়ে আরেকটি কিংবদন্তি আছে। কথিত আছে পুরাকালে কান্তিকা নগরীতে ধনেশ্বর নামে একজন গরীব ব্রাহ্মণ বাস করতেন। ব্রাহ্মণের কোনও সন্তান ছিলনা। ব্রাহ্মণের দিন কাটছিল খুবই দুঃখে। ভিক্ষা করে কোনও রকমে দিন গুজরান হচ্ছিল। এমনই একদিন ভিক্ষায় বের হলেন ব্রাহ্মণ। সেসময় নগরীর বাইরে কোনও এক জনৈক ধনীর বাড়িতে তিনি ঢুকলেন ভিক্ষা করতে। কিন্তু সেখান থেকে ব্রাহ্মণকে খালি হাতেই ফিরতে হল কারণ নিঃসন্তান ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা দিতে চাননি বাড়ির মালিক। ব্রাহ্মণ ঘরে ফিরে কাঁদতে লাগল আর তার স্ত্রীকে সবটা খুলে বলল। সব শুনে স্ত্রী রূপবতী উপায় খুঁজতে লাগল। তখনই জনৈক একজন এসে বলল তোমরা মা কালীর পুজো কর এবং চন্দ্রিকা দেবীর আরাধনা কর, এতে তোমরা সন্তান লাভ করতে পারবে। তাই শুনে ব্রাহ্মণ মাঘী পূর্নিমার এই পুজো করে এবং ব্রাহ্মন দম্পতির সন্তান লাভ হয়।

এই তিথির আরেকটি বিশেষত্ব হল এটি সন্ত রবিদাস বা রাইদাসের আবির্ভাব তিথি। তিনি ছিলেন একজন কবি ও সাধক এবং বৈষ্ণবীয় পরম্পরার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম রূপকার। ১৪৫০ সালে মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর কাছে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৫২০ সালে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। তাঁর বহু শ্লোক শিখ ধর্ম গ্রন্থ আদি গ্রন্থ সাহেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই শিখ পন্থীরাও এই বৈষ্ণবীয় সাধককে স্মরণ করেন। শিখ পন্থা যে হিন্দু সংস্কৃতির থেকে পৃথক নয় এই ঘটনা তার একটি প্রমাণ।

অর্থাৎ সব দিক বিবেচনা করে দেখা যায় মাঘী পূর্ণিমা ভারতীয় সংস্কৃতিতে এক পবিত্র দিন। তাই প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এই আধুনিক কালেও এই দেশে মাঘী পূর্ণিমা পালিত হয়। তবে এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় হল পূর্ণিমা ও অমাবস্যার গণনা । সনাতন শাস্ত্রকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয় – শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্র। এই শ্রুতি শাস্ত্রের অন্যতম বিষয় হল বেদাঙ্গ । বেদাঙ্গের সংখ্যা হল ছয়টি যথা শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ , নিরুক্ত, কল্প ও জ্যোতিষ । এর মধ্যে জ্যোতিষ নামক বেদাঙ্গে এই সকল মহাজাগতিক গণনাগুলি উল্লিখিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনার হাজার হাজার বছর পূর্বেই ভারতীয় ঋষিগণ ( সেকালে বিজ্ঞানীদের ঋষি বলা হত) গণনা করে নির্ধারণ করেছিলেন পূর্ণিমা বা অমাবস্যা কবে কখন হবে এবং সূর্য কখন কোন রাশিতে থাকবে। আরবী বা ইউরোপীয়রা ভারতের মাটিতে পা দেবার বহু পূর্ব থেকেই এই পঞ্চাঙ্গ ভারতে প্রচলিত ছিল। সনাতন ধর্মের সকল উৎসব ও সেই তিথি – নক্ষত্র ধরেই পালিত হয়ে আসছে অনাদি কাল ধরে। সবই জ্যোতিষ শাস্ত্রের কল্যাণে। এই তথ্য প্রমাণ করে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনতা এবং সমৃদ্ধি।