চুকনগর হিন্দু গনহত্যা



Updated: 20 May, 2024 11:59 am IST

© শাখায়াত হোসেন

গুগল আপনাকে সব খুঁজে এনে দেবে। আপনি গুগল সার্চবক্সে গিয়ে চুকনগর লিখুন, চুকনগর এনে দেবে না। আপনাকে এনে দেবে লাশের সারি। আপনি চুকনগর নামের অর্থ খুঁজুন, পাবেন না। চুকনগরের সৌন্দর্য খুঁজুন, পাবেন না। পাবেন শুধু একটা রক্তাক্ত ইতিহাস। আজ মে মাসের বিশ তারিখ। একটু পরই ঘড়ির ছোটো কাটাখানা তিনের উপর পৌঁছুবে। আর বুলেট ফুরিয়ে যাওয়ায় থামবে ব্রাশফায়ার। আপনি একবার চোখ বুজে নিজেকে নিয়ে যান উনিশশো একাত্তর সালে। আপনি চোখ খুলে আর নিজেকে পাবেন না।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার একটা গ্রামের নাম চুকনগর। সকাল এগারটা থেকে বিকেল তিনটা। এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য। চার মাইল। চার ঘণ্টা। আনুমানিক বারো হাজার মানুষ। বলা হয়, পৃথিবীর যেকোনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ একক গণহত্যার নাম, চুকনগর গণহত্যা। চার ঘণ্টা ব্যাপী চলা এই ব্রাশফায়ারের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত। বিকেল তিনটার দিকে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর সামনে পা বাড়াতে পারেনি সে। মাটি ভিজে গিয়েছিল, পায়ের তলায় ছিল অগুনিত লাশ। লাশ সরানোর নির্দেশ দিয়ে চলে যায় হায়াত।

চুকনগর গ্রামের আনসার আলী সরদার জানিয়েছিলেন, তারা সারাদিন ধরে বিয়াল্লিশজন মিলে একুশটি বাঁশে করে লাশ ঠেলে নদীতে ফেলেছিলেন। প্রতিবার দুইশো করে লাশ। একুশ তারিখ থেকে চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত বিয়াল্লিশজন মিলে চার হাজার লাশ গুনে হাল ছেড়ে দেন। আটলিয়া ইউনিয়নের পাতাখোলার বিল থেকে চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতীপাড়া, ভদ্রা নদী ও সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘ্যাংরাইল নদী পর্যন্ত লাল হয়ে ছিল রক্তে।

বিশ তারিখের পর ভদ্রা নদীর জল ছুঁয়েনি মানুষ। দু’মাস অবধি ঐ নদীর মাছ খায়নি। লাশ পঁচা গন্ধ এতবেশী ছিল, ছয় মাস অবধি চুকনগর বাজারে যায়নি কেউ। কোথাও কোথাও লাশ আটকে নদীর গতিপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একুশ তারিখ সকালবেলা বাবা চিকন আলী মোড়লের সন্ধানে বের হয়েছিলেন পুত্র এরশাদ আলী মোড়ল। তিনি দেখেছিলেন ভয়ংকর এক দৃশ্য। পাতখোলা বিলের সামনে লাশের স্তুপ থেকে মৃত এক নারীর স্তন চুষে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে এক ক্ষুধার্ত শিশু। এরশাদ আলী মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে আসেন। শিশুটির নাম রাখেন সুন্দরী। মৃত মায়ের কপালে সিঁদুর ও হাতের শাখা দেখেই বুঝেছিলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী তারা। সুন্দরীকে একটা সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারেই বড়ো করেন তিনি। একটা সাক্ষাৎকারে সুন্দরী বলেছিলেন, আমি তো জানি না আমার পৈত্রিক বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এসেছিলেন আমার বাবা মা। চুকনগরের এই জায়গায় আসলে শুধু বুকটা হু হু করে উঠে আমার।

চুকনগর গণহত্যার বহু বহু বৎসর পরের একটা গল্প শোনাই। নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন। বাংলাদেশীরা একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এক ভদ্রলোক মামা ও মামী সহ ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম মাসুদ করিম খান। যে ট্যাক্সি করে তারা যাচ্ছেন, ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভার একজন পাকিস্তানি যুবক। প্যাসেঞ্জার বাংলাদেশী শুনে যুবক উচ্ছ্বসিত। জানালো- ‘আমরা সবাই ভাই ভাই, মাঝখানে ইন্ডিয়া এসে গোলমাল বাঁধালো।’

যুবক একাত্তর জানেনি। তাদের পড়ানো হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তি বাহিনী মিলে ষড়যন্ত্র করে গণ্ডগোল লাগিয়েছে ভাই ভাইয়ের মধ্যে। এটা তাদের পাঠ্য পুস্তকের পাঠ্য। অত মানুষ হত্যা, অত ধর্ষণ, অত জ্বালাও পোড়াও, সব প্রোপাগান্ডা। মুক্তিবাহিনী মূলত হিন্দু আর ইন্ডিয়ানদেরই একটা গ্রুপ যারা শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতো ও লুটপাট করতো। ভদ্রলোকের মামা রাগে কাঁপতে কাঁপতে যুবককে তখন একটা লম্বা বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমি বক্তব্যটা হুবহু তুলে দিচ্ছি।

‘আমি নিজে মুক্তিবাহিনীর লোক। আমি হিন্দুও না, ইন্ডিয়া থেকেও আসি নাই। অতএব তোমার শিক্ষায় ভুল আছে। একাত্তর সালে আমি তোমাদের আর্মির অত্যাচার দেখেছি। কিভাবে তারা নিরীহ মানুষ খুন করেছে আর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিজ হাতে গুলি করে তোমাদের আর্মিকে থামিয়েছি কয়েক জায়গায়। এই যে পিছনের সিটে বসা আমার ভাগ্নেটাকে দেখছো, ওর জন্ম ঐ যুদ্ধের সময়। ওর মা আমার ছোট বোন। সে আট মাসের প্রেগন্যান্ট অবস্থায় প্রায় আশি মাইল রাস্তা হেঁটে শহর থেকে গ্রামে পালিয়ে গিয়েছিল তোমাদের আর্মির হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি কোনো লোকমুখে শোনা গল্প বলছি না। আরও কিছু শুনতে চাও? তুমি যদি মুক্তিবাহিনী সম্বন্ধে আরেকটা বাজে কথা বলো, এখনই তোমার ট্যাক্সি থেকে আমরা নেমে যাবো।’

বাকি রাস্তা পাকিস্তানি যুবক আর একটাও কথা বলেনি। যখন ভদ্রলোক ট্যাক্সি থেকে নেমেছিলেন, যুবক নিজেও নেমেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার মা কি জীবিত আছেন? ভদ্রলোক মাথা ওপর নিচ করেছিলেন। যুবক বলেছিল, তোমার মাকে বোলো, একজন পাকিস্তানী তাঁর কাছে মাফ চেয়েছে।

পাকিস্তান পৃথিবীর কুৎসিত’তম রাষ্ট্র। ঘৃণ্য রাষ্ট্র। খবিশ রাষ্ট্র। এই বর্বর রাষ্ট্র তার নব্য প্রজন্মদের তাদের করা বর্বরতার ইতিহাস জানায়নি একফোঁটা। এই শুয়োরের বিষ্ঠামাখা রাষ্ট্র জানায়নি, চুকনগরের ফসলি জমিতে এখনও হাড়গোড় পাওয়া যায় মানুষের। কখনো সখনো পাওয়া যায় নারীর পরিহিত অলঙ্কার। জানায়নি সহস্র নারীর যোনীতে বেয়নেট ঢুকিয়ে পেটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলার গল্প। কিশোরগঞ্জের বরইতলার রেললাইনে অসংখ্য মানুষকে বসিয়ে এক এক করে ওদের মাথা ত্রিশ কেজি ওজনের বিশেষ শাবল দিয়ে চূর্ণ করে দিয়েছিল ওরা একদিন।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের ধরণ ও প্রক্রিয়া সম্বন্ধে গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তার থেকে অল্প একটু বলি:

▪️ ১. সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করা।

▪️ ২. শক্ত সমর্থ তরুণদের রাস্তা অথবা বাড়িঘর থেকে বন্দি করে অজ্ঞাত স্থানে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শারীরিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন শেষে হাত বেঁধে কখনও একজন কখনও অনেকজনকে একসাথে গুলি করে মেরে গর্ত অথবা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া।

▪️ ৩. লোকসংখ্যা বেশী থাকলে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা।

▪️ ৪. আপনজন সামনে থাকলে তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ব্যক্তিকে জবাই করা, দেহ টুকরো টুকরো করা।

▪️ ৫. ভীতি ছড়ানোর জন্য সবার সামনেই অসহায় মানুষদের অঙ্গচ্ছেদ করা।

▪️ ৬. চোখ উপড়ে ফেলা।

▪️ ৭. নগ্ন করে উল্টো করে বেঁধে মাথা থেকে পা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলা।

▪️ ৮. ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে করে মাথা চূর্ণ করে দেওয়া।

▪️ ৯. বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে মুখ বেঁধে অনর্গল পিটিয়ে হত্যা করা অথবা মুখ বন্ধ বস্তাসহ নদীতে ফেলে দেওয়া।

▪️ ১০. দড়ি দিয়ে ব্যক্তিকে বেঁধে অনবরত লাথি ঘুষি অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে করে মেরে ফেলা।

▪️ ১১. বাঁশ ও রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চেপে ধরে থেঁতলে দেওয়া।

▪️ ১২. বেয়নেট দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করা, নাড়িভুড়ি বের করা, বুক চিরে হৃদপিণ্ড উপড়ে নেওয়া।

▪️ ১৩. দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা।

▪️ ১৪. পানি, অগ্নিকুণ্ড অথবা বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা।

▪️ ১৫. মৃতপ্রায় মানুষ পানি খেতে চাইলে মুখে প্রস্রাব করা, মলমূত্রের ওপর মানুষটার মাথা চেপে ধরা।

▪️ ১৬. সিগারেটের আগুনে শরীরের সংবেদনশীল জায়গায় ছ্যাকা দেওয়া।

▪️ ১৭. মলদ্বার ও আশপাশের স্থানে বরফ অথবা উত্তপ্ত লোহা ঢুকিয়ে দেওয়া।

▪️ ১৮. চোখের সামনে লাইট জ্বালিয়ে আলো দিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া।

▪️ ১৯. গায়ে ও মলদ্বারে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া।

▪️ ২০. আঙুলে সুঁচ ফোটানো।

▪️ ২১. নখ উপড়ে ফেলা।

▪️ ২২. শরীরের চামড়া ছিলে লবণ ও মরিচ লাগিয়ে দেওয়া।

▪️ ২৩. পুরুষের অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ থেঁতলে দেওয়া।

▪️ ২৪. মেয়েদের যৌনাঙ্গে লাঠি, রাইফেলের নল, ধারালো বোতল জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া।

▪️ ২৫. ‘বাঁশ ঢলা’ দেওয়া।

▪️ ২৬. বরফের চাঙরের ওপর শুইয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা।

▪️ ২৭. বুলেট বাঁচাতে দা দিয়ে জবাই করা।

▪️ ২৮. তরুণীদের বাড়ি থেকে ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা, স্তন কেটে নেওয়া, অমানুষিক শক্তি ব্যবহার করে চুল টেনে চামড়া সহ উপড়ে ফেলা।

সর্বপ্রথম আশির দশকের গোড়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধফেরত মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দিয়েছিল। ভয়ানক যুদ্ধের সবটুকুন ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী যারা, যুদ্ধ শেষে বাকি জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল তাদের ঐ স্মৃতি, ঐ মৃত্যু, ঐ ট্রমা।

আমার মাঝেমধ্যে খুব জানতে ইচ্ছে করে, একাত্তরের যুদ্ধ ফেরত ঐ শুয়োরের জাতগুলো ঘুমোতে পেরেছিল কোনোদিন তারপর? ওদের কারোর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হয়নি? ওরা কী করে ঘুমিয়েছিল? ওরা সুখী হয়েছিল? ওদের বিবাহ হয়েছিল হয়তো। পুত্র সন্তান হয়েছিল, কন্যা সন্তানও হয়েছিল। ওরা নিশ্চয় ঐ কন্যার কপালে চুমু খেয়েছিল। চুলে হাত বুলিয়েছিল। ফোলা গাল দু’টো টিপে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল সপ্তাহে একবার। স্ত্রী সহ। কন্যা আবদার করেছিল হয়তোবা ঘাড়ে চড়ার। তারা নিশ্চয় ঘাড়েও চড়িয়েছিল তাকে। ঐ সন্তান থেকেছে পরম আদরে, বেঁচে আছে দুধে ভাতে।

কখনই ওই সন্তানের জানা হবে না, চার ঘণ্টায় বারো হাজার, প্রতি ঘণ্টায় তিন হাজার, প্রতি মিনিটে পঞ্চাশ এবং প্রতি সেকেন্ডে একজন করে মানুষ হত্যা করলে মাত্র দশটা সেকেন্ড বাকি থাকে ঘড়িতে, যে দশটা সেকেন্ড চুকনগরে মারার মতোন আর দশটা মানুষ খুঁজে পায়নি তার রক্তপিপাসু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সেবক। এক ভদ্রা নদীর রক্তের অংক কষতে এই জনম কাটবে তাদের। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটা শশ্মানের বাকি হাড়গোড় গুনার সময় কই আর।
.
সূত্রঃ
১. ‘২০ মে ১৯৭১: চুকনগর গণহত্যা’ – আহমাদ ইশতিয়াক (দ্য ডেইলি স্টার, ২০.০৫.২০২১)
২. ‘চুকনগর বধ্যভূমি’ – (ডুমুরিয়া, খুলনা, গর্ভমেন্ট বিডি সাইট)
৩. ‘চুকনগর গণহত্যা: পাকবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড’ – মোহাম্মদ এ. আরাফাত (বাংলা ট্রিবিউন, ২০.০৫.২০২০)
৪. ‘চুকনগর গণহত্যা’ – মুনতাসীর মামুন
৫. ‘৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ’ – ডা. এম এ হাসান (সংগ্রামের নোটবুক)
৬. আবদুল্লাহ ইবনে মাহমুদ

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: চুকনগর গণহত্যায় প্রায় ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ ছিলেন হিন্দু)