© স্বরূপ কুমার ধবল
গতকাল ছিল ১৬ই আগস্ট। ৭৮ বছর আগের ইতিহাস। অধিকাংশ হিন্দু হয়তো জানলোই না দিনটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান প্রজন্মের কাছে। তাই কফিনে বন্ধ এই ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন একান্ত প্রয়োজন। মুসলিম লীগ ও বামপন্থীদের যৌথ উদ্যোগে খোদ কলকাতার রাজপথ রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের পাতায় যা নিবদ্ধ ‘দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’, ‘ ডাইরেক্ট একশন ডে’, উইক অফ দ্যা লং নাইভস’ নামে। উদ্দেশ্য ইংরেজ ভারত ছাড়ার পূর্বে ভারত বিভাজন করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য আগে গঠন করতে হবে। মাস্টারমাইন্ড মুসলিম লীগের নেতা মোঃ আলি জিন্নাহ। রূপকার তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হুসেইন সুরাবর্দি। সহায়ক কমরেড জ্যোতি বসু, কমরেড যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, কমরেড বদরুদ্দীন উমর, মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাসিম, বিধানসভার সদস্য শেরিফ খান, কলকাতার মেয়র মিস্টার ওসমান, মৌলানা আক্রাম খান, আঞ্জুমান মহুফলুদ ইসলাম, হাবিবুর রহমান, বাংলার মুসলিম লীগের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আরও অনেকে।
কুখ্যাত ক্যালকাটা কিলিং কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছিল না। কয়েক সপ্তাহ ধরেই যার প্রস্তুতি চলছিল কলকাতার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও মহল্লাতে। নাখোদা মসজিদ যার এপিসেন্টার। ডাইরেক্ট একশনের স্লোগান ও বিবৃতি ছিল এই রকম- ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। এই স্লোগান আজও বামপন্থীদের কন্ঠে শোনা যায় তবে স্বাধীন ভারতে কোন আজাদি তারা চায় তা কেবল ঐ মুখোশধারীগুলোই জানে। মুসলমান জনতাকে উগ্র করে তোলার জন্য আবুল হালিম বলে, ‘যখন সুবিচার এবং সাম্যের পরাজয় হয়, তখন তরবারির দ্বারাই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়।’ নাজিমুদ্দিন বলেছিল, ‘মুসলিম লীগ ১৫০ টি উপায়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে পারে, এই বিষয়গুলি কিন্তু অহিংসা হবে না।’ সুরাবর্দি বলেছিল, ‘যদি এক মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রক্তপাত প্রয়োজন হয়, তাহলে তা করতেই হবে। আজ ভারতবর্ষের মুসলমানদের একমাত্র স্বপ্ন হল পাকিস্তান নামের একটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া। সেই স্বপ্নকে সফল করার জন্য আমরা সব রকম উপায় অবলম্বন করব।’ জিন্না বলেছিল, ‘আমরা অন্য কোন জাতির বশ্যতা স্বীকার করবো না।’ অথচ এই জিন্নার বাবা ছিল গুজরাটি হিন্দু ব্রাহ্মণ পুঞ্জলাল ঠক্কর।
কলকাতা মুসলিম লীগ সম্পাদক এস.এম. উসমান বলল, ‘এটি হলো রমজানের পবিত্র মাস, মক্কাকে আমরা এই সময় শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম। এই মাসেই মহান জেহাদ বা ক্রুসেডের আমরা আয়োজন করেছি।’
ইস্তাহার দেওয়া হল- ‘হে কাফেররা তোমাদের ভবিষ্যৎ স্তব্ধ হয়ে যাবে, এমন এক সংঘর্ষ দেখা দেবে, যার আগুন থেকে তোমরা রক্ষা পাবে না’, ‘ভারতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে’, ‘চলো চলো ময়দান চলো, হে আমার ইসলাম ভ্রাতৃবৃন্দ।’ ‘হিন্দুদের গণহত্যা করে তাদের জনসংখ্যা কমিয়ে দিতে হবে’, ‘সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে দিতে হবে।’ একজন মুসলমান পাঁচজন হিন্দুর মোকাবিলা করবে। ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মুসলিম লীগ তৈরি করে ফেলল কলকাতার হিন্দু নিধনের ব্লু প্রিন্ট। গেমপ্ল্যান অনুযায়ী তারিখ ঠিক হলো ১৮তম রমাদান ১৩৬৫ হিজরি জুম্মাবার (শুক্রবার), রমজান মাস; ইংরেজি ১৬ ই আগস্ট ১৯৪৬; স্বাধীনতার ঠিক আগের বছর। কলকাতার ২৪টি পুলিশ সদর দপ্তরের ২২টিতে হিন্দু অফিসারদের সরিয়ে মুসলমান অফিসার নিয়োগ করা হলো। বাংলা প্রদেশে ছুটি ঘোষণা করা হলো। রিপন স্কয়ারের রাস্তার রেলিং তুলে ধারালো সব অস্ত্র বানানো হলো। তিন-চারদিন ধরে হিন্দুর সমস্ত কিছুকে যাতে পুড়িয়ে ফেলা যায় বা ধ্বংস করা যায় তার জন্য কলকাতার মেয়র মিস্টার ওসমান নিজে মুসলমানদের পেট্রোল তোলার জন্য রেশনের কুপন বিলি করেছিল। রাজাবাজার, লালবাগান বস্তিতে অস্ত্রে শান দেওয়া শুরু হলো। ধর্মতলায় যত মুসলমান গুণ্ডা ও সমাজবিরোধীদের অন্য জায়গা থেকে এনে আশ্রয় দেওয়া হলো । ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে লরি লরি ইটের টুকরো এনে মজুত করা হলো। আট নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটে নাখোদা মসজিদকে অস্ত্রের ভান্ডারে পরিণত করা হলো । দাঙ্গাবাজদের যাতায়াতের জন্য আগাম গাড়ি ও লরির ব্যবস্থা রাখা হলো । বিভিন্ন অঞ্চলে তরবারি, লাঠি, ছুরি, রড, রিভলবার, বোমা, কেরোসিন, পেট্রোল, মেথিলেটেড স্পিরিট প্রতিটি মুসলমানের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানদের দোকানে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লিখে দেওয়া হল, যাতে সেগুলি আক্রমণের শিকার না হয়। এবার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে ১৬ ই আগস্ট হরতালের ডাক দেওয়া হল। দুপুরের নামাজ আদা করে দলে দলে মুসলমান এগিয়ে চলল অক্টারলোনি মনুমেন্টের পাদদেশে । অগণিত মুসলমানের জমায়েত হলো। মুসলিম লীগের সমস্ত নেতা উপস্থিত থাকলো। উপস্থিত হলো জ্যোতি বসুসহ উচ্চপদস্থ বামপন্থী নেতারা। বিকেল তিনটার সময় মুসলমানদের সমস্ত শোভাযাত্রা মনুমেন্টের নিচে এসে পৌঁছালো। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংসদীয় প্রধান তথা তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী জমায়েতে সভাপতিত্ব করল। তার উগ্র সম্প্রদায়িক বক্তৃতা জনতাকে কাফের বধে মারমুখী করে তুলল।
আমরা প্রতি বছর ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা উদযাপনে এতই মাতোয়ারা হয়ে থাকি যে ১৬ ই আগস্ট বিশ্ব ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় তথা ভয়ংকর হিন্দু জেনোসাইডের কাহিনি স্মরণ করে একটা মোমবাতি পর্যন্ত কেউ দিই না, কোন শোকসভা, কোন স্মরণসভা আয়োজন হয় না। এক নারকীয়, বিভৎস , রোমহর্ষক, পাশবিক হত্যালীলা ঘটে গেল , কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই হিন্দু নিধনযজ্ঞের ইতিহাস গোপন করে রাখা হলো । অধিকাংশ হিন্দু জানলই না খোদ কলকাতার শহরকে মুসলিম লীগ ভারতীয় বামপন্থীদের সাহায্যে নিয়ে কিভাবে শ্মশানে পরিণত করেছিল।
সুরাবর্দি, যিনি বাংলার সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করার পূর্বে বাংলার প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রধান ছিলেন সুরাবর্দি। তখন তাই তাকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না বলে প্রধানমন্ত্রী বলা হত। তিনি কিছু মুসলিম লীগ ও বামপন্থী নেতাকে সঙ্গে নিয়ে লালবাজার কন্ট্রোল রুমে পাকাপাকি চারদিন অবস্থান করলেন। সেখান থেকে হিন্দু হত্যার নির্দেশ ও চিরকুট পাঠিয়েছিলেন শহরের সর্বত্র। সুরাবর্দির নির্দেশে কার্যত পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। জেনারেল বুশার মন্তব্য করেছেন, ‘সুরাবর্দির মনোভাব পুরোপুরি সম্প্রদায়িক ছিল।’
১৬ ই আগস্ট এ ভোর সাড়ে চারটার সময় বেলিয়াঘাটাতে দুই বিহারী দুধওয়ালাকে (গোয়ালা) রাস্তার মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করে হিন্দু নিধন যজ্ঞের সূত্রপাত ঘটালো মাথায় ফেজ পরা মুসলমান দাঙ্গাবাজেরা। সদ্য ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের হিন্দু হত্যার ছবি বা ভিডিও দেখবেন, তাহলেই দুর্বৃত্ত মুসলমানদের ভয়ংকরতা আঁচ করতে পারবেন। তখন হাতে হাতে ক্যামেরা বা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ছিল না। তা না হলে সে দৃশ্য, ভয়ঙ্কর হত্যালীলা দেখতে পেতেন । উন্মত্ত মুসলিম জনতার মুখে ছিল ভারত বিরোধী ও হিন্দু বিরোধী স্লোগান, বর্তমানেও কমরেডদের মুখে সেই স্লোগান আজও শোনা যায় – ‘আজাদি ভাই আজাদি, লড়কে লেঙ্গে আজাদি।’
ধর্মোন্মাদ জনতা মাথায় টুপি পরে, হাতে তরবারি, লাঠি, রড, পেট্রোল, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একে একে মানিকতলা (সকাল ৭ঃ৩০ মিনিট) চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, বিডন স্ট্রিট, শিয়ালদহ, টেরিটি বাজার, চিৎপুর, রিপন স্ট্রিট, বউবাজার, মল্লিক বাজার, সেন্ট্রাল এভিনিউ, পার্ক স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রীট, বেহালা, বটতলা, দমদম, উত্তর কলকাতা, যুগিপাড়া, গড়পার, সার্কুলার রোড, নারকেল ডাঙ্গা, ষষ্ঠীতলা, মেটিয়াবুরুজ, মৌলালি, ধর্মতলা, বেঙ্গল ক্লাব, এন্টালি, এক কথায় সম্পূর্ণ কলকাতা শহরে উগ্র মুসলমান বাহিনী ‘নারায়ে তকবির’, ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে দিতে পথে-ঘাটে, রেস্তোরাঁ, ক্লাব, দোকান, বাজার, সিনেমা হল, ট্রাম ডিপো, বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, হিন্দু পাড়াতে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঢুকে নৃশংসভাবে হিন্দুদের হত্যা করতে লাগলো। মন্দির, বাড়ি, দোকান সব আগুন লাগিয়ে দিল। চললো হিন্দুর দোকানে, বাজারে, বাড়িতে বাড়িতে লুট- ভাঙচুর। মেয়েদের গণধর্ষণ করা হলো , ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারল। উলঙ্গ করে মেয়েদের রাস্তায় দৌড়ে নিয়ে গেল। মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে পালালো। শিয়ালদহের কাছে ভিক্টোরিয়া কলেজের জানালায় শিকে গেঁথে রাখা হয়েছিল চারটি মেয়েকে ধর্ষণ করে তাদের নিথর নগ্ন দেহকে, যাতে পথচারীরা তা দেখে ভয় পায়। (ভিক্টোরিয়া কলেজ- বর্তমানে সেখানে গেলে দেখতে পাবেন সেই জানালাগুলো ইট দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছে), হিন্দু মেয়েদের নগ্ন করে রাস্তায় ঝুলিয়ে দিল- সে কথা জানিয়েছেন খোদ পুলিশের কর্মকর্তা গোলকবিহারী মজুমদার। কমিউনিস্ট টেক্সটাইল ইউনিয়নের নেতা সৈয়দ আব্দুল্লাহ ফারুকী এবং কট্টরপন্থী এলিয়ান মিস্ত্রীর নেতৃত্বে ওড়িয়া হিন্দু শ্রমিক, লিচু বাগানের বস্তিতে থাকা ৭০০ থেকে ৮০০ হিন্দুকে পাশবিকভাবে মেরে ফেলা হলো। যে সমস্ত হিন্দুকে প্রতিবেশী মুসলমান রক্ষা করবো বলে আশ্বস্ত করেছিল তারাই আবার উন্মত্ত জনতার হাতে তাদের তুলে দিল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আক্রাম খান মৃগেন্দ্রলাল মিত্র রোডে তার প্রতিবেশী মিস্টার বি.কে. রায় সহ তার পরিবারের সমস্ত সদস্যকে মুসলমান জনতার হাতে তুলে দেন। তার চোখের সামনে হত্যা করলো, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে তা দেখছিল। অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়ি দরজা ভেঙ্গে লুট করা হলো । বিখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, নাতি কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচে। রাজা দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক ও কুমার কার্তিকচন্দ্র মল্লিক এর অগাধ ধন-সম্পত্তি লুট করে নিল। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র আনন্দীলাল পোদ্দারের বিপুল ধনরাশি লুট করল। পুলীন সেনকে হত্যা করল। বস্তির পর হিন্দু বস্তি আগুন ধরিয়ে রক্তগঙ্গা বহিয়ে দিল। হিন্দুরা বেশিরভাগ পালিয়ে বা কোন রকমে আত্মগোপন করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করল। প্রশাসন মুসলমানের, মুখ্যমন্ত্রী মুসলমান, মেয়র মুসলমান, ২৪টির মধ্যে ২২টি থানার ইনচার্জ মুসলমান। মদের দোকান সমর্থনকারীরা মুসলমানের তৈলবাজ কমিউনিস্ট । সুতরাং সাধারণ হিন্দুর বাঁচার কোন উপায় ছিল না। এই নারকীয় ঘটনাকে জিন্না বলেছিল- ‘আজ আমরা যা করেছি তা আমাদের ইতিহাসে বীরত্বপূর্ণ কাজ।’ এই বীরত্বপূর্ণ কাজে সভ্যের মুখোশধারী পান্ডিত্যের ফাঁপা মুখোশধারী মেকি সেকুলারিজমের পুজারী CPI(M), সর্বপ্রকারে মুসলমানকে সাহায্য করেছিল এই হত্যালীলায়। ৯০% মুসলমান তো চিরকাল হিন্দুর বিরোধী কিন্তু তার থেকেও হিন্দুর জন্য বেশি মারাত্মক হলো ভারতীয় কমিউনিস্টরা। দেশের সর্বত্র আজও তারা স্বদেশ,স্বজাতি , স্বসংস্কৃতি ও হিন্দু বিরোধীতায় সোচ্চার। এই ঘটনাতে পুলিশ প্রধান জানিয়েছিলেন – ‘কত হাজার হাজার হিন্দু তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন এবং কত হিন্দু রমণীকে ধর্ষণ বা হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে আমার কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই।’ লিওনার্ড মসলে তাঁর ‘The Last Days Of The British Raj’ (page-11) গ্রন্থে বলেছেন এই ঘৃণ্য এবং ভয়ঙ্করতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতের ভাগ্য সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ভারত ইতিহাসের ধারাপাতেই ছিল। চৌরঙ্গি স্কয়ারের চারপাশে শায়িত আছে পুরুষ, নারী এবং অসংখ্য শিশুর শবদেহ। আকাশে শকুন উড়ছে।… দেড়শো বছরের প্রয়াস আজ ফলপ্রসূ হল।’ তৈমুর লঙ ও নাদির শাহের হিন্দু নিধনের থেকে কোন অংশেই ভয়ংকরতা কম ছিল না এই কুখ্যাত গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং (১৯৪৬ ; ১৬ -২০ আগস্ট)। নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন- “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ।”
এর কোন অস্তিত্ব বাস্তবের সঙ্গে আমরা ভারত ইতিহাসে লক্ষ্য করিনি। মুসলমান ভারতবর্ষকে কোনদিনই নিজের দেশ বলে ভাবে না অতীত ও বর্তমান ইতিহাস তাই বলছে।
তিন দিন চরম হিন্দু নিধন ও মা-বোনেদের উপর অত্যাচার দেখে থাকতে না পেরে বিপ্লবী অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা তাঁর কুস্তি আখড়ার ছেলেদের জড়ো করে এবং প্রায় ৮০০ জন হিন্দুত্ববাদী পুরুষকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যোগ দেন যুগল ঘোষ ও বিজয় সিং এর মতো হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তিরা। পরে দলে দলে হিন্দু তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কলকাতা হিন্দু ব্যবসায়ী ও মাড়োয়ারিরা অর্থের ও অস্ত্রের যোগান দিতে থাকে। কাপুরুষ কনভার্টেড মুসলমান আর খিস্তিবাজ হিজড়া কমিউনিস্টদের দু’দিন ধরে এমন কচুকাটা করা হলো যে কবর দেবার লোক এবং জায়গা উভয়েরই অভাব দেখা গেছল। গোপাল পাঁঠার সেই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস কংগ্রেস ও বামপন্থীরা কোনদিন আমাদের জানতে দেয়নি। দালাল স্বার্থবাজ কংগ্রেস এতদিন হিন্দু নিধনে চুপ করে মজা নিচ্ছিল। যেই মুসলমানকে প্রতিআক্রমণ করে কোণঠেসা করে দিল, তার কিছু দিনের মধ্যে কলকাতায় ছুটে এলেন মুসলমানদের জাতির জনক তাদের প্রিয় বাপুজী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বেলেঘাটায় শিবির বসলো। গোপাল পাঁঠা’কে ডেকে তাকে অস্ত্র ত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দিলেন । গোপাল পাঁঠা জানিয়ে দিল, আমার মা- বোনকে রক্ষা করার জন্য একটা সূঁচও যদি আমার কাছে থাকে সেটাও দেবো না। প্রণাম নেবেন। গান্ধীজীর সঙ্গে গোপালের কথোপকথনের দোভাষী ছিলেন প্রফেসর নির্মল বোস। অহিংসা পরম ধর্ম এই পথ তাকে শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। পাঁঠা গান্ধীকে সেদিন বুঝিয়ে দিলেন বাপুজী আমাকে ধর্ম শিক্ষা দিতে এসো না, আমার নাম গোপাল- ‘অহিংসা পরম ধর্ম, ধর্ম হিংসা তথৈ ব চ।’
শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন-
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।/অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।।”
গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতি রইল অনেক অনেক শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রণাম ও কৃতজ্ঞতা।