© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
‘মহালয়া’ হল পিতৃপক্ষের অবসানের তিথি। দেবীপক্ষের পূর্ববর্তী পক্ষকে অপরপক্ষ বা পিতৃপক্ষ বলা হয় এবং দেবীপক্ষের পূর্ববর্তী অমাবস্যাকে মহালয়া বলা হয়। মহালয়া শব্দটির বুৎপ্যত্তিগত অর্থ হল “মহান্ আলয় ইতি বা”।‘মহ’ শব্দটির একাধিক অর্থ হয়। মহ শব্দটির একটি অর্থ পূজা এবং অন্য অর্থ উৎসব। মহালয়া হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আলয় শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে আশ্রয়। আবার ‘মহালয়’ বলতে, ‘পিতৃলোককে’ বোঝায়, যে লোকে বিদেহী পিতৃপুরুষ অবস্থান করছেন। তাই পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানকে মহালয়া নামে অবিহিত করা যায়। পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যা পাড়ি দিয়ে যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমন বার্তাকে বহন করে মহালয়া। স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, মহালয়া। মহালয়া শব্দটির বুৎপ্যত্তিগত অর্থ অনুসরণ করে দেবী শ্রীদুর্গাকেই মহালয়া নামে অভিহিত করা হয়। অন্যথায়, শব্দার্থের হানি ঘটে। প্রধানত মহালয়ার আয়োজন করা হয় এই কারণে যে, দুর্গাপূজা একটি সুবৃহৎ আয়োজনের পূজা। এ পূজা যেন নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন হয়, তাই দুর্গাপূজার পূর্ববর্তী পক্ষে পিতৃপুরুষদের তিল-জল সমর্পণ করে তাদের আশীর্বাদ গ্রহণ করতে হয়।
গৃহস্থাশ্রমীদের পাক করার চুল্লী, পেষণী, উপষ্কর অর্থাৎ গৃহের উপযোগী হাঁড়ি-কড়া প্রভৃতি, কণ্ডনী অর্থাৎ মুষল, ঢেকি, হামানদিস্তা প্রভৃতি ও জলকুম্ভ বা কলসী প্রভৃতি-এই পাঁচটি পঞ্চসূনা বা পশুবধস্থান দ্বারা অজ্ঞাতসারে যে প্রাণিহিংসা ঘটে, তার থেকে উৎপন্ন পাপের হাত থেকে নিষ্কৃতির জন্য ব্রহ্মযজ্ঞাদি পঞ্চমহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানের বিধান বর্ণিত হয়েছে। সে পঞ্চ মহাযজ্ঞ হল: ব্রহ্মযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, নৃ-যজ্ঞ এবং ভূতযজ্ঞ।পঞ্চমহাযজ্ঞের মধ্যে পিতৃযজ্ঞ অন্যতম। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, অন্ন-জলাদির দ্বারা পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণের নাম পিতৃযজ্ঞ বলে।
অধ্যাপনং ব্রহ্মযজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্।
হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোঽতিথিপূজনম্।।
পঞ্চৈতান্ যো মহাঽযজ্ঞান্ন হাপয়তি শক্তিতঃ।
স গৃহেঽপি বসন্নিত্যং সূনাদোষৈর্ন লিপ্যতে।।
(মনুস্মৃতি: ৩.৭০-৭১)
“বেদাদি অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার নাম ব্রহ্মযজ্ঞ, অন্ন-জলাদির দ্বারা পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণের নাম পিতৃযজ্ঞ, অগ্নিতে প্রক্ষেপরূপ হোমের নাম দেবযজ্ঞ, পশুপাখিদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বলিকর্ম অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য উপহারের নাম ভূতযজ্ঞ, এবং অতিথিসেবার নাম নৃযজ্ঞ বা মনুষ্যযজ্ঞ- মহর্ষিগণ কর্তৃক এইরূপ বিহিত হয়েছে।
যে গৃহস্থ প্রতিদিন পূর্বোক্ত পঞ্চমহাযজ্ঞ যথাশক্তি বা যথাসম্ভব পরিত্যাগ না করেন অর্থাৎ অনুষ্ঠান করেন, তিনি গৃহস্থাশ্রমে বসতি করেও সূনাজনিত দোষে লিপ্ত হন না।”
মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে পিতৃগণকে যা কিছুই বিধিবৎ শাস্ত্রোক্তরীতিতে প্রদান করেন সেই দ্রব্যাদি পিতৃপুরুষদের পরলোকে অনন্ত এবং অক্ষয় তৃপ্তি প্রদান করে।
যদ্ যদ্দদাতি বিধিবৎ সম্যক্ শ্রদ্ধাসমন্বিতঃ।
তত্তৎ পিতৃণাং ভবতি পরত্রানন্তমক্ষয়ম্।।
(মনুসংহিতা:৩. ২৭৫)
“কোন ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে পিতৃগণকে নিষিদ্ধ দ্রব্যাদি বাদে, যা কিছুই বিধিবৎ শাস্ত্রোক্তরীতিতে দান করেন সেই দ্রব্যাদি পিতৃপুরুষদের পরলোকে অনন্ত এবং অক্ষয় তৃপ্তি প্রদান করে।”
স্নান করে গায়ত্রী জপ করে পূর্ব দিকে মুখ করে জলাঞ্জলি প্রদান করে দেবগণের তর্পণ করবে। প্রত্যহ পুরুষসূক্ত দ্বারা ভক্তিসহকারে জলাঞ্জলি এবং পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করবে। এরপরে দক্ষিণ দিকে মুখ করে জানুদ্বয়ের মধ্যস্থানে দুইহাত রেখে পিতৃতীর্থ দ্বারা শ্রাদ্ধীয় রীতি অনুসারে পিতৃগণের উদ্দেশে জলাঞ্জলি প্রদান করবে। পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রভৃতি তিন পুরুষ এবং মাতা-প্রভৃতি তিন জনকে তিন তিন অঞ্জলি দান করে মাতামহী প্রভৃতি তিনজনকে এক এক অঞ্জলি প্রদান করবে। এরপরে পিতৃপক্ষে এবং মাতৃপক্ষে যাদের নাম জানা থাকবে, তাঁদের ও গুরুগণ, সম্বন্ধী, বান্ধব এবং সুহৃদগণের উদ্দেশ্যে তর্পণ করবে। তর্পণ করার সময়ে মনে রাখতে হবে:
বিনা রৌপ্যসুবর্ণেন বিনা তাম্ৰতিলেন চ ।
বিনা দৰ্ভৈশ্চ মন্ত্ৰৈশ্চ পিতৃণাং নোপতিষ্ঠতে ॥ সৌবর্ণরাজতাভ্যাঞ্চ খড়্গেনোডুম্বরেণ বা।
দত্তমক্ষয়তাং যাতি পিতৃণান্তু তিলোদকম্ ॥
কুৰ্য্যাদহরহঃ শ্রাদ্ধমন্নাদ্যেনোদকেন বা।
পয়োমূলফলৈৰ্ব্বাপি পিতৃণাং প্ৰীতিমাবহন্ ॥
স্নাতস্তু তৰ্পণং কৃত্বা পিতৃণান্তু তিলাম্ভসা। পিতৃযজ্ঞমবাপ্নোতি প্রীণত্তি পিতরস্তথা ॥
(শঙখসংহিতা: ১২.১-৪)
“রৌপ্যপাত্র, সুবর্ণপাত্র, তামপাত্র, তিল, দর্ভ এবং মন্ত্র ব্যতিরেকে তর্পণ করলে পর, পিতৃগণের তৃপ্তিজনক হয় না। সুবর্ণপাত্র, রৌপ্যপাত্র, খড়্গপাত্র, কিংবা উডুম্বরকাষ্ঠনিম্মিত পাত্র দ্বারা পিতৃলোক-উদ্দেশে তিলযুক্ত জল প্রদান করলে, সেই তিলজল দান অক্ষয় হয়ে যায়। অন্ন প্রভৃতি দ্রব্য কিংবা জল, দুগ্ধ, মূল এবং ফল দ্বারা প্রতিদিন পিতৃগণের প্রীতি উৎপাদন করত শ্রাদ্ধ করবে। স্নানানন্তর তিলযুক্ত জল দ্বারা পিতৃগণের তর্পণ করলে পর, পিতৃযজ্ঞের ফল প্রাপ্ত হয়। তর্পণ দ্বারা পিতৃগণ অত্যন্ত প্রীত হন।”
মহালয়া আশ্বিন মাসের অমাবশ্যা। এই অমাবশ্যার দিন পিতৃগণের উদ্দেশে পার্বণ শ্রাদ্ধ করতে হয়। কৃষ্ণ প্রতিপদ থেকে যে তর্পণ শুরু হয়, তা পক্ষকাল চলে মহালয়ার দিন শেষ হয়। সকল তিথিই শ্রাদ্ধের জন্য প্রশস্ত নয়।
কৃষ্ণপক্ষে দশম্যাদৌ বর্জয়িত্বা চতুৰ্দশীম্।
শ্রাদ্ধে প্রশস্তাস্তিথয়ো যথৈতা ন তথেতরাঃ৷৷
যুক্ষু কুর্বন্ দিনক্ষেষু সর্বান্ কামান্ সমশুতে।
অযুক্ষু তু পিতৃন্ সর্বান্ প্রজাং প্রাপ্নোতি পুষ্কলাম্।।
(মনুসংহিতা: ৩.২৭৬-২৭৭)
“কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি বাদ দিয়ে দশমী থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত যে পাঁচটি তিথি শ্রাদ্ধের কাজের পক্ষে যেমন প্রশস্ত, প্রতিপদাদি নয়টি তিথি তেমন নয়।
জোড় তিথিতে (যেমন, দ্বিতীয়া, চতুর্থী প্রভৃতিতে) এবং জোড় নক্ষত্রে (‘ঋক্ষ’ শব্দের অর্থ ‘নক্ষত্র’; যুগ্ম নক্ষত্র যথা—ভরণী, রোহিণী, আদ্রা প্রভৃতি) পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধাদি কাজ করলে অভিলষিত সমস্ত বস্তু লাভ করা যায়। আর বিজোড় তিথি ( প্রতিপৎ, তৃতীয়া প্রভৃতি অযুগ্ম তিথি) এবং বিজোড় নক্ষত্রে (অশ্বিনী, কৃত্তিকা প্রভৃতি অযুগ্ম নক্ষত্রে) পিতৃগণের শ্রাদ্ধ করলে ধনবিদ্যাদিযুক্ত সন্তান লাভ করা যায়।”
পিতৃপুরুষদের সন্তুষ্টির জন্য যে তর্পণসহ তা দিনের পূর্বাহ্ণ থেকে অপরাহ্ণের মধ্যেই করতে হয়। তবেই তা বিশেষ ফলদায়ক হয়।
যথা চৈবাপরঃ পক্ষঃ পূর্বপক্ষাদ্বিশিষ্যতে।
তথা শ্রাদ্ধস্য পূর্বাহ্লাদপরাহ্বো বিশিষ্যতে।।
(মনুসংহিতা: ৩.২৭৮)
“পিতৃকার্যে যেমন পূর্বপক্ষ (অর্থাৎ শুক্লপক্ষ) থেকে কৃষ্ণপক্ষ প্রশস্ত (অর্থাৎ বিপুল ফলদায়ক্), সেইরকম শ্রাদ্ধের পক্ষে পূর্বাহ্ণ থেকে অপরাহ্ণ বিশেষ ফলজনক হয়।”
তর্পণে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সকল সকলের উদ্দেশ্যে সকল জলাঞ্জলি দিতে হয়। সতিলজল দিতে নরকে এবং অশেষ যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছেন, তাঁদের সকলের তৃপ্তি কামনা করা হয়। যাঁরা বন্ধু নয় বা যাঁরা বন্ধু কিংবা যাঁরা অন্য জন্মে বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা আমাদের জল প্রত্যাশা করেন; সেই সকলেই উদ্দেশ্যে জল দান করতে হয়।
নরকেষু সমস্তেষু যাতনাসু চ যে স্থিতাঃ।
তেষামাপ্যায়নায়ৈতদ্ দীয়তে সলিলং ময়া।।
যেহবান্ধবা বান্ধবা বা যেহন্যজন্মনি বান্ধবাঃ।
তে তৃপ্তি মখিলাং যাত্ত যে চাম্মৎ তোয়কাক্ষিণঃ।।
(বিষ্ণুপুরাণ:৩.১১.৩৪-৩৫)
“যাঁরা সকল প্রকার নরকে এবং অশেষ যন্ত্রণার মধ্যে বাস করছেন, তাঁদের তৃপ্তির জন্য আমি এই জল দান করছি।
যাঁরা বন্ধু নয় বা যাঁরা বন্ধু কিংবা যাঁরা অন্য জন্মে বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা আমাদের জল প্রত্যাশা করেন, তাঁরা সকলেই আমার প্রদত্ত জল দ্বারা সর্বপ্রকার তৃপ্তি লাভ করুন।”
ভাবা যায়, মানুষ কতটা মহান হৃদয়ের হলে যারা বন্ধু নয় শত্রু বা শত্রু পর্যায়ভুক্ত ; তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের উদ্দেশ্য জলদান করার বিধি শাস্ত্রে উক্ত রয়েছে। এমন মহত্তম চেতনা কেবল সনাতন শাস্ত্রেই সম্ভব। তর্পণের সর্বজনীন মহত্তম কল্যাণের বিষয়টি রামতর্পণের মন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে,ব্রহ্মলোক থেকে যাবতীয় লোকে অবস্থিত জীবগণ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ,পিতৃ পিতামহাদি এবং মাতামহাদি সকলেই তৃপ্তিলাভ করুন। পরলোকগত সকল জীবরই বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা হয় এই তর্পণে। দেবতর্পণ, মনুষ্য তর্পণ, ঋষিতর্পণ,যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, পিতৃ তর্পণ, রাম তর্পণ, লক্ষ্মণ তর্পণ প্রভৃতি বিবিধ প্রকারের তর্পণ বিধি রয়েছে। এর মধ্যে রাম তর্পণ অন্যতম। দক্ষিণমুখে প্রাচীনাবীতী হয়ে রাম তর্পণে তিনবার মন্ত্র উচ্চারণ করে সতিলজল দিতে হয়।
ওঁ আব্রহ্মভুবনাল্লোকা দেবর্ষি-পিতৃ-মানবাঃ।
তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহাদয়ঃ।
অতীতকুল কোটীনাং সপ্তদ্বীপ নিবাসিনাম্।
ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ম্।।
“ব্রহ্মলোকপর্যন্ত যাবতীয় লোকে অবস্থিত জীবগণ, দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, পিতৃ পিতামহাদি এবং মাতামহাদি সকলে তৃপ্তিলাভ করুন। আমার যে বহু কোটি কুল বহু জন্মান্তরে গত হয়েছে সেই সেই কুলের পিতৃপিতামহাদি ও সপ্তদ্বীপবাসী সমুদায় পিত্রাদি এবং ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হোক।”
লেখক পরিচিতি :
ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।