© অতীন দাশ
দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন অবিভক্ত ভারতের জনসংখ্যা ৩৯ কোটি। বিভাজনের মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে লোকসংখ্যা ৬ কোটি, ভারতের জনসংখ্যা তখন ৩৩ কোটি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজন হওয়া সত্ত্বেও সেই পরিচয়ে লোকবিনিময় হল না। ভারতে যেমন মুসলমানদের গরিষ্ঠ সংখ্যক থেকে গেলেন, তেমনি পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে অমুসলমান সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছিল ২৩ শতাংশ। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ থেকে হিন্দু, শিখ আহমদিয়াদের ব্যাপক দেশত্যাগ ঘটে। এখন সেই অংশে, যা পাকিস্তান নামের পরিচয় বহন করছে, অমুসলমানদের সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম। পূর্ব পাকিস্তানে দেশবিভাগের পর হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মিলিয়ে সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। এখন দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ আবুল বরকত প্রায় ২০ বছর আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে। প্রায় এই সময়ই সুলতানা নাহার নামে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী ‘সাবিত্রী একটি হিন্দু মেয়ের নাম’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানতেও পারবে না, হিন্দু নামে একটি উচ্চ ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষ একদিন এদেশে বাস করতেন।’ এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫০ বছরের ধারাবাহিকতা সেই বাস্তবতার দিকেই এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সেই গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। যারা মৌলবাদী, তারা প্রকাশ্যেই বলছে, ইসলাম অন্য মতকে কখনও বরদাস্ত করতে পারে না, কোনও বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে না, প্রবঞ্চনার মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করতে হবে, কাফেরদের ঈমানে নিয়ে আসা প্রতিটি মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য। তাই তাদের প্রকাশ্য ঘোষণা, বাংলাদেশে থাকতে হলে ধর্মান্তরিত হও, না হলে দেশ ছাড়ো, অন্যথায় মৃত্যুর দিন গুনতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি, তার সভানেত্রী প্রাক্তন- প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক মন্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সংঘটিত অত্যাচার দেখে মনটা বিষাদগ্রস্ত হয়, কিন্তু এ তো স্বাভাবিক, মুসলমান প্রধান দেশে এটা তো ঘটবেই, এখানে থাকতে হলে ধর্মান্তরিত হতে হবে, না হলে দেশ ছাড়তে হবে। সুতরাং বার্তা খুবই স্পষ্ট। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশন করছে। কিন্তু গত একমাসে সারাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ১০৬৮টি ঘটনা ঘটেছে, এর একটিরও কি কোনও প্রতিকার হয়েছে? শেখ মুজিব থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, মহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনার আমল পর্যন্ত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ওপর যে হাজার হাজার আক্রমণ ঘটছে, তার একটিরও বিচার হয়নি। হিন্দু নিপীড়নে, হিন্দু বিতাড়নে সব সরকারেরই একই ভূমিকা। ইসলামিক শরিয়ার শাসন চালু করতে হলে দেশকে অমুসলিমশূন্য করতেই হবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় আট দশক ধরে হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন চলছে, ব্যাপক ধর্মান্তরণ আর নীরব দেশত্যাগ চলছে, কেউ কখনও মুখ খুলে কোনও প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু এখন পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে, বাঁচতে হলে লড়তে হবে। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুরা রাস্তায় নেমে ধ্বনি দিচ্ছেন, ‘এদেশ কারও বাপের না/এদেশ আমরা ছাড়ব না।’ এ কথার সত্যতা শুধু বাংলাদেশের জনগণ বা কর্তৃপক্ষকে নয়, ভারত-সহ বিশ্ব সমাজকে অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের দাবিদার কিছু স্বার্থপর ভণ্ড নেতা এই দেশটাকে তাঁদের বাপের জমিদারি ভেবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছিলেন, এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল বিপর্যয়, আজও যার জের চলছে।
দেশ বিভাগের সনদে যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই অপরিণামদর্শী তথাকথিত জাতীয় নেতাদের আশ্বাস – ছিল, ইসলামিক পাকিস্তানে যে সমস্ত হিন্দু থেকে গেলেন, তাঁরা যখনই ওই দেশে নিরাপত্তার অভাববোধ করবেন, তখনই ভারতে চলে আসতে পারবেন। তাঁদের জন্য দ্বার অবারিত। ভারতের নাগরিক হিসাবে সমান মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু তা ছিল শুধু মুখের কথা। ভারতের এত বড়ো সংবিধানে সম্ভাব্য শরণার্থীদের জন্য একটি লাইনও লিখে রাখা হয়নি। কেউ কথা রাখেনি। স্বাধীনতার অমৃতযুগ চলছে। সবাই অমৃতপান করছেন আর স্বাধীনতা যজ্ঞের আহুতিস্বরূপ একটি জাতি চরম মূল্য চুকিয়ে চলেছে, যার নজির পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাই আজ কারও ওপর ভরসা নয়, ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের নিজের ভবিষ্যতের লক্ষ্যে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। দেশ ভাগ হয়ে যখন পূর্ব পাকিস্তান তৈরি হল, তখন বলা হত, ৫২ হাজার বর্গ মাইলের একটি দেশ। এই ৫২ হাজার বর্গ মাইল নাম দিয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বইও লিখেছিলেন। এখন অবশ্য সেই পরিধি আরও বেড়েছে। এখন বাংলাদেশের ভূমির পরিমাণ ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। এটা ঐতিহাসিক সত্য, দেশ যখন ভাগ হল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে ভূ-সম্পদের সিংহভাগেরই মালিক ছিলেন হিন্দুরা। ৩০ ভাগ অমুসলমানের হাতে ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ জমি। সেই সম্পদ হস্তান্তরিত হয়েছে, বেদখল হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এতসব কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। আজ যখন সার্বিক বিতাড়নের মুখে হিন্দুরা, তখন ন্যায়সঙ্গত ভাবেই তাঁদের হিস্যা দিয়ে দিতে হবে। বিতাড়িত হিন্দুদের যেহেতু কোথাও স্থান নেই, তাই পিতৃপুরুষের ভিটেতেই তাঁদের পুনর্বাসন দিতে হবে। মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারেন না, সেই দাবিতেই পাকিস্তান সৃষ্টি। ভারত থেকে আনুপাতিক হারে তাঁরা জমি নিয়ে নিয়েছেন। বিতাড়িত হিন্দুদেরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আনুপাতিক হারে জমি দিতে হবে। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের ৩০ শতাংশ ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার জমির উপর দাবি রয়েছে হিন্দুদের, এটা আদায় করতে হবে।
এই দাবি অবশ্যই নতুন নয়। বাংলাদেশে নমঃশূদ্র সমাজের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। দেশ বিভাজনের ফলে লক্ষ লক্ষ নরনারীর জীবন যখন বিড়ম্বিত, উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের পুনর্বাসন করে নিচ্ছেন শ্রেণিগত সুবিধায়, তখন পিছিয়ে পড়া জনগণের হয়ে কথা বলার কেউ ছিলেন না। পূর্ববাংলায় নির্যাতিত হয়েছেন নমঃশূদ্র, কৈবর্ত, হেলে চাষি, সাধারণ মানুষ। এপারে এসেও তাঁদের পুনর্বাসন ঘটেনি, পশ্চিমবাংলায় চিরদিনই উদ্বাস্তুরা উপেক্ষিত, নির্যাতিত, অবাঞ্ছিত থেকেছেন। বিভিন্ন রাজ্যে নিজের চেষ্টায় পুনর্বাসন পেলেও পাননি মানবিক মর্যাদা। কেন্দ্র সরকার কোনওদিন সদয় ছিল না বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি।
বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ভারত সরকারের বেইমানি, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের অমানবিক ব্যবহারে এতই তিক্তবিরক্ত হন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য একটা আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি যথেষ্ট যুক্তি সহকারে তুলে ধরেন। তিনি এতই দূরদর্শী ছিলেন যে, তখনই বুঝতে পারেন বাংলাদেশ বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র হবে, হিন্দুরা কখনওই সুবিচার পাবেন না। তাঁদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তিনি বরিশাল, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, দিনাজপুর, নদিয়া, ২৪ পরগনা নিয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য একটা আলাদা হোমল্যান্ড দাবি করেন। তাঁর যুক্তি ছিল ক্ষুরধার। ৪৫ হাজার আরব উদ্বাস্তুর জন্য প্যালেস্তাইনের পক্ষে যদি বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে পারে, তাহলে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুর জন্য আলাদা রাষ্ট্র হবে না কেন, যেখানে তাঁরা মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে পারবেন? পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার এই দাবিকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে কুৎসা রটায়। শেখ মুজিবুর রহমান বীরেন্দ্রনাথকে জানতেন। তিনি তাঁকে আশ্বাস দেন হিন্দুদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। আন্দোলন আর দানা বাঁধতে পারল না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দাবি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা আর থাকতেই পারবেন না। মাত্র ২২,১৪৫ বর্গ কিলোমিটার ভূমি নিয়ে গঠিত দেশ ইজরায়েল পৃথিবীর সমস্ত ইহুদির যেমন ভরসার স্থল, তেমনি প্রায় পাঁচ কোটি বিস্থাপিত বাঙালি হিন্দুর জন্য কি একটা আলাদা দেশ হতে পারে না? পাশেই মলদ্বীপ, যার আয়তন মাত্র ৩০০ বর্গ কিলোমিটার, লোকসংখ্যা সোয়া ৫ লক্ষ। তাঁরা যদি সম্মানের সঙ্গে বাস করতে পারেন, তাহলে স্বাধীনতার বলি বাঙালি হিন্দুদের কেন এই অধিকার দেওয়া হবে না? দলমত নির্বিশেষে ভারতীয় নেতৃবর্গকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে, আন্তর্জাতিক সমাজেরও সহযোগিতা কাম্য। এটা মানবাধিকারের প্রশ্ন।
লেখক পরিচিতি: বর্ষীয়ান সাংবাদিক অতীন দাশ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। প্রাবন্ধিক হিসেবে সুখ্যাতি রয়েছে। বাঙালি হিন্দুদের দুর্দশা ও বঞ্চনা নিয়ে বরাবরই সরব তিনি।