© শ্রী রঞ্জন কুমার দে
দ্যা কাশ্মীর ফাইলস্-এর ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর ‘দ্যা কেরল স্টোরি’ বলিউড ডিঙিয়ে রাজনৈতিক তরজার মারপ্যাঁচে। সিনেমাটির নির্মাতা সুদীপ্ত সেন কেরল রাজ্যের হিন্দু ও খ্রিস্টান যুবতী ,মহিলাদের ধর্মান্তকরণের নির্মম পরিহাস এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইরাক সিরিয়ার সঙ্গে কেরলের ধর্মান্তকরণের যোগসূত্র চিত্র ফুঁটিয়ে তুলেছেন।
যুবতীদের নেশাজাতীয় দ্রব্যের অভ্যাসজাত, ব্রেনওয়াস, ধর্মান্তকরণ, টানাধর্ষণ, মানবপ্রচার, বলপূর্বক গর্ভপাতের প্ৰতীচ্ছবি দ্যা কেরল স্টোরি।তাঁদের প্রসব হওয়া সন্তানদের কেড়ে নিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী রূপে তৈয়ার করা হয়েছে। কেরলের প্রায় ৩২ হাজার যুবতী মহিলা নিখোঁজের পর জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তকরণ এবং অতঃপর আইএসসাইএসে নিয়োগ করা হয়, ফাতেমা নামে একজন মালয়লি নার্সের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সেখানে যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আদাহা শর্মা। সিনেমাটি রিলিজ হওয়ার নিত্যদিন একেকটা সাফল্য স্পর্শ করছে, নেটিজেনরা এই প্রদর্শনীটিকে সাহসী, নিরপেক্ষ এবং অপ্রতিরোধ্য আখ্যায়িত করেছেন ,অনেকে আবার সমালোচনাও করছেন। চিত্রনির্মাতার দাবি প্রযোজনাটি একটি দীর্ঘ গবেষণামূলক এবং লুকায়িত নির্মম কালো অধ্যায়ের উন্মোচন। দ্যা কাশ্মীর ফাইল্সের মতো স্বভাবতই বামপন্থী সংগঠন হাত ধুয়ে ‘দ্যা কেরলা স্টোরি’-কে নিষিদ্ধ করতে মাঠে নেমে পড়েছে। কেরল ইউনিটের রাজ্যসভা সংসদ জন ব্রিটাস ইতিমধ্যে স্বররাস্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সিনেমাটির ট্রিজার বন্ধে আবেদন জানিয়ে আসছিলেন। জেএনইউ এর এসএফআই ইউনিটও আপত্তি জানিয়ে আসছিলো কিন্তু ক্যাম্পাসে ছবিটির প্রিমিয়াম খুব ধুমধাম উৎসাহ উদ্দীপনায় পরিবেশন হয়। কেরলের শাসক সিপিএম এবং প্রধান বিরোধী কংগ্রেস ইসুটিতে হাত মিলিয়ে সিনেমাটিকে মিথ্যা ,আরএসএসের এজেন্ডা আখ্যায়িত করেছে। সিনেমাটির ট্রেলার রিলিজের পর থেকেই কংগ্রেস বামপ্রন্থীরা অভিযোগ করে আসছিলেন সিনেমায় কেরলকে সন্ত্রাসীদের মুক্ত রাজ্যে পরিবেশন করা হয়েছে যাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ঘৃণা ছড়ানো ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণীত তকমায় তাহারা ছবিটির মুক্তি আটকাতে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কলকাঠি নাড়ায়,মহামান্য কোর্ট তাঁদের রায়ে জানান যে দ্যা কেরল স্টোরির নিষিদ্ধ করার কোন প্রয়োজন নেই।
আজকের দিনে সিনেমা “দ্যা কেরল স্টোরি” কেরল, লাভ জেহাদ ও ইসলামিক আতংকবাদের নগ্ন চিত্র উন্মোচন করলেও অনেক আগের থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেরলের সাথে ইসলামিক স্টেটের যোগসূত্র প্রকাশিত হয়ে আসছে।কেরলে আইএসআইএস এবং কট্টর ইসলামিক নিষিদ্ধ সংগঠন পিএফআই’র ছিলো খোলা বিচরণ ভূমি।মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট শিরোনামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬৬ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত যোদ্ধা আইএসআইএস এর সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ২০১৯ সালে রাজ্যে স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি সংসদের এক প্রশ্নোত্তরে জবাব দিয়েছিলেন এনআইএ এবং রাজ্যে পুলিশ বাহিনী আইএসইএসের সাথে সংশ্লিষ্ট পুরো দেশ জুড়ে এমন ১৫৫ জনকে গ্রেফতার করেছে যাহার অধিকাংশই কেরল কানেকশন ছিলো। আইএসআইএস দীর্ঘকাল থেকেই ভারতকে তাদের তথাকথিত “খোরাসান খিলাফথের” অংশ হিসেবে দেখে এসেছে, যেমনটা ভারতকে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা গজবা হিন্দের অংশ হিসেবে কল্পনা করে। সন্ত্রাসবাদী এই সংগঠন প্রথম ২০১৩ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসে যখন সিরিয়ায় ভারতীয়রা আইএসআইএসে যুদ্ধার কাজে নিযুক্ত থাকার পোক্ত প্রমাণ আসে। ২০১৬ সালে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক রিপোর্টনুসারে কোঝিকড় এবং মালাপ্পুরমের দুইটি স্বীকৃত ধর্মীয় ধর্মান্তর কেন্দ্র ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ৬০০০ জনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছে ,যাদের মধ্যে ৪৯১৯ জন হিন্দু এবং বাকি ১০৭৪ জন ক্রিস্টান।উল্লেখ্য যে ধর্মান্তরিতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী যাদের বয়স ছিলো গড়ে ৩৫ বৎসরের নীচে। তাই চিত্র নির্মাতা বারংবার দাবি করে আসছেন সিনেমাটি কোন কাল্পনিক কাহিনীর নয় বরং প্রত্যেকটি চরিত্র ,সংলাপ সত্য ঘটনা অবলম্বনে। সিনেমাটির কয়েকটি সংলাপ ও দৃশ্য খুবই হৃদয় বিদারক,নির্মম ও ভয়ানকও বটে।সিনেমাটির একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে এক মৌলানা নির্দেশ দিচ্ছে অমুসলিম মেয়েদের সংস্পর্শে নিয়ে এসো, ওদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক বানাও,প্রয়োজন হলে ওদের গর্ভবতী বানিয়ে দাও। আরেকটি দৃশ্যে এমন যে তিন হিন্দু যুবতী তাদের এক মুসলিম বান্ধবীর সাথে বসে খাওয়ার খাচ্ছে।সেখানে ঐ মুসলিম বান্ধবীটা ওদের জিজ্ঞেস করে তোমরা কোন ভগবানের ইবাদত করো। তাহারা সরল মনে শিব ভগবানের নাম জানায়।তখন মুসলিম মেয়েটা বলে উঠে যে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে সাধারণ মানুষের মতো কান্না করে তাহলে সে কিভাবে ভগবান হতে পারে!এরপরে দেখা যায় হিন্দু যুবতীদের সাথে অভদ্র আচরণ করা হচ্ছে, তখন ঐ মুসলিম বান্ধবীটা তিনো হিন্দু যুবতীদের এই বলে ব্রেইন ওয়াশ করছে যে হিজাব পরিহিতা মেয়ের সাথে কোন ধর্ষণজনিত ঘটনা হয় না বা কেউ তাদের ইভটিজিংও করে না, স্বয়ং আল্লাহ তাদেরকে সুরক্ষা করেন। সিনেমাটির এক চরিত্রের সংলাপ এরকম ছিলো যে,”আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন যে আগামী ২০ বৎসরে কেরল এক ইসলামিক স্টেটে রূপান্তরিত হবে। “যদিও পরবর্তীতে কোর্টের নির্দেশে অংশটি ছেঁটে ফেলা হয়। প্রধান চরিত্র হিন্দু সংস্কারি যুবতী শালিনী কৃষ্ণনের ব্রেইন ওয়াশ করে তাহাকে ফাতেমা বানানো হয়ে থাকে। অতঃপর বিয়া এবং শেষ পরিণতি আইএসআইএস ক্যাম্পে যৌনদাসীর জীবন।এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে লাভ জেহাদের ভয়ঙ্কর মডিউল কেরলে কাজ করছে।
সম্ভবত এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোদি কোন চলচ্চিত্রের প্রশংসা কোন রাজনৈতিক রেলিতে সর্বজনীনভাবে করেছেন, সেই সঙ্গে কংগ্রেস সহ বিরোধীঘোটকে সিনেমাটির বিরোধিতা করার জন্য ঘোর নিন্দাও করেছেন। স্বভাবতই দেশের অন্যতম মুসলিম সংগঠন জমিয়ত উলেমা এ-হিন্দ সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন আবেদন করে জানায় যে সিনেমাটি মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ করে মুসলিম যুবকদের জন্য অনমাননাকর।অবশ্য সর্বোচ্চ আদালত সেই আর্জি কোন অবস্থাতেই মঞ্জুর না করে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন।বাম কংগ্রেস কেরল হাইকোর্টে সিনেমাটি বন্ধের আর্জি করলে কোর্ট সাফ জানিয়ে দেয় যে সিনেমাটিতে বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এমন আপত্তিকর কিছু নেই, সিনেমাটিতে শুধু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসইএসের বিরুদ্ধে। আদালত আরো জানায় যে, “বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে কিছু আছে। তাদের শৈল্পিক স্বাধীনতা আছে, আমাদের সেটাও ভারসাম্য রাখতে হবে”।
কেরল হাইকোর্ট আরো উপলব্ধি করতে পারে যে আবেদনকারীর কেউই সিনেমাটি আদতে দেখেনই নি। অবশ্য কোর্ট সিনেমাটির কর্তৃপক্ষদের ৩২০০০ সংখ্যার মহিলাদের কেরল থেকে আইএসইএসে যোগদানের অংশটি তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার অংশ থেকে সরিয়ে দিতে নির্দেশ জানায়।পরিচালক কোর্টের আদেশ যতাযত পালন করে জানান যে, ২০১০ সালে তৎকালীন কেরলের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চান্দি বিধানসভায় স্বীকার করেছিলেন প্রতি বৎসর আনুমানিক ২৮০০-৩২০০ মেয়েরা ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। সেই হিসেবে আজকের দিন পর্যন্ত হিসেব করলে সংখ্যাটা সহজেই ৩২০০০ সংখ্যা পার করে দিচ্ছে।সিনেমাটি বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে ট্যাক্স ফ্রি হলেও তামিলনাড়ুর সিনেমা থিয়েটার ওনার্স এসোসিয়েশনের সিদ্ধান্তনুযায়ী সিনেমাটি তাদের হল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিলো।
একমাত্র মমতা সরকার দ্যা কেরালা স্টোরি সিনেমাটিকে এই অজুহাতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন যে সিনেমাটির কিছু দৃশ্য রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য বিপদজনক। অথচ উনিই পদ্মাবতী সিনেমা বিতর্কে বলেছিলেন এই বিতর্ক শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, নিজেদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নষ্ট করার জন্য অরাজনৈতিক দলের একটি সুপরিকল্পনাও বটে।দ্যা কেরালা স্টোরি মাত্র একসপ্তাহে ১০০ কোটির ক্লাবে পৌঁছে নিজেদের সত্যতার দলিল আরেকবার পেশ করলো এবং দর্শক নীরবে কেরলের ধর্মান্তকরণের কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে রইলো।