© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্যার অন্ত নেই। এর জন্যে অনেকের মাঝেই প্রচণ্ড হতাশা ব্যক্ত করেন। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের আজ “সর্বাঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দিব কোথা?” বাঙালির এ প্রবাদবাক্যটির মত অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু এরপরেও হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। মনে রাখতে হবে প্রতিটি কালরাত্রির অবসানের পরেই একটি আলোকদীপ্ত দিনের আগমন ঘটে। দিনেদিনে প্রান্তিক সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া মানুষদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূত্রের উদ্যোগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকেই প্রথমে নিতে হবে। সে উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি হলেও সমস্যা নেই। সুসংবদ্ধ উদ্যোগ গ্রহণই বড় কথা। আজ যদি যে কোন কাজ শুরু করা যায়, তবে একদিন না একদিন সেই কাজটি ফলপ্রসূ হবে। এতে হয়ত কয়েকটি প্রজন্ম চলে যেতে পারে।এতে কিছুই আসে যায় না। আবার সকল কর্মেরই যে দৃশ্যমান ফল হবে, ফলাফল দ্রুতগামী হবে, এমন কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কখনো কর্ম এবং তার ফলাফলের মাঝে বহুকালব্যাপী দূরত্ব থাকে। আবার কখনো মঙ্গলময় কর্মের ফলাফল আপাত অদৃশ্যমান হলেও ধীরেধীরে দৃশ্যমান হয়। এ কর্মকৃত্য প্রসঙ্গে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে সঞ্জয়কে তাঁর মহীয়সী জন্মদায়িনী মা বিদুলা বলেছেন:
অমর্ষেণৈব চাপ্যর্থা নারব্ধব্যাঃ সুবালিশৈঃ।
সর্বেষাং কর্মণাং তাত ফলে নিত্যমনিত্যতা।।
(মহাভারত: উদ্যোগ পর্ব,১২৬.২৭)
“অতি মূর্খরাই ক্রোধপূর্বক কোন কাজ আরম্ভ করে না। কিন্তু পণ্ডিতেরা ক্রোধান্বিত হলেও কোন কাজ আরম্ভ করতে পারেন। বৎস! সকল কর্মেরই যে ফল হবে, এমন কোনও নিয়ম নেই।”
বেদ আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এ বেদেই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, হতাশ না হয়ে জীবনকে জয় করে শত বছর বাঁচতে।কখনই জীবনের কাছে পরাজিত হওয়া যাবে না। নিষ্কাম ভাবে আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করে যেতে হবে।অবশ্য এ ছাড়া অন্য কোন গতি নেই ৷
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ ৷
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে ৷৷
“এই সংসারে যথাবিহিত কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান করেই মানুষ শতবছর বেঁচে থাকবে।হে মনুষ্য, এই প্রকারে কর্ম করলে তুমি কর্মবন্ধনে লিপ্ত হবে না। এ ব্যতীত অন্য পথ নেই।”
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের দেশ,জাতি, সমাজ, ধর্ম এবং সংস্কৃতি রক্ষার্থে বেশে কিছু কর্মসূত্র গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
১. বেদ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। সত্যবিদ্যাময় এ বেদের প্রচার প্রসার যতটা বৃদ্ধি হবে ততটাই জগতের কল্যাণ হবে। মানবতার কল্যাণ হবে। বেদে জগতের প্রত্যেকটি মানুষকে এক হওয়ার সর্বজনীন প্রেরণা দেয়া হয়েছে। তাই মানবতার সর্বজনীন কল্যাণের লক্ষ্যে বেদ এবং বেদান্ত দর্শনের যথাসম্ভব অনুশীলন ও প্রচার করা প্রয়োজন। বেদান্ত দর্শন বলতে তিনপ্রকার প্রস্থান গ্রন্থকে বোঝায়। আরও যদি আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলি, তাহলে বলতে হয় বৈদিক উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং ব্রহ্মসূত্র-এ তিনটি গ্রন্থকে একত্রে বেদান্ত দর্শন বলে।
২. ধর্ম একটি ব্যক্তিগত আচরিত বিষয়। এ ব্যক্তিগত কল্যাণকর বিষয়কে রাস্তাঘাটে আনা না হয় ততই কল্যাণ। যখন সেটি অকারণ রাস্তাঘাটে চলে আসে তখন তা আর ধর্ম থাকে না, থাকে শুধুই রাজনীতি। বর্তমানে দিনেদিনে আমাদের মানবজীবনপ্রবাহ ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততম হয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রতিদিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্ম তারাই পালন করতে পারবে, যারা যারা বেকার এবং অলস জীবন যাপন করে। প্রতিদিন মানুষ নিজস্ব বাড়িতে ধর্ম পালন করবে। তাই সাধুসন্ন্যাসী ছাড়া সঙ্ঘবদ্ধভাবে ঘরের বাইরে ধর্ম পালন সকলের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। তবে একথা সত্য যে, প্রতিদিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্ম পালন না করলেও সপ্তাহে অন্ততপক্ষে একদিন সঙ্ঘবদ্ধ ধর্মীয় সভায় অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। সেই সভার নামকরণ কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ধর্মসভা, ধর্ম সম্মেলন, ইষ্টগোষ্ঠী সম্মেলন ইত্যাদি বিভিন্ন নতুন নতুন নামকরণ না করে আমাদের পূর্বের থেকে প্রচলিত কোন প্রাচীন শব্দকে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এমন একটি পরম্পরাগত প্রাচীন শব্দ হল, ধর্মচক্র শব্দটি। ঋষি-মুনিরা নিয়মিত বসে যেখানে ধর্মের আলোচনা করে ধর্ম নির্ণয় করতেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে সকলের পরম আশ্রয়স্বরূপ ধর্মচক্রে সর্বদা যুক্ত থাকতে বলা হয়েছে।
আদৌ প্রবৃত্তিতে চক্রে তথৈবাদিপরায়ণে।
বর্ত্তস্ব পুরুষব্যাঘ্র সংবিজানামি তেঽনঘ ॥
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ৬৩.৩৫)
“হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির! ভগবান বিধাতা সৃষ্টির প্রথমেই এইভাবে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছেন । সুতরাং ধর্মচক্র সকলেরই পরম আশ্রয়স্বরূপ। অতএব তুমি সেই ধর্মচক্রেই আমৃত্যু সদা যুক্ত থেক।”
তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলের উচিত ঋষি-মুনির পরম্পরায় আজও নিয়মিত সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক ধর্মচক্রের অংশগ্রহণ ও পরিচালনা।
৩. বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অধিকাংশই তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে সুস্পষ্টভাবে জানে না। তাই তাদের মধ্যে নিজ ধর্ম সংস্কৃতি নিয়ে স্বাভিমান বোধ জাগে না। না জানার কারণে তারা প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হয়। এই বিভ্রান্তির সুযোগে অনেকে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা করে।এই কারণে সনাতন ধর্মের প্রকৃত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজন। যখন আমরা প্রকৃত শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা জানতে পারবো, তখন আমাদের মাঝে বসবাস করা কুসংস্কারগুলোকেও চিহ্নিত করে তাদের দূরীভূত করতে পারবো। ধর্ম শাশ্বত ঈশ্বরের প্রবর্তিত সর্বাঙ্গসুন্দর। এতে কোন অন্ধত্ব নেই, বন্ধ্যাত্ব নেই এবং এক বিন্ধু পরিমাণ কুসংস্কার নেই।কিন্তু কুসংস্কার আছে সমাজে। কারণ সমাজ মানুষ পরিচালনা করে। যুগে যুগে কিছু মানুষ সমাজকে ব্যক্তিস্বার্থে মলিন করে কালিমালিপ্ত করে। তাই মহাপুরুষগণ যুগে যুগে এসে সেই যুগের কালিমাকে অপনোদন করেন। বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে সামাজিক বর্ণবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদ, যৌতুক প্রথা বেশ কিছু সামাজিক সমস্যা রয়েছে। এ সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে আমাদের সবাইকে সক্রিয় হতে হবে।
৪. দরিদ্র ও মেধাবী সনাতন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, ধর্মান্তরকরণরোধ, ধর্মীয় তথ্যসন্ত্রাস দূরীকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, আলোচনা সভা, শিক্ষাভ্রমণ ইত্যাদির আয়োজন।
৫. অসহায়, নিপীড়িত, দুর্গত এবং লাঞ্ছিত মানুষের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহায়তা দান।
৬. হিন্দু সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পত্রিকা এবং বিভিন্ন গ্রন্থাদির প্রকাশ ও প্রচার।
৭. সমাজে প্রথমেই বৈদিক জ্ঞান প্রয়োজন। সেই থেকেই সমাজকে যখন সংস্কার করা হবে তবেই ঐক্যবদ্ধতা আসবে। তাই জ্ঞান, সংস্কার এবং ঐক্য’এই তিনটি ভিত্তিকে হিন্দু সমাজের মাঝে বাস্তবিক রূপায়ণের জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন।