বিশ্ব তিব্বত দিবস: চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ



Updated: 05 July, 2024 4:52 pm IST

© অরুণ আনন্দ

৬ই জুলাই, এই বিশেষ দিনে তিব্বতী গুরু ও নেতা, বিশ্বমানবতার মহান ব্যক্তিত্ব দলাই লামার জন্মদিন। ১৯৯৮ সাল থেকে সারা পৃথিবীর তিব্বতী নাগরিক এই দিনটি বিশ্ব তিব্বত দিবস হিসেবে পালন করে, ধর্মগুরু ও রাজনৈতিক নেতা ১৪তম দলাই লামার সম্মানে। এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন মাননীয় দলাই লামার ছোট ভাই তেনজিন চোগিয়াল ও পুলিৎজার পুরস্কারে সম্মানিত রিচার্ড রোসেনকার্জ। শুধুমাত্র তিব্বতী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মূল্যায়ন করা নয়, তিব্বতীরা চায়, চীন দমনপীড়নের যে প্রক্রিয়ায় তীব্বতী সংস্কৃতি ধ্বংস ও মুছে ফেলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেই বার্তা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে।

১৯৫১ সালের পরের সময় থেকে পুরো দশক জুড়ে চীন তিব্বতকে নিজের দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। যদিও চীন এই কাজ কে ব্যাখ্যা করছিল হিমালয়ের ঐ প্রান্তের জনজাগরণ বলে। চীন সরকারের কথায় সামন্ততান্ত্রিক দাসত্বের কবল থেকে জনগণের মুক্তির প্রয়াস, যা আসলে চীন সরকারের দানবিক শক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে তিব্বত দখলের ইতিহাস….ফলত দলাই লামার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ৮০০০০ তিব্বতীকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৫৯ সালে ভারতে চলে আসা। তারপর থেকে বিগত সাত দশক ধরে তিব্বতীদের প্রতিরোধ ও নিজেদের সংস্কৃতিকে চীনা প্রভাব মুক্ত করে রক্ষা করা। নির্বাসিত তিব্বতী সরকারের কথায় ২০০৯ থেকে অন্তত ১৫০টি ক্ষেত্রে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষায় আত্ম‌উৎসর্গ করতে হয়েছে। মহান দলাই লামা এখনও তিব্বতীদের কাছে অবিসংবাদি ব্যক্তিত্ব। আজ‌ও তিব্বতী বৌদ্ধদের কাছে তিনি সর্বোচ্চ নেতা। তারা বিশ্বাস করে তিনি দয়া ও বোধিসত্ত্বের উপমা।

১৪তম দলাই লামা, তেনজিন গিয়াৎসো, তিব্বতী সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গেলুগ অংশের প্রতিনিধি। তাই শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে তিনি সারা পৃথিবীর তিব্বতী সমাজে অতুলনীয় নেতা বলে সম্মান পান তা নয়, ভারতে চলে আসার পর থেকে তিনি নিজেকে তিব্বতী প্রতিরোধের প্রধান মুখ ও যোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সম্মান লাভ করেছেন। এছাড়া মানবাধিকার, শান্তি , সার্বিক দায়িত্ববোধের এক প্রধান স্তম্ভ ও বৌদ্ধদর্শনের প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ১৯৮৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। দলাই লামার তিব্বতের অধিকার বিষয়ে ন্যায্য দাবি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার আবেদনের তীব্রতা ও এই শান্তিপূর্ণ বিরামহীন প্রক্রিয়া চালানোর ফলে চীন সরকার, স্বভাবতই তার বিরুদ্ধে প্রচারে নামে। দলাই লামা চেয়েছিলেন চীনের অন্দরে তিব্বতে স্বশাসনের অধিকার। এর পরিবর্তে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নানা অপপ্রচার, কুৎসায় তাকে কলংকিত করার চেষ্টা চালায়, তাকে চীনের বিভাজনকারী ও শত্রু বলে দাগিয়ে দেয়। ১৯৯৬ সালের শুরু থেকে তিব্বতে তার ছবি ও প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মাও সেতুং-এর আমল থেকে চীন সরকার ধর্মাচরণের বিরোধী ও তারা দলাই লামার উত্তরাধিকারী খোঁজার পদ্ধতিকে নিজেদের অধীনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। দলাই লামা বর্তমানে ৮৯ বছরে পড়েছেন, তাই তার উত্তরসূরি খোঁজার কাজ চলছে, যদিও তার দিব্যদর্শন ও মতানুসারে, তিনি বলছেন তার আয়ু ১০০ বছরের‌ও বেশি। প্রথাগত ভাবে এই উত্তরাধিকারীর খোঁজ তিব্বতে বা কদাচিৎ তিব্বতের বাইরে পাওয়া যায়। দলাই লামার মতে তার তিরোধানের পর তিনি পুনর্জন্ম লাভ করবেন অথবা তার আগে তিনি নিজে উত্তরাধিকারীকে নির্বাচিত করবেন। এই প্রথা তিব্বতী বৌদ্ধ সমাজের বহুযুগের, এর নাম উদ্ভূত হ‌ওয়া।

অপরদিকে চীন সরকার সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, দলাই লামার নবজন্মের প্রক্রিয়া যা স্বর্ণ কলস পদ্ধতি নামে পরিচিত । এটি চীন সরকারের‌ নির্ধারিত কমিটির মাধ্যমে হবে যে কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবে সরকারি প্রতিনিধি ও সরকার নির্বাচিত তিব্বতী সন্ন্যাসী। এর ফলে তিব্বতী সমাজে দ্বিধার উৎপত্তি হচ্ছে। দলাই লামার পরিবর্তে এর মধ্যে দুই জনের নাম উঠে এসেছে – প্রথম জন নির্বাসিত তিব্বতী সরকারের তরফ থেকে এবং অপরজন চীন সরকার দ্বারা নির্বাচিত। পুরো বিষয়টি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পর্যবেক্ষণে থাকবে। এই ঘটনায় তিব্বতী বৌদ্ধসমাজ স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত-এর ফলস্বরূপ। বর্তমান দলাই লামার অবর্তমানে দুজন দলাই লামা দেখা পাওয়া খুব অসম্ভব হবে না যার প্রথম জন নির্বাসিত তিব্বতী সরকারের ও অপরজন চীন সরকারের দ্বারা নির্বাচিত। এই কর্মসূচির আঁচ পাওয়া গেছে, যখন ১৯৯৫ সালে, একজন ৬ বছর বয়সী বালক নাম গেধান চোয়েকি নেইমাকে পানচেন লামার পদে দলাই লামা অভিষিক্ত করায়। পানচেন লামা তিব্বতী বৌদ্ধসমাজে দলাই লামার পরের স্থান। এরপরে এই বাচ্চাটিকে চীন সরকার গ্রেফতার করে, এবং তার খোঁজ আজও পাওয়া যায় নি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তার অবস্থানে অন্য জনকে বসিয়ে দেয় যার যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও সন্দেহ আছে।

এর সঙ্গে যোগ করা যায় চীন সরকারের ভূমিকা। চীন ক্রমাগত দলাই লামার আন্তর্জাতিক সম্মান খর্ব করার কাজে ব্যাপৃত। অপপ্রচার, ভুল, মিথ্যা তথ্যের জাল নানা প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই চীনের প্রচার তারা তিব্বত অধিকারের আগে সেখানে দাসত্বের আর শোষণের রাজত্ব কায়েম ছিল। দলাই লামা ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। এই মতবাদ যদিও কোনো পন্ডিত ব্যক্তিগণ মানতে পারেন নি। বর্তমানে চীন তিব্বতী বৌদ্ধদের একাংশের দোরজে সাগডেন মুর্তি পূজাকে তোল্লাই দিচ্ছে যার তীব্র বিরোধিতা করছেন দলাই লামা।

এই রীতি নীতি তিনি প্রথম থেকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুসারে এই বিপথগামী অংশকে চীন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যেমন আমেরিকা, ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়ায় অর্থ সামর্থ্য দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবাদে সামিল করছে। এরা দলাই লামার উপস্থিতির সঙ্গে-সঙ্গে, তার বিরোধিতায় স্লোগান ও প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন, তাকে ভন্ড, প্রতারক বলে আন্দোলন শুরু করছে। যদিও এই অংশ চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে ধর্মীয় স্বাধীনতার সপক্ষে প্রতিবাদে মুখর। মূল কথা দলাই লামা চীন সরকারের অপপ্রচারের প্রধান লক্ষ্য। এই বছরের শুরুতে একটি ভাইরাল হ‌ওয়া ভিডিও যা চীন সরকারের তরফ থেকে বহুল ভাবে সোস্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যেখানে দেখা যাচ্ছে দলাই লামা এক ৮ বছরের বালককে জড়িয়ে ধরে, জিভ চুষতে থাকেন। চীন সরকারের প্রচার ছিল তিনি বিকৃত মনস্ক-এর ফলে সোস্যাল মিডিয়াতে বিরাট ক্ষোভ প্রকাশ পায়, যা চীন চেয়েছিল‌। পরে জানা যায় ঐ বালক ও তার মা, পরিবার দলাই লামার আশীর্বাদ ধন্য এবং ঐ পদ্ধতি তিব্বতী সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। এইভাবে অপপ্রচার চালানো ছাড়া চীন, তিব্বতী সমাজ সংস্কৃতি পাল্টে নতুন চীনা প্রভাব যুক্ত সমাজ গঠনের কাজ শুরু করেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে চীনা ভাষা সংস্কৃতির আমদানি করতে আরম্ভ করেছে।

২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকের পরেপরে তিব্বতী গ্রামগুলো থেকে তিব্বতী জনগণকে অন্যস্থানে সরানো, প্রায় দশ লাখ তিব্বতী বাচ্ছাকে জোর করে তার বাবা মা-এর  থেকে ছিনিয়ে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করা, যাতে ভবিষ্যতে এই বাচ্চারা চীনা হান সংস্কৃতি কে গ্রহণ করে। গত বছর থেকে তিব্বতের নাম সরকারি নথিপত্রতে বাধ্যতামূলক ভাবে জিয়াং স্বয়ংসম্পূর্ণ নামে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এই সব কর্মকাণ্ডকে সাংস্কৃতিক গনহত্যা বলে অনেকেই অভিহিত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক তিব্বত দিবসের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। ৮৯ বছরের প্রবীণ মহান দলাই লামা আজ‌ও হাজার হাজার তিব্বতীর প্রধান মুখ ও তিব্বতী সংস্কৃতির প্রধান বাহক ও রক্ষক। চীন সরকারের দমবন্ধ করা কর্মসূচি সত্বেও তিব্বতীরা আজ‌ও তাদের সংস্কৃতির অনুশীলনে রত। তাই বিশ্ব তিব্বত দিবসের গুরুত্ব বিশাল। সমস্ত স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ ও শান্তিকামী জনসাধারণ এই ৭৫ বছরের অদম্য লড়াইকে সম্মান ও সমর্থন করে।