© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পাঞ্চভৌতিক দেহ ছেড়ে চলে যান, কিন্তু অনন্তকালের জন্যে আশ্রয় নেন সকলের হৃদয়ের মাঝে।আধুনিক হিন্দুর বৈশ্বিক মননে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান অনন্য।গুরুভাই স্বামী অভেদানন্দকে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর মৃত্যুর বছর পাঁচ ছয়েক আগে বলেছিলেন,“আমি আর বছর পাঁচ ছয়েক বাঁচবো বুঝলে।” অভেদানন্দ স্বামীজির এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে বেশ বিরক্ত হয়। অভেদানন্দের মনের অবস্থা বুঝে স্বামীজীর উত্তর,“তুমি বুঝবে না হে , তুমি বুঝবে না। আমার আত্মা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে। এত বড় হয়ে যাচ্ছে যে, তা আর আমার এই শরীরের মধ্যে তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। খালি ছেড়ে পালাতে চাইছে।”
বেদান্ত দর্শনে, জীবসত্তা পঞ্চ আবরণে আচ্ছাদিত, তাকে পঞ্চকোষ বলে: অন্নময়কোষ,প্রাণময়কোষ, মনোময়কোষ,বিজ্ঞানময়কোষ, আনন্দময়কোষ।
অন্নময়কোষ: অন্ন দ্বারা গঠিত, অন্ন দ্বারা পালিত, অন্নেই সংরক্ষিত।বেদের তৈত্তিরীয় উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি আছে:
অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। অন্নাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। অন্নেন জাতানি জীবন্তি।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, ২)
“অন্নই ব্রহ্ম। অন্ন থেকেই সকল প্রাণীর উৎপত্তি এবং অন্নতেই সবাই বেঁচে থাকে।”
প্রাণময়কোষ:বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ এ পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং প্রাণ, অপান, উদান, সমান, ব্যান এ পঞ্চপ্রাণ বা বায়ুকেই প্রাণময়কোষ বলে।
মনোময়কোষ:চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহ্বা এ পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাথে মনকে সম্মিলিত ভাবে মনময়কোষ বলে।
বিজ্ঞানময়কোষ:চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহ্বা এ পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাথে বুদ্ধিকে সম্মিলিত ভাবে
বিজ্ঞানময়কোষ বলে।মনোময়কোষ ও বিজ্ঞানময়কোষ এ উভয় স্থানেই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় অবস্থিতি থাকে।
আনন্দময়কোষ: সর্বদা আনন্দময় সত্তায় পরিপূর্ণ কারণ শরীর। এ কোষটি কারণশরীর, স্থূলশরীর এবং সূক্ষ্মশরীরের লয়স্থান।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন তাঁর আত্মা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে। এত বড় হয়ে যাচ্ছে যে, তাঁর স্থূলশরীরের মধ্যে তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। খালি ছেড়ে পালাতে চাইছে। কথাগুলোর সত্যটা আমরা আমাদের শাস্ত্রেও দেখি, মাতৃগর্ভে জন্ম নেয়া আমাদের স্থূলশরীর অন্নে উৎপন্ন এবং অন্নে পালিত। সাধনার ফলে সাধকের আস্তে আস্তে যখন উত্তরণ ঘটে তখন বিজ্ঞানময় কোষ এবং আনন্দময় কোষ স্ফীত হতে থাকে। ঠিক তখনই আর দেহ বা অন্নময় কোষ ভেতরের বৃহৎ সত্ত্বাটিকে বহন করতে পারে না। তখন সাধক জীবন্মুক্ত বা গীতার অনুসারে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়, এরপরে যখন সে দেহত্যাগ করেন তখন তাকে বলে বিদেহমুক্তি। একারণেই দেখা যায় শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীজ্ঞানেশ্বর, শ্রীচৈতন্যদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ সহ অনেক সাধক মহাপুরুষেরাই পঞ্চাশ বছর আয়ুষ্কালের মধ্যেই দেহত্যাগ করেছেন।
মানুষের দেহের ক্ষয়, দেহের বৃদ্ধি খালি চোখে দেখা যায়, কিন্তু অন্তঃকরণের ভেতরের বিজ্ঞানময় আনন্দময় কোষের বৃদ্ধি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়; শুধু সাধকই টের পান অতীন্দ্রিয় জগতের। আনন্দময় কোষের পরিমাণটা একবার যদি বাড়তে থাকে তবে বাড়তেই থাকে। দেহ তখন কোনমতেই ভেতরের ভাবস্তুকে যাকে চোখে দেখা যায় না, তাকে বহন করতে পারে না। শরীরে তখন বিভিন্ন প্রকারের ভাবের বিকার দেখা যায়। সাধকের আচরণে তখন উন্মত্ততাও পরিলক্ষিত হয়।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই, স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণের দিনে স্বামীজী খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলেন। উঠেই বেলুড় মঠের প্রার্থনা গৃহে তিন ঘণ্টা ধ্যান করেন। এরপর মঠের ছাত্রদের শুক্লযজুর্বেদ, সংস্কৃত ব্যকরণ ও যোগদর্শনের উপরে ক্লাস নেন। পরে শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। উভয়ে গল্প করতে করতে মঠের বাইরে বেলুড় বাজার পর্যন্ত যান। স্বামী প্রেমানন্দের সাথে রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যত্ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করেন। সে আলোচনায় বিশেষ করে একটি বৈদিক বিদ্যালয় তৈরি করে বেদ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বলেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বামী প্রেমানন্দ প্রশ্ন করেন, “স্বামিজী!বেদপাঠে কি উপকার সাধিত হইবে?” স্বামীজী তৎক্ষণাৎ স্বল্প কথায় উত্তর দিলেন, “অন্ততঃ ইহা অনেক কুসংস্কার বিনষ্ট করিবে।”সেদিন বেলুড় মঠের ঘাটে জেলেদের মাছের নৌকা ভিড়েছিল। নৌকা থেকে স্বামীজীর নির্দেশে গঙ্গার ইলিশ মাছ কেনা হয়। স্বামীজী সেই ইলিশ মাছ দিয়ে তৈরি ঝোল, ভাজা, অম্বলের বিভিন্ন সুস্বাদু পদ সবার সঙ্গে বসে দুপুরে খান। সারাদিন তাঁকে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হচ্ছিল। কিছু সময় শ্যামাসংগীতও করেন। পূর্বে অসুস্থতা থাকলেও, সেদিন তাঁর অসুস্থতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না। সন্ধ্যার পরেই দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান। বলে যান, এখন যেন কেউ তাঁকে বিরক্ত না করে। ঘরে গিয়ে ধ্যানে বসেন ।
স্বামীজী চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন। রাত্রি ৯.০০ দিকে একটু বামপাশে ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাঁর ডান হাত সামান্য কাঁপল। স্বামীজীর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম দেখা দিল। রাত্রি ৯.০২ থেকে ৯.১০ গভীর এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই পরে আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস, একটু নড়ে উঠে মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।এ অবস্থাতেই সহস্রার ভেদ করে আনন্দলোকে যাত্রা করে বিদেহমুক্তি লাভ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর প্রিয় গানের ভাষায় বলতে গেলে, সংসাররূপ বিদেশে তিনি আর কতকাল থাকবেন, চলে গেলেন আপন নিকেতনে।
“মন চলো নিজ নিকেতনে
সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে
ভ্রম কেন অকারণে
মন চলো নিজ নিকেতনে।”
স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবসানের ঘটনাবলীর এক প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীচন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়ের বিষাদময় স্মৃতিচারণ পাওয়া যায়। এ স্মৃতিচারণটি বিশ্ববাণী পত্রিকায় ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় ছাপা হয়। এ স্মৃতিচারণটি উপন্যাসিক শংকর তাঁর ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন:
“তখন সামান্য বৃষ্টিপাত হইতেছিল। দেখিলাম পশ্চিম দিকে নীচেকার ছোট দালানে (বারান্দায়) পূজ্যপাদ শ্রীরাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ কয়েক জন সন্ন্যাসী একখানি সুন্দর খাটে পুষ্পশয্যা রচনায় রত। আমাদের দেখিয়া শ্রীরাখাল মহারাজ কাঁদিয়া ফেলিলেন, তাঁহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না—সিঁড়ির দিক দেখাইয়া উপরে যাইতে ইঙ্গিত করিলেন।
স্বামীজির ঘরে যাইয়া দেখিলাম—একখানি সুন্দর গালিচার উপর শয়ান তাঁহার দিব্যভাবদীপ্ত দেহ বিভূতি-বিভূষিত, মস্তক পুষ্প-কিরীট ভূষণে এবং সর্বাঙ্গ নবরঞ্জিত গৈরিকবসনে সুসজ্জিত ; প্রসারিত দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি জড়িত এবং ধ্যানমগ্ন মহাদেবের ন্যায় অক্ষিতারা অন্তর্মুখী ও অৰ্দ্ধনিমীলিত—দুই পার্শ্বে ধূপদানি হইতে ধূপের মধুর সৌরভে তাঁহার ঘরটি আমোদিত।
স্বামীজির বামদিকে ভগিনী নিবেদিতা অশ্রুপূর্ণনেত্রে বসিয়া হাত-পাখার দ্বারা স্বামীজির মাথায় অনবরত বাতাস করিতেছেন আর অজস্র অশ্রুধারা তাঁহার গণ্ডদেশ বহিয়া ঝরিতেছে। স্বামীজির মস্তকটি পশ্চিমদিকে এবং দুখানি পা পূর্বদিকে গঙ্গাভিমুখে স্থাপিত। তাঁহার পদপ্রান্তে নন্দলাল ব্রহ্মচারী বিষাদ মৌনমুখে নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। আমরা তিনজনে মস্তক অবনত করিয়া স্বামীজির পাদপদ্ম স্পর্শ ও প্রণাম করিয়া সেখানে বসিলাম। স্পর্শ করিয়া অনুভব করিলাম স্বামীজির দেহ বরফের মতনই ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। স্বামীজির দক্ষিণকরের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে কলিকাতা এবং অন্যান্য স্থান হইতে সমাগত বহু ভদ্রলোক এবং ভক্ত উপরের ঘরে আসিয়া স্বামীজিকে শেষ দর্শন এবং প্রণামাদি করিয়া একে একে চলিয়া গেলেন—রহিলাম কেবল আমরা তিনজন, ব্রহ্মচারী নন্দদুলাল এবং ভগিনী নিবেদিতা।
আমার জপ সাঙ্গ হইলে, ভগিনী নিবেদিতা আমাকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন: “Can you sing, my friend? Would you mind singing those songs which our Thakur used to sing?” ওই বিষয়ে আমার অক্ষমতা জানাইলে, ভগিনী পুনরায় অনুরোধ করেন : “Will you please request your friend on my behalf?”
তখন বন্ধু নিবারণচন্দ্র সুমধুর স্বরে কয়েকখানি গান প্রাণ খুলিয়া গাহিতে লাগিলেন : ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, ‘গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়’, ‘কে বলে শ্যামা আমার কালো, মা যদি কালো তবে কেন আমার হৃদয় করে আলো’, ‘মজলো আমার মন ভ্রমরা, শ্যামাপদ নীলকমলে’, ‘মন আমার কালী কালী বলনা, কালী কালী বললে পরে, কালের ভয় আর রবে না’ ইত্যাদি।…
বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) দোতলায় স্বামীজির ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে এবং ব্রহ্মচারীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন : “বাবা! স্বামীজি চলে যাওয়াতে আমরা ভেঙে পড়েছি— আমাদের বল টুটে গেছে। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি?”
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহী ভক্ত এবং উক্ত নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজির দেহখানি বহন করিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া নীচের দালানে পুষ্পসজ্জিত পালঙ্কের উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে গোটাকতক বেদানা, আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, স্বামীজির বক্ষের উপরে সাজাইয়া দেওয়া হইল। তখন বুড়ো গোপাল দাদা (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) ব্রহ্মচারীজিকে বলিলেন : ‘ওরে নন্দলাল! আমাদের সকলের চেয়ে স্বামীজি তোকেই বেশি ভালোবাসিতেন। আজ তাঁর শেষ পূজা তোর হাতেই হোক্।’
এই প্রস্তাব শ্রীমৎ রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ সাধুবৃন্দ অনুমোদন করাতে, নন্দলাল স্বামীজিকে পুষ্পমাল্যাদি দানে এবং নানাবিধ ফল ও মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করিয়া স্তোত্রপাঠ করিলেন।
এই সময়ে স্বামীজির শেষ ফটো (আলোকচিত্র) তুলিবার প্রস্তাব করা হইলে, শ্রীরাখাল মহারাজ নিষেধ করিয়া বলিলেন : “স্বামীজির কতো রকমের ভাল ফটো রয়েছে, এই বিষাদ মাখা ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে।”
(শংকর ২০১৬: ২৮০-২৮২)
১৯০২ সালের ২ জুলাই। মৃত্যুর দুই দিন আগে ভগিনী নিবেদিতাকে খেতে নিমন্ত্রণ করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেদিন ছিল স্বামীজীর একাদশীর নিরাহার উপবাস। নিজে খাবেন না, কিন্তু ভগিনী নিবেদিতাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। বেজায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেন ভগিনী নিবেদিতা।স্বামীজী নিবেদিতাকে খাওয়ালেন ভাত, আলুসিদ্ধ, দুধ,কাঁঠাল। খাওয়ায় মন নেই নিবেদিতার। কিসের যেন একটা বিষন্নতা নিবেদিতার মনে, শান্তি পাচ্ছিলেন না। প্রথমে কিছুক্ষণ স্বামীজীকে ছাড়া খাবেননা বলেও, শেষে খাওয়া শুরু করলেন। খাওয়ার সময় নানারকম কথা বলতে শুরু করলেন স্বামীজী। খাওয়া শেষ হল। খাওয়া শেষে নিবেদিতার হাত পা জল দিয়ে ধুয়ে দিলেন। অস্বস্তিতে নিবেদিতা চমকে উঠে বললেন, “এ কি করলেন আপনি, এ তো আমার করা উচিত আপনাকে।” স্বামী বিবেকানন্দের উত্তর, “তুমি তো যীশুর কথা পড়েছ। তাহলে নিশ্চয় জানো তিনিও শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন।” আতঙ্কিত নিবেদিতা বললেন, “সে তো তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে।” বিবেকানন্দের সহাস্য উত্তর, “you silly girl”। ভগিনী নিবেদিতার কাছে কথাগুলো হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হল, তখন কিছুই বুঝতে পারলেন না, ঘটনাটির মাহাত্ম্য বুঝলেন দুইদিন পরে।
ভগিনী নিবেদিতার সাথে ঘটা এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে, স্বামী বিবেকানন্দ যে চলে যাবেন বা তাঁর মৃত্যু যে আসন্ন এটা তিনি পূর্ব থেকেই জানতেন। এর জন্যে তাঁর একটি মানসিক প্রস্তুতি ছিল। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পূর্বদিনে ১লা জুলাই মঠের মাঠে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার ধারে তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে অন্তেষ্টিক্রিয়ায় স্থানটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নির্দিষ্ট সেই স্থানেই তাঁর পবিত্রদেহে অগ্নিসৎকার করা হয়।
“দেহত্যাগের কিছুদিন আগে (২৮ মার্চ ১৯০২) নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।’
মহাপ্রস্থানের দুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘এই বেলুড়ে যে আধ্যাত্মিক শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেড় হাজার বছর ধরে চলবে—তা একটা বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে।’
১লা জুলাই মঠের মাঠে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার ধারে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে স্বামীজি গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।”
(শংকর ২০১৬: ২৭৭)
মহাপুরুষেরা যখন পৃথিবীতে আসেন কোন কর্ম সম্পাদনে, কাজটি সম্পাদিত হয়ে গেলে সাথে সাথেই তাঁরা দেহকে হিরণ্ময় পুরুষের কাছে সমর্পণ করেন।মৃতুকালে যেন কামনা বাসনার সুবর্ণপাত্রের আবরণ সরিয়ে সেই হিরণ্ময় পুরুষকে দর্শন করে, জগতের পোষক সত্যধর্ম রূপ তাঁকে দর্শন করে, তাঁর সাথে একাকার হয়ে মুক্তি লাভ করতে পারেন এই থাকে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। শুক্ল যজুর্বেদে (৪০.১৫) ঠিক এমনই একটি মন্ত্র রয়েছে :
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ডাক্তারি রিপোর্ট বলেছে, মস্তিষ্কের রক্তনালী ফেটে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ডাক্তাররাও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। যোগের পরিভাষায় বলতে গেলে, মহাসমাধির সময় সহস্রার চক্রে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। যোগ দর্শনানুসারে আমাদের প্রাণবায়ু সাধারণত জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে মূলাধার দিয়ে বের হয়; কিন্তু সাধক যোগীপুরুষদের ঠিক উল্টা এদের প্রাণবায়ু সহস্রার চক্র দিয়ে বাহির হয়ে দেহহীন কৈবল্যমুক্তি লাভ করে। আমাদের দেহের অভ্যন্তরে সুষুম্না নাড়ীর পথে অতি সূক্ষ্ম পদ্মাকৃতিমূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা-ছয়টি চক্র আছে, যাকে ষটচক্র বলে।সকলের উর্দ্ধে আছে সহস্র পাপড়ির সহস্রার পদ্ম। সাধক যখন মুক্তি লাভ করে তখন তার এই সহস্র পাপড়ির পদ্মটির একটি একটি পাপড়ি প্রস্ফুটিত হচ্ছে এমন উপলব্ধি হয়। স্বামী বিবেকানন্দ যোগ দর্শনের বর্ণিত এ মার্গেই ব্রহ্মরন্ধ্রের সহস্রারপদ্মে দেহত্যাগ করেছিলেন। যেমনটি লোকনাথ বাবা যোগবলে দেহত্যাগ করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে,জীবন ও মৃত্যু মূদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত একই ব্যাপার, নাম আলাদা হলেও উভয়েই মায়া।
আমাদের শরীরে সূক্ষ্ম সুতার মত প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ব্রহ্মদ্বারের মুখ আবৃত করে জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী কুন্দস্থানে সর্বদা রয়েছে। এ শক্তিকে একটি ঘুমন্ত সাপের সাথে তুলনা করা হয়, এ স্থানকে বলে মূলাধারচক্র। এ চক্রটি হল সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। শাস্ত্রকারদের মতে মেরুদণ্ডের বামদিকে ইড়া, মধ্যে সুষুম্না ও ডানদিকে পিঙ্গলা নাড়ী বিরাজমান। আমাদের প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও পথ, মেরুদণ্ডের মধ্যে যার সুক্ষ্ম অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এ প্রাণময় পথে ছয়টি স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষটচক্র বলা হয়।এ চক্রগুলো হল:
১.মূলাধার চক্র : এ চক্র থেকেই সাধকের কুলকুণ্ডলিনী শাক্তি জাগ্রত হয়ে পথচলা শুরু করে। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে এর অবস্থান। এ স্থান থেকেই ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান প্রধান নাড়িগুলো উৎপন্ন হয়। শরীরের পদ্মসূত্রের মতো সূক্ষ্ম আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি এ মূলাধার চক্রেই সুপ্ত থাকে। যোগীরা এই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভ করার চেষ্টা করে থাকেন। এ চক্রে পৃথিবীতত্ত্বের প্রাধান্য।
২. স্বাধিষ্ঠান চক্র : এর অবস্থান নাভিচক্রের নিচে এবং লিঙ্গের মূলস্থানে। এরমধ্যে বরুণতত্ত্বের প্রাধান্য।
৩.মণিপুর চক্র : নাভিদেশে এ চক্রের অবস্থান। এ চক্রে অসীম শক্তিশালী তেজ অবস্থান করে, তাই এতে অগ্নিতত্ত্বের প্রাধাণ্য। এই তেজকে মণির সাথে কল্পনা করে এর নামকরণ করা হয়েছে মণিপুরচক্র।
৪.অনাহত চক্র : হৃদপিণ্ড বুকে এই চক্রটি অবস্থিত। এতে বায়ুতত্ত্বের প্রাধান্য। এ চক্রের উত্তরণে সাধকরা অনাহত নাদ শুনতে পায়। রক্তিম বর্ণের বৃহৎ অনাহত চক্রের স্পর্শে ভালবাসার বৃদ্ধি ঘটে।
৫.বিশুদ্ধচক্র : এর অবস্থান মেরদণ্ড সংলগ্ন কণ্ঠমূল বরাবর। এ চক্রের অবস্থানে সাধক শুদ্ধ হয়। এতে আকাশতত্ত্বের প্রাধান্য।
৬.আজ্ঞাচক্র : এ চক্রটি দু’ভ্রূরুর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ চক্র থেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এ চক্রতেই জ্যোতি দর্শন হয়ে সাধকের অনির্বচনীয় আজ্ঞা বা নির্দেশ আসে। এ কারণে এর নাম আজ্ঞাচক্র।এখানে বায়ুক্রিয়ার অন্ত হয়ে ইড়া পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ির মিলন হয়, তখন তাকে সাধকের ত্রিবেণী সঙ্গম বলে। এ স্তরে যোগী প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
দেহত্যাগের পূর্বে স্বামী বিবেকানন্দ অসংখ্য যোগী পুরুষদের দেখানো মার্গে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে মহাসমাধি লাভ করেছিলেন। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, তাঁর বয়স ৪০ পেরোবে না। স্বামীজীর যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৯ বছর, ৫ মাস, ২৫ দিন। বেলুড় মঠে গঙ্গার ধারেই তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি নিজেই তাকে দাহ করার স্থানটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। গঙ্গার যে পাড়ে বেলুড় মঠে স্বামীজীকে দাহ করা হয়, ১৬ বছর পূর্বে এর ঠিক উল্টোদিকেই গঙ্গার পূর্বপাড়ে কাশীপুর মহাশ্মশানে দাহ করা হয়েছিল তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে। মধ্যে স্রোতস্বিনী গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে; এবং সেই গঙ্গার এপাড় ওপাড় দু’পাড় জুড়েই আছেন জগদ্বিখ্যাত হিমালয়ের মত মহান গুরুশিষ্য।
তথ্য সহায়তা:
১.শংকর, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, সাহিত্যম্, কলকাতা, সপ্তবিংশ সংস্করণ ২০১৬
লেখক পরিচিতি:
শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়