বাংলা ভাষা মৌলবাদী আগ্রাসনের শিকার



Updated: 15 November, 2024 6:14 am IST
Image: Hindu Voice Team
Image: Hindu Voice Team

অমিত মালী

আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে বাংলাদেশি নাটকের ছোট ছোট ক্লিপ প্রায়ই ওয়ালে ভেসে ওঠে। সেই সব নাটক বাংলা ভাষায় এবং বেশ কয়েকজন অভিনেতা -অভিনেত্রী তো আবার বাংলাদেশের(পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান) পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও পরিচিত। কিন্তু ওই নাটক দেখলে একটা বিষয়ে খটকা লাগে, তা হলো নাটকের চরিত্রদের মুখে ব্যবহৃত সংলাপের ভাষা। একটু শুনলেই মনে হবে – এ কেমন ভাষা? এটা কি বাংলা? আরবী, উর্দু আর কিসব মেশানো এক জগাখিচুড়ি ভাষা। আর যাই হোক, তা আর বাংলা ভাষা নয়।

সেই সব নাটকে প্রথম যেটা জঘন্য লাগে তা হলো ‘সালাম’। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাকে বলা হচ্ছে সালাম। এ আবার কেমন কথা? বাঙ্গালী চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে এসেছে, কখনও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেনি। বাঙ্গালী চিরদিন স্নান করেছে, কখনও গোসল করেনি। বাঙ্গালী চিরদিন মা কালীর পূজায় পাঠা বলি দিয়েছে এবং রবিবারে পাঁঠার মাংসে কব্জি ডুবিয়ে ভাত খেয়েছ। বাঙ্গালী কখনও বকরী জবাই করে তার গোশত খায়নি।

বাঙ্গালী বলে বিশ্বে বড়াই করে, বাংলা ভাষার আন্দোলনের চেতনার কথা বলে যদি সেই ভাষাটাই আর না থাকে, তাহলে একটু ভাবতে হয়। ভাবতে ভাবতে উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের ভাষার বিরাট পার্থক্য। পার্থক্য এতটাই যে চমকে ওঠার মত।

সোজা কথা আর না ঘুরিয়ে সরাসরি বলা যাক। বাংলাদেশের ভাষা ইসলামিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। যেভাবে ইসলামিক আগ্রাসনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে ধুতি, শাড়ি, লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্য; ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের বাংলা ভাষাও তার কৌলিন্য হারিয়েছে। মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত আর ইসলামি চেতনার মুখে বাংলা ভাষা আজ বড়ো অসহায়। ভাষার দেহের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে কিছু বেমানান অঙ্গ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাতে বাংলাদেশের বাংলা ভাষা যেনো কিম্ভুতকিমাকার এক ভাষায় দাঁড়িয়েছে।

বাঙ্গালী বরাবর কারওর কথার উত্তরে হ্যাঁ সূচক বলতে গিয়ে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘আজ্ঞে’ বলে এসেছে; ‘জ্বী’ বলেন। বাঙ্গালী তাঁর বন্ধুদের বাড়িতে আবহমান কাল ধরে ‘নিমন্ত্রণ’ জানিয়ে এসেছে; কখনও দাওয়াত জানায়নি। বাঙ্গালী বাড়িতে অতিথি আসে, ‘মেহমান’ আসে না। আর বাঙ্গালী যদিও বা পড়ে, তবে সে ‘সমস্যায়’, ‘পেরেশানিতে’ কখনই নয়। ফলে যারা নিজেদের মতো করে ভাষার অপারেশন করে তাঁর মধ্যে পরিবর্তন এনে সেটাকে আবার বাংলা ভাষা বলে চালাতে চাইছেন, সেটা মোটেও বাংলা ভাষা নয়। আর যারা ভাবেন যে বাংলা ভাষা বললেই যে বাঙ্গালী, কিংবা ভাষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেইসব আজব শব্দকে আপন করে নেবেন, তবে মহামুশকিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলা ভুল, পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিছু পাগল বলে বেড়াচ্ছে যে বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাঙ্গালী। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের আর বাংলাদেশের যারাই বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাঁরা সকলেই বাঙ্গালী। সেই যুক্তি অনুযায়ী, টিয়া পাখি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলে, তবে সেও বাঙ্গালী। কিন্তু একবার ভেবেও দেখে না যে বাংলাদেশের ভাষায় আর কতটুকু বাংলা শব্দ বেঁচে আছে। একবার ভেবেও দেখে না যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী স্নান করে, কিন্তু বাংলাদেশের বাঙ্গালী গোসল করে কেনো। কেনো পা ছুঁয়ে প্রণাম করাকে সালাম বলা হবে? সালামের পদ্ধতি আলাদা এবং তাকে সালাম বলা হোক, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কেন এই জগাখিচুড়িকে বাংলা ভাষা বলা হবে? কেন?

ফলে আজকের সময়ে ভাষা বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে ভারতের বাঙ্গালীকে।

কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে?

প্রথমত, একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে হবে যে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশী ভাষা আলাদা। প্রমান হিসেবে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ এবং বাংলাদেশী ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের পার্থক্য তুলে ধরা।

দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষাকে শুদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশী আগ্রাসনের ফলে যেসব শব্দ বাংলা ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়েছে , যেসব শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলি বর্জন করতে হবে। কোনো লেখায় সেসব শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। যেমন অনেকেই এখন ‘প্রাক্তন’ শব্দের বদলে ‘সাবেক’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। ‘সাবেক’ শব্দের ব্যাপক ব্যবহার হয় বাংলাদেশে, এটা ভুলে গেলে চলবে না।

তৃতীয়ত, আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক ভাষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। বাংলাদেশী ভাষা ও তাঁর সাহিত্য তার জায়গায় সসম্মানে থাকুক। আমাদের শুদ্ধতা গ্রহণ করুক বা না করুক, আমাদের ভাষার শুদ্ধতা সবার সামনে তুলে ধরা।

পরিশেষে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। নির্বাচিত সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপরে ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে। সেসব হামলা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যস্ত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমে আরবী ভাষা বাধ্যতামূলক করার কাজে। ফলত দেশটির স্বাধীনতার চেতনা আজ প্রশ্নের মুখে।