© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।
ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।
বাংলা অর্থ— রজতগিরির ন্যায় তাঁহার আভা, যিনি সুন্দর চন্দ্রকে ভূষণরূপে ধারণ করিয়াছেন, যাঁহার দেহ রত্নময় বেশভূষায় উজ্জ্বল, যিনি পদ্মাসনে উপবিষ্ট, আনন্দময় মূর্তি, চতুর্দিকে দেবতারা তাঁহার স্তব করিতেছেন, যিনি ব্যাঘ্রচর্ম- পরিহিত, যিনি জগতের আদি, জগতের কারণ, সকল প্রকার ভয় নাশক, পঞ্চবদন এবং প্রতিটি বদনে তিনটি চক্ষু, সেই মহেশকে নিত্য এইরূপ ধ্যান করিবে।
আজ মহা শিব রাত্রি। সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী দেবাদিদেব মহাদেব হলেন ত্রিদেবের অন্যতম ( আর দুই জন ব্রহ্মা আর বিষ্ণু )। এই তিন দেব পরমেশ্বরের তিন গুণের প্রতীক: ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টি, বিষ্ণু পালন আর শিব ধ্বংসের প্রতীক। এনাদের মধ্যে শিবকে আমরা লিঙ্গ রূপে পূজা করি। শিব লিঙ্গ হল অনন্তের প্রতীক। শিব লিঙ্গ কথার আক্ষরিক অর্থ মঙ্গলের প্রতীক ( সংস্কৃত শিব শব্দের অর্থ মঙ্গল : লিঙ্গম্ শব্দের অর্থ প্রতীক ) সৃষ্টি যখন ধ্বংস হয়ে যায় তখন থেকে যান শুধুই ধ্বংসের প্রতীক শিব কারণ তিনি অনন্ত।
ভারতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতি শিবের বন্দনা করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর স্বদেশ মন্ত্রে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, ” ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শংকর…” । ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দকে শিবের অংশ বলে মানতেন। আর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক শ্রীরাম শিব লিঙ্গ গড়ে পূজা করেছিলেন রামেশ্বরমের সমুদ্রতটে।
ভারতীয় সংস্কৃতি বিশ্বাস করে আজকের দিনে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে ভগবান মহাদেব এক স্বর্গীয় নৃত্য উপস্থাপন করেন যার তাৎপর্য ছিল সৃষ্টি, পালন আর লয়কে জগৎ বাসির কাছে তুলে ধরা। উপবাস রেখে তিনি এই ভুবন ভোলানো নৃত্য উপহার দেন। আর ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন জগৎ সংসারের সব জ্ঞান। তাই আজও সাড়া পৃথিবী জুড়ে মানুষ শিবরাত্রি ব্রত করার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে চায় সেই জ্ঞান কে যা অমৃত সমান।
আরেক মতে আজ সেই দিন যেদিন মিলন ঘটেছিল জগৎমাতা পার্বতী আর মহাদেবের। এই মিলন কোনো পার্থিব ঘটনা নয়। এই মিলন পুরুষ আর প্রকৃতির মিলন যা সৃষ্টি বীজের মন্ত্র, যা অনাদি কাল ধরে চলবে, যা অনন্ত। অনবদ্য এই সনাতন সংস্কৃতি যা পুরুষ আর নারী – সৃষ্টিতে উভয়ের সম অবদানকে স্বীকার করে। এখানে প্রথম পুরুষের পাঁজরের থেকে নারীর উৎপত্তি নয়: নারী, পুরুষ উভয়েই সৃষ্টি বীজ মন্ত্রের ধারক।
সবশেষে আসি পালন আর লয়ের সম্পর্কে, পালনের দেবতা শ্রীবিষ্ণু আর দেবাদিদেবের সম্পর্ক বিষয়ে । আমাদের বিশ্বাস শ্রীরাম হলেন শ্রী বিষ্ণুর অংশ। দুষ্টের ধমনীর উদ্দেশ্যেই তাঁর মনুষ্য জন্মগ্রহণ। সীতা উদ্ধারের জন্য তিনি তৈরি করিয়েছিলেন রাম সেতু যা তাঁর অপূর্ব পত্নীপ্রেমের নিদর্শন। সীতা সহ লঙ্কা থেকে ফিরে আসার সময় তিনি শিবলিঙ্গ তৈরি করে পূজা করেন দেবাদিদেব মহাদেবের। তাই এই স্থানের নাম রামেশ্বরম, অর্থাৎ সংস্কৃত রামেশ্বর। এই রামেশ্বর কথাটির দুটো অর্থ – প্রথম : প্রভু শ্রীরামের ঈশ্বর অর্থাৎ মহাদেব।
দ্বিতীয় : প্রভু শ্রীরাম যাঁর ঈশ্বর। এর অর্থও মহাদেব।
সবাইকে জানাই মহা শিব রাত্রির আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রণাম।