© ওসমান মল্লিক
ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠের আসর বসেছিল। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। এর আগে সি পি এম, তৃণমূল, এস ইউ সি, আই এস এফ দের ডাকা ব্রিগেডে গিয়েছি। চেষ্টা করেছি তাদের বক্তব্য বোঝার। বিশেষ করে এরকম একটি দিনে বাঙলার বিভিন্ন জেলার লোকেদেরকে এক সাথে পাওয়া যায়। চিন্তার আদান প্রদান ঘটানো যায়। আমি প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে অবিশ্বাসী লোক হলেও আমার মধ্যে কোনো ছুঁতমার্গ নেই। রামকৃষ্ণ মিশন, ইস্কন এমন কী ফুরফুরা শরীফেও আমি গিয়েছি – অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। জ্ঞান অর্জনের জন্য। লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য। নিজের ইচ্ছেতে গিয়েছি। আমন্ত্রিত হিসেবে নয়।
গীতাপাঠের উদ্যোক্তারা নজরুলের লেখা গান দিয়েই অনুষ্ঠান সূচনা করলেন। এটা তাঁদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচায়ক। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো ঈদের অনুষ্ঠান নজরুল সংগীত বা রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে শুরু হয়েছে তা আমি দেখিনি এবং ভবিষ্যতেও যে হবে – তা আমার ভাবনার বাইরে। পাশেই রেড রোডে ফি বছর ঈদের জামাত হয়। সেখানে কারো রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুল সংগীত বাজানোর হিম্মৎ হবে বলে মনে হয়না।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, বৌদ্ধিক ও সমাজ জীবনে গীতার একটি বড় প্রভাব আছে। ছাত্র অবস্থায় আমি সুভাষ চন্দ্রের ‘ তরুনের স্বপ্ন ‘ বইটি পড়ি। সেখানে সুভাষ চন্দ্র ছাত্রদের গীতা পড়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা গীতা হাতে করে সসস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ও ফাঁসির দড়িকে আলিঙ্গন করতেন। গান্ধীজি গীতা সঙ্গে করে অহিংস সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র গীতার দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত ছিলেন। বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার উপর গীতার প্রভাব অনেকেরই জানা।
গীতার বিখ্যাত উক্তি – কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরোনা। এই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে এই বিতর্ক অনেকেটা জায়গা পেয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত, অর্জুন যখন আসন্ন যুদ্ধে আত্মীয় বিয়োগের উৎকণ্ঠায় পীড়িত, অর্জুন যখন বীরের ধর্ম পালনে সংশয়াবিষ্ট – ঠিক তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বীরের ধর্ম কী? আত্মীয় কারা? শোক করার যথার্থতা কোথায়? ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের আবশ্যিকতা ও অপরিহার্যতা কেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বলতে থাকেন। দুজনের মধ্যে বেশ তর্ক বিতর্ক হয়। তর্ক বিতর্কের শেষে অর্জুন যুদ্ধের অপরিহার্যতা মেনে নেন। নিজের সংশয় কাটিয়ে উঠেন। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দেন। যে ধর্ম পথে থাকে বা ন্যায়ের পক্ষে থাকে সেই আত্মীয় -এই তত্ত্ব মেনে নেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ যে আবশ্যক – তা অন্তর থেকে উপলব্ধি করেন ও বীরের ধর্ম পালনে এগিয়ে আসেন। কৃষ্ণ তাঁর সারথি হন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীরা ও অহিংসবাদীরা দুপক্ষই গীতা থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন এমন কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হল যাতে করে এভাবে গীতা পাঠের অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে?
অল্পবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝলাম- তারা একটি আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাদের আশংকা পশ্চিমবঙ্গে আর তারা বেশিদিন নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে থাকতে পারবে না। অচিরেই পশ্চিমবঙ্গে ইসলামীকরণ সম্পূর্ণ হবে। তখন একদিন যেমন তাদের পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল এবারেও তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাদের একজন একটি ভিডিও পোস্ট দেখালো। সেখানে রাজ্যের মন্ত্রী বলছেন – ইনশাআল্লাহ একদিন পশ্চিমবঙ্গে ৫০% এর বেশি লোক উর্দু বলবে। তবে বাঙালি যাবে কোথায়?
আমার নিজের উপলব্ধি, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজ ধীরে ধীরে আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রধান কারন তারা মনে করছে আগামী বিশ বছরের মধ্যেই তারা পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। মুসলিমদের মধ্যে জন্মহার অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের তুলনায় উচ্চ হওয়ার জন্য যে কোনো স্থানের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তার উপরে হিজাব, বোরখার প্রচলন যেভাবে বাড়ছে তা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। মুসলমান সমাজের সংস্কার হলে এসব কোনো কিছুই ফ্যাক্টর হত না। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলমান সমাজের একই অবস্থা। যারফলে বিশ্বজুড়েই এখন একটি আন্টি মুসলিম পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে। এর জন্য অবশ্য মুসলিম জনগোষ্ঠীই দায়ী। তারা সংস্কার বিমুখ।
বামেরা মৌলবাদী মুসলিমদের পক্ষ নিচ্ছে। তারা ফুরফুরা শরীফের আব্বাস কে সঙ্গে নেবে। ইউ সি সি র বিরোধিতা করবে। তারা শরিয়া আইন সমর্থন করবে। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষ নিতে তাদের আপত্তি। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যম ও হিজাব বোরখাকে সমর্থন করছে। জনবিস্ফোরণ ও ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন নিয়ে চুপ। এমতাবস্থায়, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজ ভাবছে তাদের হয়ে বলার কেউ নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিকে তারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরিস্থিতি মনে করছে। কৃষ্ণই তাদের সহায়। গীতাই তাদের অবলম্বন।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)