বাঙ্গালী ও বাংলাদেশীর পার্থক্য



Updated: 14 July, 2024 9:17 am IST

© স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী

গল্পটা একজন ভজহরি মান্নার। তাঁর আসল নামটা না হয় উহ্যই থাক। ইস্তানবুল বা জাপান-কাবুল না গেলেও, দেশ-বিদেশ ঘুরে ভদ্রলোক নানান জাতের রান্না ভালোই রপ্ত করেছিলেন। সেই হাতের গুণ আর কপাল জোরকে সম্বল করেই একসময় সৌদি আরবের রাজার খাস রাঁধুনী হয়ে ওঠা। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি কোনটারই অভাব ছিল না। বিপত্তি ঘটল বাংলা বলতে গিয়ে। অন্যান্য বহু দেশের মত আরব দেশগুলোতেও কায়িক শ্রমের কাজগুলোতে বাংলাদেশীদের বাড়বাড়ন্ত রয়েছে। এমনই এক বাংলাদেশী সাফাই কর্মচারীর সাথে রান্নাঘর পরিষ্কারের ফাঁকে গল্প করার সময়েই সেটা কানে যায় এক রাজকুমারের। সাথে সাথেই তলব পড়ে ভজহরি মান্নার। শুরু হয় অন্তহীন জেরা। আরব দেশগুলোর কোনটাতেই বাংলাদেশীদের খুব একটা সুনজরে দেখা হয় না। ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং আরো নানান দুষ্কর্মে জড়িত থাকার ডজন ডজন অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে। আর আরবদের কাছে বাংলা, বাঙ্গালী আর বাংলাদেশী, তিনটের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে কারও সাথে বাংলাতে কথা বলা মানেই আরবী শেখদের কাছে সন্দেহভাজন বাংলাদেশী হয়ে ওঠা। সেদিন চাকরি বাঁচাতে বারবার নিজেকে “ভারতীয়” বলে দাবি করতে হয়েছিল শ্রী মান্নাকে। বলতে হয়েছিল যে তিনি আসলে বাঙ্গালী নন। কারণ, বাংলাদেশের বাইরেও যে আরেকটা বাংলা আছে, যার নাম পশ্চিমবঙ্গ, এই বিষয়টা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খুব একটা প্রচলিত নয়। তাই এই পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা যে নামে, কামে, স্বভাবে, চরিত্রে বাংলাদেশীদের থেকে অনেকটাই আলাদা, সেসব বাইরের কাউকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। তারপর থেকে রোজ রাতে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে হত লুকিয়ে লুকিয়ে, চুপি চুপি। বাংলা কথা শেখদের কানে গেলেই তো সর্বনাশ। মাতৃভাষা নিয়ে এই চূড়ান্ত টানাপোড়েন আর মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে অবশেষে জিতে গেল বাংলা। চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন ভদ্রলোক।

ভারতের বাইরে বাংলা, বাঙ্গালী আর বাংলাদেশীর সমার্থক হয়ে ওঠার ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। ১৯৭১ এ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ে ওঠার অনেক পরের কথা। ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রসংঘে ক্রমাগত লবিং এবং কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের ফলে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। অতএব ওই দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘের “ভাষা দিবস” ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কূটনীতিক সাফল্য। এরপরে বিশাল প্রবাসী জনসংখ্যাকে হাতিয়ার করে এগোতে থাকে বাংলাদেশীদের ভাষা কূটনীতি। বিদেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে “একুশে ফেব্রুয়ারি” পালন দিয়েই সেই ধারা অব্যাহত রাখা হয়। ধীরে ধীরে যার ঢেউ এই পশ্চিমবঙ্গেও প্রবেশ করে। সৌজন্যে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গণ-মাধ্যম এবং বাঙ্গালী জাতির স্বঘোষিত অভিভাবকবৃন্দ। দিকে দিকে সাড়ম্বরে “ভাষা দিবস” পালনের ফলেই বিশ্বের অনেকাংশ জানল, শুধু বাংলাদেশের ভাষা বাংলা। বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার বাঙ্গালীরা।

ভাষা দিবসকে ঢাল করে যেটা শুরু হয়েছিল, তাকেই এগিয়ে নিয়ে চলল প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভাষা কূটনীতি। বিশ্বের সমস্ত বড় বড় সংবাদ সংস্থার যে বাংলা সংস্করণ শুরু হল, তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে গেল বাংলাদেশীদের হাতে। সেখানে সাংবাদিক থেকে সম্পাদক, পরিচালক থেকে কলা-কৌশলী, সকলেই বাংলাদেশী। ভারতের বাঙ্গালীদের প্রবেশ সেখানে প্রায় নিষেধ। একই ব্যাপার ঘটল সামাজিক মাধ্যমে। গুগল, উইকিপিডিয়া, ফেসবুক ইত্যাদির বাংলা বিভাগও প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশী অধ্যুষিত। এর ফলে বাঙ্গালী যে শুধু ন্যায্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাই নয়; গোটা বিশ্ব বাংলাদেশী বাংলাকেই বাংলা বলে শিখছে। কারণ, গুগলের স্বয়ংক্রিয় অনুবাদে বাংলাদেশী বাংলা ভর্তি। ফলে ওয়াটার-এর বাংলা দেখাচ্ছে পানি আর গ্র্যান্ডমাদারের বাংলা দেখাচ্ছে নানী। এতেই শেষ নয়, যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বিদেশী সিনেমা, বই বা সিরিয়ালের বাংলা ডাবিং বা সাবটাইটেল করাতে চান; তারাও কেবল নিয়োগ করছেন বাংলাদেশীদের। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষা অনুবাদ করে দেবার জন্য যেসব ছোট ছোট বাণিজ্যিক সংস্থা আছে, সেখানে অনুবাদকদের চাকরি দেবার আগে ভাষার পরীক্ষা নেওয়া হয়। সে সব জায়গাতে বাংলা ভাষার পরীক্ষাও হচ্ছে বাংলাদেশী মান অনুসারে। অর্থাৎ ঠিক বাংলা জেনেও পরীক্ষাতেই হেরে যাচ্ছেন ভারতের বাঙ্গালী চাকরিপ্রার্থী ভাইবোনেরা। কারণ, বাংলাদেশী বাংলাতে অন্ততঃ ৩০% আরবী/ফার্সী শব্দ রয়েছে যেটা আদি বাংলা বা ভারতের সনাতন বাংলায় নেই।

এতেই শেষ নয়, বাংলাদেশীদের চাপে বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে চলেছে। সাহিত্য উৎসব হোক বা কবিতা উৎসব, নাট্য মেলা হোক বা সঙ্গীত সন্ধ্যা; হিড়িক পড়েছে ওপার থেকে শিল্পী আনার। যেন ওটাই এখন জাতে ওঠার ছাড়পত্র। রাজ্যের বিখ্যাত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও অবাধ বিচরণ বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের। সেই তালেই তাল মিলিয়েছে টলিউড। বাংলা রিয়েলিটি শো, সিনেমা, সিরিয়াল সর্বত্র বাংলাদেশীর ছোঁয়া। অথচ বাংলাদেশে এপারের সিনেমা প্রদর্শন প্রায় নিষিদ্ধ, প্রায়ই দাবি ওঠে ভারতের চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ করে দেবার, ওদের বইমেলাতে ভারতের বই বিক্রিতেও লাগানো হয় নানান শর্ত। তবুও নিজেদের মান-সম্মান খুইয়ে কিসের তাড়নায় এই বাংলাদেশী তোষণ? সতেরো কোটির বাজার ধরতে গিয়ে ভারতের বাঙ্গালীকে কি নিজভূমেও এভাবেই ব্রাত্য থাকতে হবে? অথচ এই প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রি তৈরী করেছে বাঙ্গালী, তার নিজের কথা বলবার জন্য। তার নিজের কর্মসংস্থানের জন্য। ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত হয়ে আসা লাখে লাখ উদ্বাস্তুর মুখের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। শরণার্থী শিবিরে তাদের জীবন, জীবিকা নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে। পরে সেই সব গল্প, উপন্যাসই সিনেমা, সিরিয়ালের রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশেরও তো নিজস্ব ঢালিউড আছে। ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তারা কি কখনো এই সব বিতাড়িত উদ্বাস্তুদের জন্য সিনেমা করার কথা ভেবেছেন? টলিউড না থাকলে কোথায় তৈরি হত ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা”? অসংখ্য প্রযোজক, পরিচালক এবং কলাকুশলীদের বহু ত্যাগ, পরিশ্রম এবং সাধনার ফসল আজকের টলিউড ইন্ডাস্ট্রি কিংবা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। আর আজ তাকেই আমরা হেলায় বিলিয়ে দিচ্ছি ভিনদেশীদের কাছে।

ভাষাগত ঐক্য দেখিয়ে বাঙ্গালীকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে দাসত্বের প্রতিজ্ঞা। যে তার নিজের ভাগ ছেড়ে দেবে অবলীলায়, বিনা প্রতিবাদে। দাসত্ববোধ যত জাগ্রত হবে, ততই তলিয়ে যাবে বাঙ্গালীর নিজস্ব স্বার্থরক্ষার চেতনা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর আত্মসম্মানের গরিমা। অথচ ইতিহাস সাক্ষী আছে, ভাষা এক হলেই ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয় না। তাহলে ইংরেজিভাষী দেশ ইংল্যান্ডের থেকে আমেরিকা কখনোই স্বাধীনতা ঘোষণা করত না। পাশাপাশি বাস করে, এক ভাষায় কথা বলেও ইংল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ড রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হত না। অথচ এই সাধারণ বিচারবুদ্ধি এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা বাঙ্গালীর মাথায় জাগছে না কেন? একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঢাল করে ক্রমাগত বাঙ্গালীকে গেলানো হচ্ছে যে “ভাষার জন্য ওরা প্রাণ দিয়েছে”! এই যুক্তির আড়ালে যে ধীরে ধীরে বাংলা ভাষাটাই ওদের দখলে চলে যাচ্ছে, সে খেয়াল কি আমাদের আছে! রাজ্যের হাতে গোনা কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা হয়তো এই ভাষা দখলে সহায়তা করে কিছু আর্থিক লাভ পাবেন, সেদেশে ব্যবসা বাড়াবেন। কিন্তু সাধারণ বাঙ্গালীর তো এখান থেকে পাবার কিছু নেই। বরং উপরের ওই ভজহরি মান্নার মত হারাবার আছে অনেক কিছু। বাংলা আর বাঙ্গালী শব্দ দুটো যখন অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত, বাংলা ভাষার নিয়ন্ত্রণ হারালে বাঙ্গালী জাতি পরিচয়টা দখল হতে আর কতক্ষণ? প্রশ্নটা কিন্তু এখানে শুধু জাতের নয়, ভাতেরও। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর আসবে এবং চলেও যাবে। কিন্তু বাকি ৩৬৪ টা দিন, বাঙ্গালীরা কি পাবে?