© শীতাংশু গুহ
ভাষা ভিত্তিক দেশ ‘বাংলাদেশ’, একথাটি বেশ প্রচলিত। কথাটি কি সত্য? বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটকে দুইভাগে ভাগ করা যায়, প্রথমত: বাহান্ন থেকে ধারাবাহিক আন্দালন চূড়ান্ত রূপ নেয় ৬-দফার মাধ্যমে, যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো মুখ্য। ৬-দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে একক সংখ্যারিষ্ঠতা লাভ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি, তাই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, ৬-দফার কোথাও কি বাংলা ভাষার কথা আছে? দ্বিতীয় ধারাটি হচ্ছে, পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে বা দুর্বল করতে, এবং পূর্বাঙ্গনে সামরিক ব্যয় কমাতে ভারত সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেয়, এতে ‘বাংলা-ভাষা’ কোথায়? বরং বলা যায়, ভারত অজান্তে ‘লাহোর প্রস্তাব’ বাস্তবায়ন করে দেয়? ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিলো, আজকের বাংলাদেশ তা-ই।
ভাষা ভিত্তিক কোন জাতি গঠিত হয়না, যদি তাই হতো, তবে ইংরেজীতে কথা বলা সবাই ‘ইংরেজ’ হতো, তা হয়নি। একইভাবে বাংলায় কথা বললেই সবাই ‘বাঙ্গালী’ হয়না! বাঙ্গালী হতে হলে বাংলার হাজার বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করতে হয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কি তা করে? নাকি তাঁরা ‘আরবীয়’ সংস্কৃতি মননে অধিক যত্নশীল। অধিকাংশ বাংলাদেশী মানুষ কি নিজেকে ‘বাঙ্গালী’ না ‘বাঙ্গালী মুসলমান’ পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? বাংলাদেশের ভিত্তি যদি ‘ভাষা’ হতো, তবে ধর্ম প্রধান্য পেতো না! ধর্ম যেখানে প্রধান, ভাষা সেখানে গৌণ। অনেক গুণীজন মিথ্যাচার করেন যে, বাংলাদেশের জন্ম ‘দ্বিজাতি-তত্ব’ ভুল প্রমান করে দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আজকের বাংলাদেশ দ্বিজাতি-তত্বের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
পশ্চিমবঙ্গে এখনো অনেকেই ‘বাঙ্গালী’ বলতে বাঙ্গালী হিন্দুদের বোঝেন, এর বহুবিধ কারণ থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষাভাষী হলেও কতটা বাঙ্গালী বলা মুশকিল। স্বাধীনতার পর চেষ্টা হলেও ‘বাঙ্গালী’ জাতিসত্বা ঠিক গড়ে ওঠেনি। তাই আমদানি হয়েছে ‘বাংলাদেশী’ জাতিসত্ত্বা। বাঙ্গালী মুসলমান তাই হয়তো ‘না বাঙ্গালী বা না বাংলাদেশী’, এঁরা বরং ঢের বেশি পাকিস্তানী বা আরবীয়, অনেকেই তাই ‘আরবীয় শিকড়’ খুঁজতে ব্যস্ত। ‘মদিনা সনদ’-এর প্রবক্তারা বাঙ্গালী হ’ন কিভাবে? বাঙ্গালী জাতিসত্বার মধ্যে অনেকেই ‘বিজাতীয় বিদ্বেষ’ খুঁজে পান, বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে তা ‘গায়ের জোরে’ অস্বীকার করতে চান! হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়েছে, সংস্কৃতের প্রতি বিদ্বেষটা সেখানে। এঁরা ভুলে যান, ভাষার কোন ধর্ম হয়না।
হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ গঠনের চেষ্টা হয়েছে। বাহাত্তরে এজন্যে বলা হতো, ঢাকা হবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। এখন কেউ আর ওকথা মুখে আনেনা। সম্ভবত: অধিকাংশ বাংলাদেশী বিশ্বাস করে, বাংলা হিন্দুদের ভাষা, তাই তাঁরা আরবীকে বুকে টেনে নিচ্ছে। বাংলা ভাষা বা বঙ্গ সংস্কৃতির চর্চা বাংলাদেশে এখন তেমন নেই, ঢাকার নাটক আগে ভাল ছিলো, এখন মান কমেছে; সিনেমা বিলুপ্ত হচ্ছে, নাচ-গান বা সংস্কৃতি চর্চা যেটুকু আছে, হিন্দুরা না থাকলে তা বন্ধ হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষা বা বঙ্গ-সংস্কৃতি’র ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে নেই, অন্তত: এ মুহূর্তে তো বটেই? কারণ একটা-ই, ধর্মের উত্থান, ইসলামে সংস্কৃতির জায়গা নেই, বাংলা ভাষার কদর কম, সুতরাং বাংলাদেশ যতই ধর্মের দিকে এগুবে, ততই ধর্মভিত্তিক দেশ হবে, ভাষাভিত্তিক নয়!!