যে কারণে ‘আজাদী’ স্লোগানকে ঘৃণা করা উচিত



Updated: 11 September, 2024 8:19 am IST

© শ্রী পার্থ কাশ্যপ চ্যাটার্জি

কলকাতা।।

সময়কাল সেপ্টেম্বর ২০২৪।।

বীভৎস, নারকীয়, নিন্দনীয় এক ঘটনা ঘটে গেছে প্রায় মাস খানেক আগে। কলকাতারই এক মেডিক্যাল কলেজে। কর্তব্যরত এক জুনিয়ার ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে বলে খবর। কেউ কেউ বলছেন আর্থিক দুর্নীতিসহ আরো বহু বিষয় চাপা দিতেই নাকি….. ।

সে যাই হোক। বিচার চেয়ে নিত্যদিন পথে নামছেন বহু মানুষ। তাঁদের প্রতিবাদের কন্ঠে মুখরিত হচ্ছে সমগ্র বাংলার রাজপথ! কখনও মশাল জ্বালিয়ে, কখনও সব আলো বন্ধ করে! নারী থেকে পুরুষ, বৃহন্নলা হয়ে যৌনকর্মী। ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, হাকিম, কেরানী। কেউ বাদ নেই। সারা দেশ সহ পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ শহরেও এই ঘৃণ্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেনো একটাই সুর, একটাই স্বর – We want Justice……

সবই ঠিকঠাক চলছিল। তারমাঝে, হঠাৎ ছন্দপতন!

সমগ্র আন্দোলনকে পিছনে ফেলে সমাজ মাধ্যমে কতগুলো ভিডিও ঘুরছে যে বিচারের মঞ্চ থেকে কারা নাকি স্লোগান তুলেছেন –

“हम क्या चाहते हैं? आज़ादी!
ज़रा ज़ोर से बोलो – आज़ादी
है हक हमारा – आज़ादी!
हम छीन के लेंगे – आज़ादी!
ख़ुशबू वाली-आज़ादी!
है जान से प्यारी – आज़ादी!”

কারা এরা? কোন সংগঠনের? চোখ খুলে দেখুন – বামপন্থী তরুণ ‘তুর্কী’ (ভারতীয় বা গ্রীক কিংবা জার্মান নয় কিন্তু!) কোনও এক নেত্রী, যিনি লোকসভায় প্রার্থী হয়েছিলেন সিপিআই(এম) থেকে, তাঁকেও ঐ শ্লোগান দিতে দেখতে পাবেন। ঠিক তেমনই ‘বিদেশে গিয়ে গয়না চুরি করা’ থলথলে বেলেল্লাপনা কোনও এক অভিনেত্রীকেও পাবেন! আর ঐ মঞ্চের আশেপাশের পতাকা থেকে আলপনা গ্রাফিতি – সব চিৎকার করে বলবে যে ‘আমরা বাম। বামপন্থাই সঠিক পথ’!

এবার আমরা যদি সময়ের সরণী বেয়ে উপরিউক্ত কবিতা বা স্লোগানের ইতিহাস বা গোড়ায় পৌঁছতে যাই, তবে দেখবো যে মূলত ১৯৮০ সাল থেকে কাশ্মীরে ভারতের শাসন ব্যবস্থার বিরোধ করে যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়, সেই আন্দোলনেই এই স্লোগানটি মূলত ব্যবহৃত হয়েছিলো। কিন্তু অনেকের কাছে এই আন্দোলনটি পাকিস্তানের অংশ হওয়ার দাবি বা পূর্ণ সার্বভৌমত্ব লাভ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষাও ছিলো বটে। পরবর্তীতে এই আন্দোলনের অংশ হিসাবেই ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ২০ জানুয়ারির মধ্যে ঐতিহাসিক হিন্দু গনহত্যা ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া চলে কাশ্মীরে! যার ফলে ভারতের বুকে ৬ লক্ষ কাশ্মীরি হিন্দুকে নিজেদের পৈত্রিক তথা পিতামহ, প্রপিতামহের আপন বংশানুক্রমিক ভিটা ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়! রাতারাতি……… কপর্দকশূন্য অবস্থাতেই!

আমরা যদি খেয়াল করি, তবে দেখবো যে কাশ্মীর উপত্যকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ‘আজাদি’ শব্দটি কাশ্মীরি কবিদের কবিতায় বারংবার উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনই একজন হলেন গুলাম আহমেদ শাহ, যিনি ‘মেহজুর’ নামেও পরিচিত এবং কাশ্মীরের জাতীয় কবি হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন, তিনিই স্বাধীনতার ধারণাকে ব্যঙ্গ করার জন্য ১৯৪৭ সালে ‘আজাদি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।

ঠিক এর পাশাপাশি, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এসে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বি. টি. রণদিভে বলছেন – ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়…..’! পার্টি তাঁর সেই তত্বকে মান্যতা দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, যা ‘রণদিভে লাইন’ নামে পরিচিত ও গৃহীত হচ্ছে!

কি অদ্ভুত সমাপতন…….. তাই না?

এবার আর একটু এগোনো যাক। সময়টা ১৯৫২ সাল। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ও মানবেন্দ্র নাথ রায়ের দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ফিলিপ স্প্রার্ট – তিনি কি বলছেন একটু দেখে নিই –

“Let Kashmir go ahead, alone and adventurously, in her explorations of a secular state. We shall watch the act of faith with due sympathy but at a safe distance, our honour, our resources and our future free from the enervating entanglements which write a lie in our soul.”

ফিলিপ স্প্রার্ট আরো যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভারতীয় নীতি ‘এক-জাতি’ তত্ত্বে ভুল বিশ্বাস এবং শ্রীনগরের সুন্দর ও কৌশলগত উপত্যকার মালিক হওয়ার লোভ’-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। তিনি আরও বলেছিলেন যে এই নীতির খরচ, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য ব্যায়বহুল হবে এবং কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার এবং ভারতের অন্য কোথাও বিরক্তি সৃষ্টি করার পরিবর্তে, রাজ্যটিকে আলাদা হতে দেওয়াই ভাল।

কিছু বোঝা গেলো কি?

কাশ্মীরি কবি, যিনি বর্তমান কাঠামোয় প্রচলিত ও চর্চিত স্বাধীনতার বিরোধী, কাশ্মীরি পৃথক স্বত্তায় বিশ্বাসী, যার কবিতার ভিত্তিতেই ‘আজাদি’ শ্লোগান নির্মিত, তার সাথে সেই সময়কার পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যর কথা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে! কি অদ্ভুত তাই না!?

আজকের এই আজাদি শ্লোগানটি ১৯৭৬ সালে বার্মিংহামে মকবুল ভাট এবং আম্মানুল্লাহ খান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট্র'(JKLF) মূলত যেটি কাশ্মীরের প্রথম জঙ্গি গোষ্ঠী হিসাবে বিবেচিত হয়, তাঁদের দ্বারাই উপত্যকায় জনপ্রিয় হয়!

কি বললেন? মকবুল ভাট নামটি পরিচিত লাগছে? লাগবেই তো। এইতো সেইদিন, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেএনইউ’তে সেই বিতর্কিত ও বহুচর্চিত সমাবেশ থেকেই ঐ শ্লোগানটি উঠেছিলো যে ‘মকবুল হাম শরমিন্দা হ্যায়, তেরা কাতিল জিন্দা হ্যায়। আফজল হাম শরমিন্দা হ্যায়, তেরা কাতিল জিন্দা হ্যায়……… ‘

দাঁড়ান। আরো ছিলো তো সাথে।

হাম কেয়া চাহতে?
‘আজাদি’
কাশ্মীর মাঙ্গে…………
‘আজাদি’
কেরল মাঙ্গে…………
‘আজাদি’
বাঙ্গাল মাঙ্গে…………
‘আজাদি’
আসাম মাঙ্গে…………
‘আজাদি’
হ্যায় হক হামারা…………
‘আজাদি’
হাম লেকে রহেঙ্গে…………
‘আজাদি’……………………….

লিড করছিলেন কে?

  • কানহাইয়া কুমার।
    তা তখন তিনি কোথায় ছিলেন?
  • সিপিআই’তে।
    এখন তিনি কোথায় আছেন?
  • কংগ্রেস।
    আচ্ছা, বি. টি. রণদিভে কোন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন?
  • সিপিআই।
    ফিলিপ স্প্রার্ট? তিনি?
  • তিনিও সিপিআই’য়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আচ্ছা, আফজল গুরু কে যেনো?
  • ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদ হামলার মূল নায়ক।

মকবুল ভাট?

  • ঐ যে, জেকেএলএফের প্রতিষ্ঠাতা।

এবার ওপরের সব বিন্দুগুলোকে মেলান।

ও হ্যাঁ। আর একজন বাদ গেলেন।

  • কমরেড গঙ্গাধর অধিকারী। ব্যাল্কানাইজেশন অফ ইন্ডিয়া থিওরির জনক। তিনিও কিন্তু সিপিআই’য়েরই। ভারতকে ভেঙ্গে ১৭টা পৃথক রাষ্ট্রের থিওরি ওনারই দেওয়া। সালটা ১৯৪০। তারপরই মুসলিম লীগ লাহোর অধিবেশনে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

গঙ্গাধর অধিকারী – গুলাম আহমেদ শাহ – আজাদি – ফিলিপ স্প্রার্ট – মকবুল ভাট – জেকেএলএফ – আজাদি – কাশ্মীরর সশস্ত্র বিদ্রোহ – ১৯৮৯-৯০ সালেরহিন্দু বিতারণ – কানহাইয়া কুমার – আজাদি – কংগ্রেস – সিপিআই(এম) – জায়গায় জায়গায় আজাদি শ্লোগান……..

এরপরও এদেরকে আপনি ভক্তি করবেন? এরপরও এদের তরুণ তুর্কী (তুর্কী?) বলে আহ্লাদিত হবেন?