মা কালী মাতৃরূপা, মা কালী মৃত্যুরূপা



Updated: 02 September, 2024 4:19 pm IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

কালী প্রলয় স্বরূপিনী, দিগম্বরী, এলোকেশী, মুণ্ডমালাধারিনী, হস্তে মুণ্ড ও রুধিরালিপ্ত খড়্গধারিনী। তিনি শ্মশানে ভূপতিত শিবের বুকে চরণ স্থাপন করে দণ্ডায়মানা। চতুর্দিকে তাঁর বিকট শব্দে চিৎকার করছে ভয়ানকদর্শন সাঙ্গবাঙ্গ ও শৃগালের দল। মৃত্যুর চিতা জ্বলছে, মধ্যে আলোকিত হয়ে উগ্র রূপা হয়ে জগন্মাতা অবস্থান করছেন । কালী মাতৃরূপা, কালী মৃত্যুরূপা। তিনি ভয়ংকর, তিনিই আবার শান্ত। তিনিই জীবকে মায়ার বন্ধনে বাঁধেন, আবার তিনিই মুক্তিদাত্রী অভয়দায়িনী।

দুর্বৃত্তবৃত্তশমনং তব দেবি শীলং
রূপং তথৈতদবিচিন্ত্যমতুল্যমন্যৈঃ ।
বীর্যঞ্চ হন্তৃ হৃতদেবপরাক্রমাণাং
বৈরিষ্কপি প্রকটিতৈব দয়া ত্বয়েত্থম্ ॥

কেনোপমা ভবতু তেঽস্য পরাক্রমস্য
রূপঞ্চ শত্রুভয়কার্যতিহারি কুত্র ।
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা
ত্বয্যেব দেবি বরদে ভুবনত্ৰয়েঽপি ৷৷
(শ্রীচণ্ডী:৪.২১-২২)

“হে দেবি, দুর্বৃত্তগণের দুষ্টপ্রবৃত্তি-দমন আপনার স্বভাব। আপনার সৌন্দর্য কারো সাথে তুলনীয় নয়, তা অচিন্তনীয়। আপনার পরাক্রম দেবতাদের বিক্রমহরণকারি অসুরগণের বিনাশক। শত্রুগণের প্রতিও এইরূপ দয়া আপনার দ্বারাই প্রকাশিত।

হে দেবি, অন্য আর কার সাথে আপনার পরাক্রমের তুলনা হতে পারে? শত্রুভীতিজনক এবং এত মনোরম সৌন্দর্য কোথায় আছে? হে বর প্রদাত্রী বরদে, চিত্তে মুক্তিপ্রদ কৃপা এবং যুদ্ধে কঠোরতা ত্রিভুবনে একমাত্র আপনাতেই পরিদৃষ্ট হয়।”

ভয়ংকরী কালীই সাধকের কাছে মাতৃরূপা, দয়ারূপা। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত সহ ভক্ত সাধকেরা এই ভয়ংকর মূর্তিতেই মাতৃত্বের আস্বাদ পেয়েছেন।দেবীর হাতের ভয়ংকর খড়্গ হল, সকল শুভ শক্তিকে রক্ষার প্রতীক। এ কারণে আসুরিক শক্তি সম্পন্নরা দেবীর হাতের খড়্গ দেখলে ভয় পায়। বিপরীতে সাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষের কাছে খড়্গ হলো মায়ের সকল শক্তির প্রতীক। তাই দেবীর হাতের খড়্গ প্রসঙ্গে শ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে:

অসুরাসৃগ্ বসাপঙ্কচর্চিতস্তে করোজ্জ্বলঃ।
শুভায় খড়্গঃ ভবতু চণ্ডিকে ত্বাং নতা বয়ম্।।
(শ্রীশ্রীচণ্ডী : ১১.২৮)

“হে মা চণ্ডিকে, তোমার হাতে শোভিত প্রজ্বলিত তেজোময়, দুরাচারী অসুরের রক্ত ও মেদলিপ্ত খড়গই আমাদের একমাত্র সহায় হোক ; এ খড়্গ দ্বারাই তুমি আমাদের সকল বিঘ্ননাশ করে কল্যাণসাধন এবং রক্ষা করো। মাগো তোমায় প্রণাম।”

দেবী পুরাণে বলা হয়েছে, সমস্ত পদার্থেরই কলন বা সংহার করেন বলে দেবগণ তাঁকে কালী নামে অবিহিত করেছেন।

কালী দক্ষাপমানেন সর্বশত্রুনিবর্হণী ।
কলনা কালসংখ্যা বা কালী দেবেষু গীয়তে ।।
কপালং ব্রহ্মকং জাতং করে ধারয়তে সদা ।
কপালী তেন সা প্রোক্তা পালনাদ্বা কপালিনী ।।
(দেবীপুরাণ:৩৭.১৫-১৬)

“দক্ষের অমানকালে দেবীর নাম কালী হয়েছে। কালে সমস্ত পদার্থেরই কলন বা সংহার করেন বলে দেবগণ তাঁকে কালী নামে অবিহিত করেন। তিনি সর্বদা হাতে ব্রহ্মকপাল ধারণ করেন কিংবা পালন করেন বলে তাঁর নাম কপালী ও কপালিনী।”

দেবী কালীর ধ্যানমন্ত্রেই তাঁর উলঙ্গিনী স্বরূপের কথা বর্ণিত আছে। তিনি মহাপ্রকৃতি। পরমাপ্রকৃতি রূপে তিনি বিশ্বব্যাপীনি । উম্মুক্ত আকাশ, সীমাহীন প্রান্তর, সমুদ্রের নীল জলরাশি সহ দৃশ্যমান সকলই পরমাপ্রকৃতি দেবীর রূপ। তিনি সীমাহীন অনন্ত বন্ধনহীন। তিনি মহাপ্রকৃতি স্বরুপা, তাই দেবী দিগম্বরী । এ ভাবটি লক্ষ্য করে যদিও পূজোর সময় সাধক মাকে বস্ত্র পড়িয়ে দেন । আবার মা কালী ক্ষণে ক্ষণে প্রসব করছেন সৃষ্টি।করালবদনী এলোকেশী মূর্তির মধ্যে জন্মাদায়িনী, পালনী ও সংহারিণী এ ত্রিস্বরূপ একইসাথে দেখা যায়।এ ভূখণ্ডের নন্দনতত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে, সব নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়। এরপরেও আমাদের বর্তমানে দেবদেবীদের পোশাক নিয়ে টেনশনের অন্ত নেই। কারণ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের মত হয়ে যাচ্ছে। মাকালীর মূর্তির শরীরে কাপড় থাক আর না থাক আমাদের কিছুই যায় আসে না, তিনি তো দিগম্বরী ; জগতের এ দশদিকই তাঁর শরীরের অম্বর বা কাপড়। কথাগুলি পুরাণ তন্ত্রে ত আছেই নজরুল ইসলামের শ্যামাসংগীতেও পাওয়া যায়।

“সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক
ঠিকরে পড়ে রূপের মাণিক
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না মা
আমার তাই দিগ্‌–বসন।।”

কিন্তু আমরা বর্তমানে কালী প্রতিমা তৈরি করার সময়ে মূর্তিকে শাড়ি, ব্লাউজ তো পড়াই এতটুকু ঠিক আছে; কিন্তু ইদানিং ঘোমটাও দিয়ে দিচ্ছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রয়োজন পরলে আমরা আরবের বোরকাও হয়ত একদিন মাকালীতে পড়িয়ে দিব। পাছে লোকে কিছু বলে এই মানসিকতা থেকে। মাকালীর মূর্তি উলঙ্গ তাতে কি যায় আসে আমাদের? তিনি তো আমার মা, জগজ্জননী রূপে তাঁকে আমরা উপাসনা করি। তাঁর গর্ভেই এ জগত প্রসবিতা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কৃত ‘বৃহৎতন্ত্রসারঃ’ গ্রন্থে দেবীর দিগম্বরীরূপটি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং ।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাং।।
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধকরাম্বুজাং ।
অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাং।।
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীং ।
কন্ঠাবসক্তমুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চিতাং।
কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকাং।।
ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং।
শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীং ।।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্তধারাবিস্ফুরিতাননাং।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয়বাসিনীং ।
বালার্কমণ্ডলাকারলোচনত্রিতয়ান্বিতাং ।।
দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপিমুক্তালম্বিকচোচ্চয়াং ।
শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাং।।
শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাং ।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাং ।।
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরাননসরোরুহাং ।
এবং সচিন্তয়েৎ কালীং সর্বকামসমৃদ্ধিদাং ।।

“দক্ষিণকালিকাদেবী করালবদনা, ভয়ঙ্করাকৃতি, আলুলায়িতকেশা এবং চতুর্ভুজা। তাঁর গলে মুণ্ডমালা এবং বামভাগের অধােহস্তে সদ্যশ্চিন্নমুণ্ড ও উর্দ্বহস্তে খড়গ ও দক্ষিণভাগের অধােহস্তে অভয় ও উর্দ্ধহস্তে বরমুদ্রা আছে। দেবী প্রগাঢ়মেঘের ন্যায় শ্যামবর্ণা ও দিগম্বরী অর্থাৎ নগ্না। দেবীর গলদেশে যে মুণ্ডমালা আছে, তা হতে বিগলিতরুধিরধারায় সর্বাঙ্গ অনুলিপ্ত; কর্ণেতে দু’টি শবশিশু ভূষণরূপে বিরাজমান আছে, এতে দেবীর আকৃতি অতিভয়ানক হয়েছে; দন্তশ্রেণী অতিভীষণ; স্তনদ্বয় স্থূল ও উন্নত এবং শবহস্তনির্মিতকাঞ্চী কটিদেশে বিরাজমান আছে। কালিকাদেবী হাস্যমুখী। তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তদ্বয় হইতে বিগলিতরুধিরধারায় বদনমণ্ডল সমুজ্জ্বল হয়েছে। দেবীর শব্দ অতিশয় গভীর। ইনি সৰ্বদা শ্মশানে বাস করেন। তাঁর নেত্রত্রয় নবােদিত সূ্র্য্যমণ্ডলের ন্যায় সমুজ্জ্বল, দন্তশ্রেণী উন্নত ও বহির্গত এবং কেশপাশ দক্ষিণব্যাপী ও আলুলায়িত। মহাদেব শবরূপে পতিত আছেন; দেবী এর উপরে অবস্থিতা। তাঁর চতুর্দিকে শিবাগণ ভয়ংকর শব্দ করছে। ইনি মহাকালের সাথে বিপরীতভাবে রতাশক্তা আছেন। দেবীর মুখপদ্ম সুপ্রসন্ন ও হাস্যযুক্ত।তিনি মোক্ষদায়িনী এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী।”

আশেপাশের হঠাৎ মৃত্যুগুলো জীবনকে হঠাৎ ছন্দপতন করে দেয়। মানুষের জীবনে সবেচেয়ে বড় যে নিশ্চিত সত্য, তা হল মৃত্যু। মানুষ জীবনের খেলাঘরে মৃত্যুকেই ভুলে থাকে। এরপরেও জীবনের বাঁকে বাঁকে আসে মৃত্যু। কিছু কিছু মৃত্যু শোক মানুষের মানিয়ে নিতে বড় কষ্ট হয়। কাটিয়ে উঠতে কষ্ট হয়। প্রলয়, ধ্বংস, মৃত্যু স্বরূপিনী দেবী কালীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে একটি অসাধারণ সংগীত রচনা করেছেন।

“উলঙ্গিনী নাচে রণরঙ্গে। আমরা নৃত্য করি সঙ্গে।।
দশ দিক আঁধার ক’রে মাতিল দিক্‌-বসনা,
জ্বলে বহ্নিশিখা রাঙা রসনা—
দেখে মরিবারে ধাইছে পতঙ্গে।।
কালো কেশ উড়িল আকাশে,
রবি সোম লুকালো তরাসে।
রাঙা রক্তধারা ঝরে কালো অঙ্গে—
ত্রিভুবন কাঁপে ভুরুভঙ্গে।।”

লেখক পরিচিতি:

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়