© সংগ্রাম দত্ত
মণিপুরিদের সব থেকে বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরিদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুরের জোড়াম-পেই সর্বপ্রথম প্রায় ১৮১ বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪২ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে।
কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের প্রায় অর্ধলক্ষ ভক্ত-দর্শক মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন।
কথিত আছে, রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র একদিন স্বপ্নে দেখতে পান রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলা। তারপর তিনি স্বপ্নের আলোকেই উপস্থাপন করেন রাসলীলার রাসনৃত্য। তিনি কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো রাসলীলা করান। তাঁর নিজ মেয়ে কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন এবং তিনি নিজেই ওই রাসে মৃদঙ্গবাদক ছিলেন। তাতে তিনি নিজস্ব তাল ব্যবহার করেন। তাঁর সে তালই এখন পর্যন্ত চলছে। জানা গেছে যে ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেন রাসনৃত্য।
মহারাজার মৃত্যুর একশ বছর পরে মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে গোটা রাসনৃত্য আচৌকা, বৃন্দাবন, খুডুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন, আচৌবা বৃন্দাবনসহ নানা ভঙ্গির পর্যায়ে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তি এ উৎসবকে আরও বেশি জনপ্রিয় করতে উৎসবকে মণিপুরিদের মাঝে ছড়িয়ে দেন।
মণিপুরিদের তিনটি গোত্র। এর একটি মৈতেই, আরেকটি বিষ্ণুপ্রিয়া সবশেষ মৈতেই পাঙান। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতেই গোত্রের লোকরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। এরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। এছাড়া মৈতেই পাঙানরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে সব মণিপুরিরই প্রধান বার্ষিক উৎসব রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা।
জানা গেছে যে, ১৮৪২ সালে মাধবপুরের জোড়া মণ্ডপেই মণিপুরি রাজ্যের বাইরে প্রথম রাসলীলার সূত্রপাত। রস থেকেই রাস শব্দের উৎপত্তি। রাস হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস। আর লীলা মানে খেলা। অর্থাৎ রাসলীলার মানে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও তাদের সখী-সাথীদের লীলাখেলা। মণিপুরি সমাজে রাসনৃত্য আবার ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও উদুখলরাস। এর মধ্যে মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা উৎসবের শুরুটা হয় গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য দিয়ে। এ নৃত্য হয় সকালে। যারা রাখাল নৃত্য করে, তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপী ভোজন করে।
গোপী ভোজন হল বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারি ও ভাত। এ খাবার খেয়েই রাখাল নৃত্য শুরু করে শিল্পীরা। সকালে শুরু হয়ে রাখাল নৃত্য একটানা চলে বিকেল পর্যন্ত। মণিপুরি শিশু-কিশোররা এ নৃত্য পরিবেশন করে। যারা নৃত্য করে, তারা এক ধরনের বিশেষ পোশাক পরে। ঝলমলে এ বিশেষ পোশাকের নাম ‘পলয়’। এ পোশাকের পরিকল্পনা করেছিলেন রাজা ভাগ্যচন্দ্র। রাখাল নৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো কৃষ্ণ ও তার সাথীদের নিয়ে। গোলাকার মণ্ডপে কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দল বেঁধে এ নৃত্য পরিবেশিত হয়। রাখাল নৃত্যের পাশাপাশি দিনভর চলতে থাকে মণিপুরিদের নিজস্ব সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড। সন্ধ্যার পর শুরু হয় রাসপূর্ণিমার রাসলীলা বা রাসনৃত্য। রাসনৃত্য পরিবেশনা করে মণিপুরি কুমারি মেয়েরা। রাস নৃত্যের সময়ও পলয় পরা হয়। পলয় পোশাকের মাথার উপরিভাগের নাম ‘কোকুতম্বি’।
এ পোশাকের মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণ থাকে। তার নাম ‘মাইমুখ’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের বস্নাউজ। পরনে থাকে ঘন সবুজ রঙের পেটিকোট, যা শক্ত বক্রমের দ্বারা গোলাকৃতি ও ভাঁজমুক্ত করা হয় এবং অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। পলয়ের এ অংশের নাম ‘কুমিন’। জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান খাওন, খবাংনপ পলয়ের অংশ। এছাড়া পলয়ের সঙ্গে কলথা, খবাংচিক, খুঁজিসহ ইত্যাদি স্বর্ণালঙ্কারও নৃত্যশিল্পীরা পরেন।
রাসনৃত্যও গোলাকার মণ্ডপে কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দলবেঁধে পরিবেশিত হয়। রাসনৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো রাধা ও তার সখীদের নিয়ে। এ নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের শুরু, মান-অভিমান এবং শেষে মিলন দেখানো হয়। রাসলীলা উপলক্ষে মণিপুরিরা বিভিন্ন সবজি, ডাল, গাছের লতাপাতা দিয়ে উতি, পাকাউরা, সৈবুম, ইরোলবা নামের বিশেষ খাবার তৈরি করে। ম-পে সবাই লাইন ধরে বসে কলাপাতায় এ খাবার খান। এছাড়া মণিপুরি মেয়েরা নিজেদের তাঁতে বোনা শাড়ি পরেন।
এসব শাড়ির নকশা হয় কালো রঙের পাড় এবং সবুজ, খয়েরি, ছাইসহ বিভিন্ন রঙের লম্বা চেকের মাধ্যমে। এছাড়া পুরুষরা পরে সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি, আর গলায় থাকে ওড়না। রাসলীলা উপলক্ষে গ্রামীণ পণ্যের মেলাও বসে। এছাড়া অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, গুণীজন সংবর্ধনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে মণিপুরিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তলোয়ার নৃত্য, মশাল নৃত্য, মার্শাল আর্ট, নাচ, ঢোলক নৃত্যসহ বিভিন্ন নাচ-গান উপস্থাপন করে। মণিপুরিদের উৎসব কেবল আর মণিপুরিদের মধ্যে নেই। এই উৎসবটি এখন ওই এলাকায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। সিলেট ছাড়াও রাস উৎসব হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে । এখানে ভিড় করে প্রচুর পুণ্যার্থী।