রামায়ণে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা



Updated: 17 September, 2024 6:11 pm IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

বিশ্বকর্মা সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী; তিনি পরা বিদ্যার সাথে সাথে শিল্পকলা, স্থাপত্যবেদ ইত্যাদি আভ্যুদয়িক বিদ্যা প্রদান করেন। পুষ্পশিল্প, লৌহশিল্প, মৃৎশিল্প, অলংকারশিল্প, শঙ্খশিল্প, বয়নশিল্প, অঙ্কনশিল্প, কাংসশিল্প এবং দারুশিল্প ইত্যাদি বিবিধ শিল্প এবং প্রকৌশল বিদ্যার তাঁকে অধীশ্বর বলা হয়। রামায়ণের একাধিক কাণ্ডের বিভিন্ন স্থানে বিশ্বকর্মার কথা পাওয়া যায়।শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসকালে তাঁর সাথে মিলনের কালে পথে মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে রাত্রিবাসের জন্য মনঃস্থির করে ভরত। কৈকেয়ীপুত্র ভরতকে মহর্ষি ভরদ্বাজ তাঁর আশ্রমে ভরতের সকল সেনাসদস্যসহ ভরতকে তাঁর আশ্রমে আপ্যায়িত করে। এতে দৈবী সকল ব্যবস্থা করে দেয় দেব বিশ্বকর্মা। ঋষি ভরতকে যথাসাধ্য আতিথ্য গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ করে। তখন ভরত মহর্ষি ভরদ্বাজকে বললেন –”হে মহর্ষি, বনে প্রাপ্তব্য পাদ্য, অর্ঘ্য এবং বনজাত ফলমূলাদি দ্বারা আপনি তো অতিথি সৎকার করেছেন”। তখন ঋষি ভরদ্বাজ হাসতে হাসতে ভরতকে বললেন– ” ভরত আমি জানি, তুমি আমার প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ ; তাই, তোমাকে যাই দিই না কেন, তাতেই তুমি সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু, তোমার এই সৈন্যদের আমি ভোজন করাতে চাই। হে নরশ্রেষ্ঠ ! যাতে আমার প্রীতি জন্মে, তাই-ই তোমার অবশ্য অনুমত হওয়া উচিত।হে পুরুষশ্রেষ্ঠ ! তুমি সৈন্যদের দূরে রেখে এখানে এসেছ কেন ? কেন, সেনাবাহিনীকে এখানে নিয়ে আসোনি” ? মহর্ষি ভরদ্বাজের কথা প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ভরত তপোধন ভরদ্বাজকে করজোড়ে বললেন —”ভগবন্, সৈন্যদের উপদ্রবে আশ্রমের ক্ষতি, আপনার বিরক্তির কারণ হবে মনে করে সেই ভয়ে আমি সৈন্যদের আশ্রমে নিয়ে আসিনি। তবে হে ভগবন্, শ্রেষ্ঠ অশ্বসমূহ, মত্ত গজরাজেরা এবং সৈন্যসহ অনেক মানুষ আশ্রমের বিস্তৃত স্থান জুড়ে আমায় অনুসরণ করছে। সৈন্যদের দ্বারা যেন বৃক্ষলতা, জল, মাটি এবং পর্ণশালার কোন ক্ষতি না হয়; তাই আমি তাদের আশ্রমের বাইরে রেখে আমি একাই এসেছি”। ভরতের কথা শেষে মহর্ষি ভরদ্বাজ সেনাবাহিনী তাঁর আশ্রমে নিয়ে আসতে আদেশ করলেন।মহর্ষির এই আজ্ঞানুসারে ভরত পরবর্তীতে সেনাবাহিনীকে আশ্রমে নিয়ে এলেন।

অগ্নিশালাং প্রবিশ্যাথ পীত্বাপঃ পরিমৃজ্য চ।
আতিথ্যস্য ক্রিয়াহেতোর্বিশ্বকর্মাণমাহ্বয়ৎ৷৷
আহ্বয়ে বিশ্বকর্মাণমহং ত্বষ্টারমেব চ।
আতিথ্যং কর্তুমিচ্ছামি তত্র মে সংবিধীয়তাম্॥
(অযোধ্যাকাণ্ড, ৯১.১১-১২)

অতঃপর ঋষিবর ভরদ্বাজ অগ্নিশালায় প্রবেশ করে জল দ্বারা আচমনমার্জনাদি সম্পন্ন করে সপরিজন ভরতের আতিথ্য সৎকারের জন্য বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করলেন।

ঋষি বললেন– আমি সপরিজন ভরতের আতিথ্য
সম্পাদন করতে ইচ্ছা করি। তাই তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য বিশ্বকর্মা ত্বষ্টা দেবকে আহ্বান করছি।”

রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে, ভগবান শ্রীব্রহ্মা বিশ্রবা পুত্র বৈশ্রবণকে চতুর্থ দিকপালের আশীর্বাদ করে দেবতাদের সঙ্গে নিজ স্থানে গমন করলেন। ব্রহ্মাদি দেবতাগণ আকাশপথে গমন করলে, ধনাধ্যক্ষ বৈশ্রবণ কুবের তাঁর পিতা বিশ্রবাকে হাতজোড় করে বললেন – “ভগবন্! আমি পিতামহ শ্রীব্রহ্মার থেকে মনোবাঞ্ছিত ফল প্রাপ্ত করেছি। কিন্তু প্রজাপতিদেব আমার জন্য কোনো নিবাসস্থলের ব্যবস্থা করেননি। অতএব ভগবন্! আপনিই আমার থাকার যোগ্য এমন স্থানের সন্ধান দিন, যা সর্বভাবে উপযুক্ত হয়। প্রভো ! সেই স্থান যেন এমন হয়, যেখানে বাস করলে কোনো প্রাণী কষ্ট না পায়”। পুত্র কুবেরের কথা শুনে বিশ্রবা মুনি বললেন:

এবমুক্তস্তু পুত্রেণ বিশ্রবা মুনিপুঙ্গবঃ।
বচনং প্ৰাহ ধর্মজ্ঞ শ্রূয়তামিতি সত্তম৷৷
দক্ষিণস্যোদধেস্তীরে ত্রিকূটো নাম পর্বতঃ।
তস্যাগ্রে তু বিশালা সা মহেন্দ্রস্য পুরী যথা।
লঙ্কা নাম পুরী রম্যা নির্মিতা বিশ্বকর্মণা।
রাক্ষসানাং নিবাসার্থং যথেন্দ্রস্যামরাবতী।
তত্র ত্বং বস ভদ্রং তে লঙ্কায়াং নাত্র সংশয়ঃ। হেমপ্রাকারপরিখা যন্ত্রশস্ত্রসমাবৃতা৷৷
রমণীয়া পুরী সা হি – রুক্মবৈদূর্যতোরণা।
রাক্ষসেঃ সা পরিত্যক্তা পুরা বিষ্ণুভয়ার্দিতৈঃ৷৷
শূন্যা রক্ষোগণৈঃ সর্বৈ রসাতলতলং গতৈঃ ৷
শূন্যা সম্প্রতি লঙ্কা সা প্রভুর্ক্তস্যা ন বিদ্যতে৷৷
স ত্বং তত্র নিবাসায় গচ্ছ পুত্র যথাসুখম্।
নির্দোষস্তত্র তে বাসো ন বাধস্তত্র কস্যচিৎ৷৷
এতচ্ছুত্বা স ধর্মাত্মা ধর্মিষ্ঠং বচনং পিতুঃ।
নিবাসয়ামাস তদা লঙ্কাং পর্বতমূর্ধনি৷৷
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, ৩.২৫-৩২)

“পুত্র কুবেরের কথায় মুনিবর বিশ্রবা বলে—
ধর্মজ্ঞ সাধুশিরোমণি শোনো ! দক্ষিণ সমুদ্রতীরে ত্রিকূট নামক এক পর্বত আছে, যা দেবরাজ ইন্দ্রের অমরাবতীর সমান শোভাসম্পন্ন, তার শিখরে এক বিশাল পুরী বিদ্যমান।
সেই পুরীর নাম লঙ্কা। বিশ্বকর্মা ইন্দ্রের অমরাবতীর সমান এই রমণীয় পুরীর নির্মাণ করেছেন রাক্ষসদের বসবাসের জন্য।
‘পুত্র ! তোমার কল্যাণ হোক। তুমি নিঃসন্দেহে লঙ্কাপুরীতে গিয়ে থাকো। তার চতুর্দিক স্বর্ণনির্মিত প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত।
সেই পুরী অত্যন্ত রমণীয়। সেই পুরী স্বর্ণ ও বৈদূর্যমণির তোরণে শোভিত। পূর্বে ভগবান বিষ্ণুর ভয়ে পীড়িত হয়ে রাক্ষসেরা এই পুরী ত্যাগ করেছিল।
সেই সব রাক্ষস রসাতলে চলে গেছে, তাই লঙ্কাপুরী শূন্য হয়ে গেছে। এখনও তা শূন্যই, কোনো অধিপতি নেই।
অতএব পুত্র ! তুমি সেখানে বাস করার জন্য সুখে গমন করো। সেখানে বসবাস করতে কোনো অসুবিধা বা অন্তরায় নেই এবং কোনো বাধা-বিঘ্ন আসবে না।
পিতার এই ধর্মযুক্ত কথা শুনে ধর্মাত্মা বৈশ্রবণ কুবের ত্রিকূট পর্বতের শিখরে নির্মিত লঙ্কাপুরীতে নিবাস করতে লাগলেন।”

রামায়ণে বিশ্বকর্মাপুত্র নলের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নল একজন সুদক্ষ বানরসেনা।এ নলেরই প্রকৌশল প্রযুক্তি বিদ্যায় লঙ্কায় যেতে সমুদ্রের অভ্যন্তরে সেতু নির্মিত হয়। নলকে দিয়ে সেতু নির্মাণের পরামর্শ সরিৎপতি সমুদ্র সর্বশাস্ত্রজ্ঞ শ্রীরামচন্দ্রকে প্রদান করেন।

অয়ং সৌম্য নলো নাম তনয়ো বিশ্বকর্মণঃ।
পিত্রা দত্তবরঃ শ্রীমান্ প্রীতিমান্ বিশ্বকর্মণঃ৷৷
এষ সেতুং মহোৎসাহঃ করোতু ময়ি বানরঃ।
তমহং ধারয়িষ্যামি যথা হোেষ পিতা তথা৷৷
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ২২.৪৫-৪৬)

“হে সৌম্য ! আপনার বাহিনী মধ্যে নল নামধারী বিশ্বকর্মার পুত্র রয়েছেন। পিতা বিশ্বকর্মার বরে ইনি অত্যন্ত শ্রীমান এবং প্রীতিমান।
পিতার সমান শিল্পকর্মে দক্ষ এই মহোৎসাহী বানর আমার ওপর সেতু নির্মাণ করুন, আমি সেই সেতু ধারণ করব।”

শ্রীরামচন্দ্রকে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে সমুদ্র অন্তর্হিত হলে, তখন বানরশ্রেষ্ঠ মহাবলশালী নল ভগবান শ্রীরামকে বললেন:

অহং সেতুং করিষ্যামি বিস্তীর্ণে মকরালয়ে।
পিতৃঃ সামর্থ্যমাসাদ্য তত্ত্বমাহ মহোদধিঃ৷৷
দণ্ড এব বরো লোকে পুরুষস্যেতি মে মতিঃ।
ধিক্ ক্ষমামকৃতজ্ঞেষু সান্ত্বং দানমথাপি বা।।
অয়ং হি সাগরো ভীমঃ সেতুকর্মদিদৃক্ষয়া।
দদৌ দণ্ডভয়াদ্ গাধং রাঘবায় মহোদধিঃ ৷৷
মম মাতুর্বরো দত্তো মন্দরে বিশ্বকর্মণা।
ময়া তু সদৃশঃ পুত্রস্তব দেবি ভবিষ্যতি৷৷
ঔরসস্তস্য পুত্রোঽহং সদৃশো বিশ্বকর্মণা। স্মারিতোঽস্ম্যহমেতেন তত্ত্বমাহ মহোদধিঃ।
ন চাপ্যহমনুক্তো বঃ প্রব্রূয়ামাত্মনো গুণান্ ॥
সমর্থশ্চাপ্যহং সেতুং কর্তুং বৈ বরুণালয়ে।
তস্মাদদ্যৈব বধ্নন্ত সেতুং বানরপুঙ্গবাঃ৷৷
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ২২.৪৮-৫৩)

“পিতৃ প্রদত্ত শক্তিতে বলীয়ান আমি এই বিস্তীর্ণ মকরালয়ে সেতু তৈরি করতে সমর্থ। মহাসমুদ্র যথার্থই বলেছেন।
আমার মতে সংসারে অকৃতজ্ঞ জনের প্রতি দণ্ডনীতির প্রয়োগই মঙ্গলকর। তাদের প্রতি ক্ষমা, সান্ত্বনা এবং দাননীতির প্রয়োগকে ধিক্কার।

ভয়ংকর এই মহাসমুদ্রকে রাজা সগরের পুত্রগণই বিস্তারিত করেছেন। তবুও কৃতজ্ঞতাবশে নয় বরং দণ্ডভয়েই সেতু নির্মাণ কার্য অবলোকন করার জন্যই মহাসমুদ্র রঘুনাথের নিকট নিজের গুরুত্ব প্রদর্শিত করেছেন।
মন্দার পর্বতে বিশ্বকর্মা আমার মাতৃদেবীকে বর প্রদান করেছিলেন, দেবি ! তোমার পুত্র আমারই সদৃশ হবে।
বিশ্বকর্মার পুত্র আমি, কর্মে এবং দক্ষতায় তাঁরই সমান। এই মহাসমুদ্র আজ আমাকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমি আপনাকে এই বিষয়ে বলিনি। কারণ, আপন গুণের কথা প্রকাশ করা উচিত নয়।
এই বরুণালয়ে আমি সেতু তৈরি করতে সক্ষম। অতএব বানরবীরগণ আজকেই সেতু নির্মাণ কার্য শুরু করুন।”

সমুদ্রের উপরে বিশ্বকর্মার পুত্র নলের প্রকৌশল বিদ্যায় নির্মিত অপূর্ব সেতুটি আকাশের ছায়াপথের ন্যায় সুশোভিত হয়েছিল। সেতু নির্মাণের প্রকৌশল বিদ্যা দেখে গন্ধর্ব, দেবগণ, সিদ্ধ এবং মহর্ষিগণ বিস্মিত হয়ে গেলেন।

স বানরবরঃ শ্রীমান্ বিশ্বকর্মাত্মজো বলী।
ববন্ধ সাগরে সেতুং যথা চাস্য পিতা তথা॥
স নলেন কৃতঃ সেতুঃ সাগরে মকারলয়ে।
শুশুভে সুভগঃ শ্রীমান্ স্বাতীপথ ইবাম্বরে৷
ততো দেবাঃ সগন্ধর্বাঃ সিদ্ধাশ্চ পরমষয়ঃ।
আগম্য গগনে তর্স্থুদ্ৰষ্টুকামাস্তদদ্ভুতম্॥
দশযোজনবিস্তীর্ণং শতযোজনমায়তম্
দদৃশুদেবগন্ধর্বা নলসেতুং সুদুষ্করম্।।
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ২২.৭৩-৭৬)

“বিশ্বকর্মার পুত্র মহাবলশালী বানরশ্রেষ্ঠ পিতৃতুল্য প্রতিভাবান শ্রীমান নল এইভাবে সমুদ্রে শত যোজন ব্যাপী দীর্ঘ সেতু তৈরি করল।
মকরালয় সমুদ্রে নল কর্তৃক নির্মিত সুন্দর সেতুটি আকাশে স্বাতীপথ বা ছায়াপথের ন্যায় সুশোভিত হয়েছিল।
গন্ধর্ব, দেবগণ, সিদ্ধ এবং মহর্ষিগণ সেই অদ্ভুত প্রকৌশল কার্য আকাশে অবস্থান করে দর্শন করলেন।

নল কর্তৃক নির্মিত দশযোজন প্রস্থ এবং শতযোজন
দীর্ঘ এই সুদুষ্কর সেতু (সেতুটির নির্মাণ কার্য অতি দুরূহ) দেবতা ও গন্ধবর্গণ বিস্মিত নয়নে দর্শন করলেন।”

লেখক পরিচিতি:

ড. শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়