✍️ শ্রী কিশোর চন্দ্র দাস
বাংলাদেশের জন্ম থেকেই বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতেছে। বাংলাদেশে প্রত্যেক সরকারের আমলেই নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর মাধ্যমে দুর্গাপূজা শুরু হয় এবং পূজার সময় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভারত। ভারতের বাইরের দেশের হিন্দুরা মনে করে ভারত হিন্দুদের জন্য নিরাপদ একটা দেশ বা হিন্দুদের দেশ। সত্যিই কি তাই? ভারতে হিন্দুরা কেমন আছে, তা কি জানে অন্য দেশের হিন্দুরা? আসুন দেখে নেই ২০২৪ সালের দুর্গাপূজা কেমন হলো ভারতে।
এই বছর ভারতে দুর্গাপূজা শুরু হলো নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভাংচুরের মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িক হামলায় গুলিতে নিহত হলো এক জন। ১১২ ফুট উঁচু দুর্গাপূজার অনুমতি দেয় নাই প্রশাসন। দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে রেখে গেলো গোমাথার কাটা মাথা। তারপরও দুর্গাপূজা হলো কয়েক যায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার মধ্যে দিয়েই। দুর্গা পূজা শেষ হতেই আসলো লক্ষ্মীপূজা, এই লক্ষ্মী পূজায়ও ভাংচুর হলো লক্ষ্মী প্রতিমা।
এবার আসি ঘটনায়।
১০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার সন্দেশখালির ‘মাঝের সরবেড়িয়া নতুন মিলন সংঘ’ ক্লাবের নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।
এই ঘটনায় ক্লাবের সদস্যরা গ্রামেরই কয়েকজন মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, কয়েকদিন আগেই মুনছর মোল্লা ও ফজের আলি মোল্লা গ্রামের মন্দির ভাঙচুরের হুমকি দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তারা নাকি বাংলাদেশি, এমন অভিযোগ করেছেন অনেকে।
১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার গোঘাট থানার অন্তর্গত ঝরিয়া গ্রামে নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করার ঘটনা ঘটে।
২৯ সেপ্টেম্বর রবিবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার শিতলকুচি ব্লকের খলিসামারী সরকারহাট এলাকায় একটি দুর্গা পূজার নির্মাণাধীন বাঁশের প্যান্ডেলে গরুর কাটা মাথা রেখে যায় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। দুর্গাপূজার স্থান অপবিত্র করার লক্ষ্যে গরুর কাটা মাথা রেখে গেছে, এমনটাই অভিযোগ স্থানীয় হিন্দুদের।
২রা অক্টোবর বুধবার, ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার রানাঘাটে ১১২ ফুট দুর্গা পূজার অনুমতি দিলেন না নদিয়ার জেলাশাসক। প্রশাসনের বাধার মুখে বন্ধ হয়ে গেলো ১১২ ফুট দুর্গা প্রতিমার পূজা।
৬ অক্টোবর ভারত-ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর ত্রিপুরা জেলার কদমতলা ব্লক সংলগ্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুদের বাড়ি ঘরে প্রবেশ করে পুরুষ মহিলা সহ শিশুদের মারধর করে। হিন্দুদের বাড়ি এবং একটি বিউটি পার্লার ভাংচুর করেছে। হিন্দুদের দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
৯ অক্টোবর বুধবার রাতে ভারত-উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের লখনউয়ের নীলমাথায় মন্দিরে স্থাপিত মা দুর্গার পাথরের প্রতিমা ভেঙে দিয়েছে। পরের দিন সকালে মন্দিরের পুরোহিত পূজা দিতে আসলে দেখেন গ্ল্যাডার মেশিন দিয়ে পাথরের প্রতিমার চার টি হাত কেটে ফেলেছে।
১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার মহাসপ্তমীর রাতে, ভারত-তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী শহর হায়দ্রাবাদের নামপল্লী প্রদর্শনী মাঠে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর করেছে।
১১ অক্টোবর শুক্রবার মহাষ্টমীর দিন ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতার গার্ডেনরিচ এলাকার জে-১৯১ ফতেপুর ভিলেজ রোডের নিউ বেঙ্গল স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্গাপুজো মণ্ডপে ঢাক ও মাইক বাজানোর অপরাধে স্থানীয় মুসলিম যুবকরা পূজা বন্ধ করার হুমকি দেয়। পুজো বন্ধ না করলে মণ্ডপ ও প্রতিমা ভাঙচুর করার হুমকি দেয়।
১১ অক্টোবর শুক্রবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটায় রেমন্ড মেমোরিয়াল স্কুলের বিপরীতে কিশোর সংঘের আয়োজিত দুর্গাপুজো মণ্ডপে শাঁখ, লাউড স্পিকার, ঢাক বাজাতে নিষেধ করে হুমকি দিয়েছে স্থানীয় মুসলিমরা। না হলে পূজা শেষ হলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় মুসলিমরা।
১৩ অক্টোবর রবিবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার শ্যামপুরে দুর্গা পূজার প্যান্ডেলে হামলা চালায় মুসলিমরা। হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করে এবং হিন্দুদের দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। এছাড়াও কয়েকজন হিন্দুকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মুসলিমরা।
১৩ অক্টোবর রবিবার বিজয়া দশমীর দিন ভারত-উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাহরাইচ জেলার রাম গাঁও থানা এলাকার রেহুয়া মনসুর গ্রামের প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় স্থানীয় মুসলিমরা হামলা চালিয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিমা লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে থাকে। পাথর ছোড়ার মধ্যেই ব্যাপক গুলি চালায় তারা। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় রেহুয়া মনসুর গ্রামের বাসিন্দা কৈলাশ নাথ ওরফে পুতাইয়ের ছেলে রাম গোপাল মিশ্র (২২) নামে এক হিন্দু যুবক । তার বুকে ও পেটে একাধিক গুলি লাগে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু বাহরাইচ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
১৩ অক্টোবর রবিবার ভারত-পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের সময় কৃষ্ণনগর পৌরসভার নির্দেশে দুর্গাপ্রতিমাকে মেশিন দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে জল ছিটিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। দুর্গাপ্রতিমার প্রতি এমন অসম্মান জনক আচরণ হিন্দুদের মনে গভীর আঘাত লাগে।
১৩ অক্টোবর ভারত-কর্ণাটক রাজ্যের বেলাগাভি জেলায় দুর্গার প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে।
১৩ অক্টোবর রবিবার বিজয়া দশমীর দিন ভোর রাতে ভারত-পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার পাঁচুন্দি গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন পারিবারিক দুর্গামন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটেছে।
এই সময় চোর দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গনেশসহ দেবদেবীর প্রতিমার যাবতীয় গহনা চুরি করে নিয়ে যায়। মন্দিরের পুরোহিত বলেন প্রায় ৪০০ ভরি রুপো ও ১৫-২০ ভরির সোনার গহনা চুরি হয়ে গেছে।
মন্দিরের পূজা পরিচালনা ট্রাস্টির সম্পাদক অরূপ কুমার বলেন, আনুমানিক ৭০-৮০ লক্ষ টাকার গহনা চুরি হয়ে গেছে।
১৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ভারত-পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বজবজ বিধানসভার বাওয়ালি রথতলা পুজো কমিটির মা লক্ষ্মীর প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।
১৯ অক্টোবর ভারত-তেলেঙ্গানা রাজ্যের সেকেন্দ্রাবাদে মুথ্যালাম্মা মন্দিরে ঢুকে সালমান সেলিম নামে এক ব্যক্তি দেবী সিংহবাহিনী বিগ্রহে লাথি মেরে সিংহাসন থেকে ফেলে ভেঙে দেয়। অভিযুক্ত সালমান সেলিম এবং তার সঙ্গীদের গ্রেফতারের দাবিতে মন্দির চত্বরে বিক্ষোভ দেখালে কংগ্রেস শাসিত তেলেঙ্গানা পুলিশ বিক্ষোভরত হিন্দু ভক্তদের ওপর নৃশংসভাবে লাঠি চার্জ করে। পুলিশের লাঠিচার্জে বহু ভক্ত গুরুতর আহত হয়েছে । তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের মাথা ফেটে গেছে।
হিন্দুসংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ ভারতে যদি এমন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে, তাহলে হিন্দু মন্দিরের নিরাপত্তা কোথায়, এটা ভাবার সময় এসেছে। বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু কিছু এলাকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে, খুব শীঘ্রই হয়তো ভারতের হিন্দুদের রাত জেগে প্রতিমা পাহারা দিতে হবে, ঠিক বাংলাদেশের মতো।
তথ্য সূত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা, স্যান্দন পত্রিকা, হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা, অপইন্ডিয়া এবং এইদিন।