অরণ্য ষষ্ঠী: ভোগ ও যোগের মৈত্রী



Updated: 14 June, 2024 4:50 am IST

© ডঃ জয়দেব বিশ্বাস

‘অরণ্য’ শব্দবন্ধের মধ্যে তপস্যার বিভাব আছে আবার তপঃক্লেশের নিরসন আছে, তেমনি রহস্য আছে, রোমাঞ্চ এবং আবিষ্কারের আনন্দ আছে; সর্বোপরি সবুজের সমারোহ, জীবনবায়ু অক্সিজেনের অফুরান প্রবাহ আর সংস্কৃতি ও সাম্যের সৌগন্ধ্য জড়িয়ে আছে। একটিমাত্র শব্দবন্ধের মধ্যেই এতগুলি ভাবের আবির্ভাব ঘটলে তাকে অবলম্বন করে বিভিন্ন লক্ষ্যে, বিচিত্র উপায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা হয়ে থাকবে একথা বলাই যায়।

আবার কবিগুরুর মননে, “যেখানেই প্রকৃতির মধ্যে কোন বিশেষ সৌন্দর্য বা মহিমার আবির্ভাব,সেখানেই ভারতবর্ষের তীর্থস্থান। মানবচিত্তের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির মিলন যেখানে স্বভাবতই ঘটতে পারে, সেই স্থানটিকেই ভারতবর্ষ পবিত্র তীর্থ বলে জেনেছে”।

এমনই এক তীর্থময়- পুণ্যময় ভাব ও ভাবনার আনন্দময় উদযাপন হল অরণ্যষষ্ঠী। অরণ্য কীভাবে ষষ্ঠীদেবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে হিন্দু জনমনের চৈতন্য প্রবাহে প্রাচীনকাল থেকে বহতা লাভ করল তার ইঙ্গিত আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র,পুরাণ, ব্রত, পূজা,এবং পুরাতত্ত্বের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ।
যেমন ::
শ্রীমদ্ দেবীভাগবত পুরাণে এমন উল্লেখ আছে, “প্রাকৃতির ষষ্ঠ অংশটির নাম ষষ্টী। দেবী হলেন শিশুসন্তানদের দেবতা। তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর মায়া এবং তিনি সকলকে সন্তান দান করেছেন। তিনি ষোড়শ মাতৃকার একজন। তিনি দেবসেনা নামেও পরিচিত, ব্রতের দেবী ; তিনি স্কন্দের সতী ও প্রিয়তমা স্ত্রী। তিনি শিশুদের দীর্ঘায়ু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন এবং সর্বদা তাদের প্রযত্নে ও সংরক্ষণে নিয়োজিত থাকেন। সিদ্ধ যোগিনীরূপে সর্বদা সন্তানের পাশে থাকেন।”
প্রশ্ন হলো কীভাবে?

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ও প্রকৃতি তাদের অটুট বন্ধন ও বন্ধুত্ব রাখতেই বুঝি অরণ্যষষ্ঠীর প্রচলন হয়েছিল আর সেই অরণ্যষষ্ঠী থেকেই আজকের জামাইষষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ। দেবী ষষ্ঠী মাতৃস্বরূপা। তিনিই সন্তান দান করেন। তাই বছরে ১২টি ষষ্ঠী পালনের রীতি ছিল গ্রামবাংলায়। দুর্গাষষ্ঠী, লোটনষষ্ঠীর ব্রত সেভাবে আজকাল আর ঘরে ঘরে পালিত হয় না। সময়ের সাথে সাথে রূপ বদলে রয়ে গেছে কেবল অরণ্যষষ্ঠী। একসময় এই ষষ্ঠী নির্দিষ্ট তিথিতে পালন করা হত অরণ্যের মাঝে। যেন মনে হত অরণ্যেরই পূজা করা হচ্ছে,অরণ্য তথা প্রকৃতির সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে প্রাণের মিলনের আকুতি প্রকাশ পেত সেই পূজা -ব্রত তথা উৎসবে। হাতের কাছে অরণ্য না থাকলে, বাড়ির উঠোন বা কাছাকাছি কোথাও অরণ্যের প্রতিরূপ বা ছোটখাটো বাগান তৈরি করে নেওয়া হত। এখনও সেই গাছকে জড়িয়েই আমাদের ষষ্ঠী পুজো।উদ্দেশ্য কিন্তু সেই এক, প্রকৃতির সাথে মিলন,প্রকৃতির সাথে পরিক্রমণ। এই ভাবেই ব্রত পালন করতেন মেয়ে-বৌ,ও মায়েরা। অরণ্যষষ্ঠীর রীতি ও প্রকৃতিতে প্রকৃতির আরাধনার ছোঁয়া ও ছাপ স্পষ্ট রয়েছে।

বর্তমান কালেও সেই উৎসবের রেশ এখনও চলে আসছে। ভরা জ্যৈষ্ঠের শুক্ল ষষ্ঠী তিথি, বাঙালি বাড়িতে এই দিনের মাহাত্ম্য অনেক। গ্রীষ্মের তীব্র তাপিত দিনে এই উৎসব ঘরে ঘরে দমকা ঠান্ডা বাতাসের ঝলক নিয়ে আসে।
তাই জ্যৈষ্ঠ মাস আসলেই বাড়িতে বাড়িতে এই ষষ্ঠীপূজা নিয়ে এক অন্যরকম মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। এই তিথিতে দেবী ষষ্ঠীর ব্রত পালন, সন্তান প্রাপ্তি ও সন্তানের মঙ্গল কামনা করা হয়।

অনতিঅতীতে, এমনকি এখনও কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা বাপের বাড়িতে আসার অনুমতি পেত না,পায় না। মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত তার বাবা-মা, আত্মীয়- স্বজন। মেয়েকে কাছে পাওয়ার জন্যই জামাইকে আদর- যত্ন করার জন্য একটি দিন(উপলক্ষ্য) ধার্য করে নিতেন তারা। জামাই আদরের পাশাপাশি মেয়েকেও কাছে পেতেন তারা। আর এই আবহেই অরণ্যষষ্ঠী কালক্রমে হয়ে উঠলো জামাইষষ্ঠী।তবে এই অরণ্যষষ্ঠীতে শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনাই জড়িয়ে রয়েছে তা নয়, এই রীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অরণ্য সৃষ্টি তথা প্রকৃতির উদ্দেশ্যে আরাধনাও।

আবর একইভাবে মেয়েকে দেখার ব্যাকুলতার আড়ালে জামাইষষ্ঠীর উদযাপনকে পারিবারিক মিলনমেলা বা উৎসব বলা যেতে পারে।

আবার এটাও বিশ্বাস যে দেবী ষষ্ঠী হলেন দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র স্ত্রী, ইন্দ্র ও শচীদেবীর কন্যা দেবসেনা। তিনি উদ্ভিদ এবং প্রজননেরও দেবতা। বিশ্বাস করা হয় যে সন্তান লাভে এবং সন্তান প্রসবের সময় সহায়তা করেন। তিনি একটি মাতৃমূর্তি হিসাবে চিত্রিত ও পুজিত হন। বিড়াল তাঁর বাহন এবং এক বা একাধিক শিশু পালন, একই সঙ্গে তিনি অরণ্য সৃজনের অর্থাৎ অরণ্যেরও জননী রূপে পুজিত
দেবীর প্রণাম মন্ত্র :
জয় দেবী জগন্মাত জগদানন্দকারিণী।
প্রসীদ মম কল্যাণী নমস্তে ষষ্ঠী দেবতা।।
অর্থাৎ জগন্মাতা ও জগতের কল্যাণকারিণী হিসেবেই তিনি বিরাজিত। আর তাকে সামনে রেখেই আমাদের নিরন্তর অরণ্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রয়াস জারি।

আরও বিস্তৃতভাবে ভাবলে বোঝা যায় যে বর্তমানে আমাদের সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ দূষণ তথা পরিবেশ সংকটের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবস পালন করছি এবং বিজ্ঞানীরা নানান ভাবে চেষ্টা করছেন এই বিষময়,সুগভীর সংকটের হাত থেকে রক্ষা পাবার। পরিবেশের এই সংকটকালে প্রকৃতির তথা অরণ্যের সঙ্গে মানুষের মিলনের যে দিকটি আমরা এখন অরণ্যষষ্ঠীর মাধ্যমে করছি, সেটা প্রাচীনকালের ঋদ্ধ পূর্বসূরীগণ অনেক আগেই থেকেই সেই ব্যবস্থা অর্থাৎ সুন্দর-সুস্থ সবুজ রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না।