শরৎ ও বসন্ত ‘নবরাত্রি’



Updated: 29 September, 2024 4:12 am IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তীপূজা নামেই খ্যাত। প্রচলিত ধারণামতে বসন্তকালের এ পূজাকেই প্রকৃত পূজা বলে অবিহিত করা হয়। বিপরীতে শরৎকালের শারদীয় পূজাকে বলা হয় অকালবোধন। রামচন্দ্র কর্তৃক প্রবর্তিত অকালের পূজা। কিন্তু বিষয়টি শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে যথাযথ নয়। শ্রীচণ্ডীতে জগন্মাতা দুর্গা নিজেই তাঁর বাৎসরিক পূজা শরৎকালে করতে বলেছেন।

শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।
তস্যাং মমৈতম্মাহাত্ম্যং শ্রুত্বা ভক্তিসমন্বিতঃ।।
(শ্রীচণ্ডী :১২.১২)

“শরতকালে আমার যে বাৎসরিক মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, সে পূজায় আমার মাহাত্ম্যকথারূপ শ্রীচণ্ডী পাঠ করে সবাই ভক্তিসহকারে শ্রবণ করবে।”

দুর্গাপূজার প্রচলন বা মাহাত্ম্য সম্পর্কে মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। এ মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়কেই শ্রীচণ্ডী বলা হয়।শ্রীচণ্ডীর তেরটি অধ্যায়ের ৫৭৮ টি শ্লোকে দেবীমাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্ত্রীসন্তানদের দ্বারা প্রতারিত সমাধি নামক এক বৈশ্য একদিন মেধা ঋষির আশ্রমে যান। সেখানে তাঁর নির্দেশে তাঁরা দেবীদুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমায় পূজা করেন এবং দেবীসূক্ত জপ করেন। পূজায় সন্তুষ্টা হয়ে দেবী তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কালিকা পুরাণ থেকে জানা যায়, শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে যুদ্ধজয় করতে দেবীকে পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এ পূজার নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা। চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দেবীর পূজা হয়, যা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে খ্যাত। শারদীয়া দুর্গাপূজা আশ্বিনের শুক্লপক্ষে হয়। আবার কার্তিক মাসেও দেবীর পূজা হয়, যা কাত্যায়নী পূজা নামে খ্যাত। দেবীর শুক্লপক্ষে নয়দিন ব্যাপী পূজাকেই নবরাত্রি বলে। নবরাত্রি একাধিক। চৈত্র, আশ্বিন, আষাঢ় ও মাঘ মাসেও নবরাত্র অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে দেবীর পূজা এবং দেবীকে উপলক্ষ করে বিবিধ মহোৎসব করা কর্তব্য। দেবীভাগবতে নবরাত্রির মাহাত্ম্য সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। দেবী স্বয়ং সুদর্শন নামক পরম ভক্ত এক রাজাকে দর্শন দিয়ে নবরাত্রি পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।

শরৎকালে মহাপূজা কর্তব্যা মম সর্বদা ।
নবরাত্রবিধানেন ভক্তিভাবষুতেন চ ।।
চৈত্রেঽশ্বিনে তথাষাঢ়ে মাসে কার্য্যো মহোৎসবঃ।
নবরাত্রে মহারাজ পূজা কার্য্যা বিশেষতঃ।।
( দেবীভাগবত:৩. ২৪. ২০-২১ )

“ভগবতী চণ্ডিকা বললেন, হে রাজন ! প্রতি বছর শরৎকালে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে নবরাত্র বিধান অনুসারে আমার মহাপূজা করবে । চৈত্র, আশ্বিন, আষাঢ় ও মাঘ মাসের নবরাত্রে বিশেষভাবে আমার মহোৎসব ও পূজা করা সকলের কর্তব্য বলে জানবে। “

শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী তিথি অবধি নয়দিনকে নবরাত্রি বলে। এসময় দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পূজা করা হয়। বসন্তকাল, শরৎকাল, বর্ষাকাল এবং শীতকাল এ চারটি ঋতুতে চৈত্র, আশ্বিন, আষাঢ় ও মাঘ এ চারটি মাসে চারবার নবরাত্রি পালনের বিধান দেবীভাগবতে পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে শরৎকাল ও বসন্তকালে অনুষ্ঠিত নবরাত্রি খুবই মাহাত্ম্যপূর্ণ। নবরাত্রি প্রসঙ্গে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস দেবীভাগবতে শরৎকাল এবং বসন্তকালেও বিধিবিধানে যত্নপূর্বক নবরাত্রি পালন করতে বলেছেন। কারণ শরৎকাল ও বসন্তকালে রোগব্যাধির প্রকোপ বেশি হওয়ায় এ সময়কে যমদ্রংষ্ট্রা বলে অবিহিত করা হয়। এ সময়ে যমরাজ দাঁত বের করে জীবকে অকালে গ্রাস করে থাকে। তাই যমগ্রাসের হাত থেকে মুক্তির জন্য মঙ্গলকামী ব্যাক্তিগণ নবরাত্রি ব্রতের অনুষ্ঠান করে দেবীকে সন্তুষ্ট করেন । বসন্ত ও শরৎকাল উভয় ঋতুতেই মানবগণ বিবিধ পীড়া দুঃখে পীড়িত হয়ে কালকবলে পতিত হয়। তাই সে সময়ে শাস্ত্রোক্ত বিধিবিধানে দেবী চণ্ডীকার পূজা করা একান্তই কর্তব্য।

ব্যাস উবাচ-
শৃণু রাজন্‌ প্রবক্ষ্যামি নবরাত্রব্রতং শুভম্‌ ।
শরতকালে বিশেষেণ কর্তব্যং বিধিপূর্বকম্‌ ।।
বসন্তে চ প্রকর্তব্যং তথৈব প্রেমপূর্বকম্।
দ্বাবৃতু যমদংষ্ট্রাখ্যৌ নূনং সর্বজনেষু বৈ ।।
শরদ্বসন্তনামানৌ দুর্গমৌ প্রাণিনামিহ ।
তস্মাদ্ যত্নাদিদং কার্য্যং সর্বত্র শুভমিচ্ছতা।।
দ্বাবেব সুমহাঘোরাবৃত রোগকরৌ নৃণাম্‌ ।
বসন্তশরদাবেব জননাশকরাবুভৌ ।।
তস্মাত্তত্র প্রকর্তব্যং চণ্ডিকাপূজনং বুধৈঃ ।
চৈত্রেঽশ্বিনে শুভে মাসে ভক্তিপূর্বং নরাধিপ।।
( দেবীভাগবত: ৩. ২৬.৩-৭ )

“ব্যাসদেব বললেন, রাজন! পরমশুভপ্রদ, নবরাত্র ব্রতের বিষয় বর্ণনা করছি শুন। নবরাত্র ব্রত শরৎকালে বিশেষরূপে যথাবিধি করতে হয় এবং বসন্তকালেও তা প্রীতিপূর্বক করা কর্তব্য।কারণ শরৎ ও বসন্ত নামক ঋতুদ্বয়, প্রাণিগণের জীবনে দুঃখ যাতনা নিয়ে আসে। তাই এ ঋতু দু’টি মানুষের কাছে যমদংষ্ট্রা নামে খ্যাত। সর্বত্র শুভার্থী ব্যক্তিমাত্রেরই ঐ সময়ে যত্নপূর্বক নবরাত্রি ব্রতের অনুষ্ঠান করা একান্তই প্রয়োজনীয়। বসন্ত ও শরৎ এই দুই ঋতুই অতি ভয়ংকর।সে সময়ে মানবগণের বিভিন্ন প্রকারের পীড়া উপস্থিত হওয়ায়, বহু মানবই কালের কবলে নিপতিত হয়।তাই হে নরাধিপ! চৈত্র এবং আশ্বিন মাসে জ্ঞানবান ব্যক্তিগণের ভক্তিপূর্বক দেবী চণ্ডীকার পূজা করা অবশ্য কর্তব্য।”

নবরাত্রিতে দেবীর নয় রূপের পূজা হয়, তাই সেই দেবীর সেই নয় প্রকার রূপকে নবদুর্গা বলে। এ নবদুর্গার প্রথম হলেন শৈলপুত্রী। তিনি আদ্যাশক্তি মহামায় অবতার রূপে দক্ষরাজ হিমালয়ের কন্যারূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আরেক নাম গিরিনন্দিনী পার্বতী। নবদুর্গার দ্বিতীয় ব্রহ্মচারিণী। আদ্যাশক্তি মহামায়া অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে ভগবান শিবকে পতিরূপে পাবার জন্য ব্রহ্মচারিণী হয়ে কঠোর তপস্যা করেন। নবদুর্গার তৃতীয় হলেন। চন্দ্রঘণ্টা। প্রচণ্ড ঘণ্টাধ্বনি করে দেবী জগতের সকল বাধা বিপত্তি বিদূরিত করেন। চতুর্থ হলেন চতুর্বর্গ ফলদায়িনী দেবী কুস্মাণ্ডা। তিনি হাতে ব্রহ্মজ্ঞান প্রদানের প্রতীক অমৃতের কলস ধারণ করে আছেন। নবদুর্গার পঞ্চম হলেন স্কন্দমাতা। তিনি শিবপুত্র কার্তিকের জননী। কার্তিকের এক নাম স্কন্দ। ষষ্ঠরূপে তিনি কাত্যায়নী। মহিষাসুরকে বধ করে সকল আসুরিক সঙ্কট দূরকারিনী। দ্বাপরযুগে বৃন্দাবনের গোপনারীরা ভগবাব শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্তির জন্য দেবী কাত্যায়নীর পূজা করেছিলেন। নবদুর্গার সপ্তমরূপ হলো কালরাত্রি। সৃষ্টির প্রারম্ভে যখন কিছুই ছিলো না, তখন তিনিই ছিলেন।ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রা তিনিই ভঙ্গ করে মধু-কৈটভ নামক অসুরদ্বয়কে বধে শক্তি প্রদান করেছিলেন। অষ্টমরূপে দেবী হলেন মহাগৌরী। ভগবান শিবের মহেশ্বরী শক্তি। নবদুর্গার সর্বশেষ হলেন সিদ্ধিদাত্রী। সকল প্রকার সিদ্ধবিদ্যার অধীশ্বরী , ভগবান শিবের সাথে অর্ধনারীশ্বর রূপে বিরাজিতা চতুর্বর্গ ফলপ্রদায়িনী।

প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী ।
তৃতীয়ং চণ্ডঘণ্টেতি কুস্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্ ।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা ।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্ ।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গাঃ প্রকীর্তিতাঃ ।
উক্তান্যেতানি নামানি ব্রহ্মনৈব মহাত্মনা।।
অগ্নিনা দহ্যমানাস্তু শত্রুমধ্যগতা রণে।
বিষমে দুর্গমে চৈব ভয়ার্তাঃ শরণং গতাঃ।।
ন তেষাং জায়তে কিঞ্চিদশুভং রণসঙ্কটে।
আপদং ন চ পশ্যন্তি শোকদুঃখভয়ঙ্করীম্।।
(শ্রীচণ্ডী:দেবীকবচ, ৩-৭)

“প্রথম শৈলপুত্রী, দ্বিতীয় ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয় চন্দ্রঘন্টা, চতুর্থ কুষ্মাণ্ডা, পঞ্চম স্কন্দমাতা, ষষ্ঠ কাত্যায়নী, সপ্তম কালরাত্রি, অষ্টম মহাগৌরী এবং নবম সিদ্ধিদাত্রি- এঁরা সকলে নবদুর্গা বলে প্রকীর্তিতা। এ সকল নাম ব্রহ্ম কর্তৃক উক্ত হয়েছে।

অগ্নির দ্বারা দহ্যমান, রণক্ষেত্রে শত্রুমধ্যে পতিত বা বিষম বিপদে সন্ত্রস্ত হয়ে যারা দেবীর শরণাগত হয়, তারা ভয়ংকর রণসঙ্কট থেকেও উদ্ধার পায়। সকল অশুভ তাদের বিদূরিত হয়ে যায়। তাদের সামনে আর ভয়ংকর শোক, দুঃখ বিজড়িত বিপদ আসে না।”

পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে যায় মহালয়ার দিন। সেই মহালয়ার পরের দিন থেকে দেবীপক্ষ শুরু হয়ে যায়। সেই দেবীপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে শৈলপুত্রী পূজা থেকে শুরু করে নবমী তিথিতে দেবী সিদ্ধিদাত্রির পূজা পর্যন্ত প্রতিদিন নবদুর্গা দেবীর এক এক রূপের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ নবরূপে পূজিতা দেবী ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এ চতুর্বর্গ প্রদান করেন।

লেখক পরিচিতি:

ড. শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়