© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
পশ্চিম বাংলা তথা পূর্ব ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরের একশো কুড়ি মাইল উত্তরে মুর্শিদাবাদ জেলায় সারগাছি নামে একটি গ্রাম আছে। সারগাছি শব্দের অর্থ হচ্ছে ঘন গাছের ঝাড় সমুহ। বঙ্গদেশে বনজ সম্পদ প্রভূত থাকলেও ধন-সম্পদের মাত্রা চিরকালই কম। সাধারণ লোকেরা অধিকাংশ নির্ধন এবং গরীব দুঃখীর মত করে জীবন কাটাতে অভ্যস্থ।
এটা 1896 সালের ঘটনা। এক যুবক সন্ন্যাসী ঘুরতে ঘুরতে ওই গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন। ইনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য এবং স্বামী বিবেকানন্দের গুরু ভাই। গঙ্গার তীর বরাবর যাত্রা করে গঙ্গোত্রী পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল এই যুবক সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্য। তিনি ভাবতেন হিমালয়ের কোন সুন্দর গুহার মধ্যে বসবাস করে সেখানেই ধ্যান ও জপতপ করেই কাটাবেন এই জীবন। এই ভাবনা নিয়েই কলকাতা থেকে চলতে চলতে যুবক সন্ন্যাসী এসে পৌছলেন মুর্শিদাবাদ জেলার
সারগাছিতে।
গ্রামে পৌঁছে তিনি দেখলেন গ্রামে পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই। গ্রামবাসীরা কষ্ট করে দূর থেকে পানীয় জল নিয়ে আসছে। এইসব গ্রামবাসীদের মধ্যেই ছিল একটি ছোট্ট চাষি ঘরের মেয়ে। তার মাথায় কলসি ভরা জল নিয়ে সে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। হঠাৎই রাস্তায় পাথরে ধাক্কা লেগে পড়ে গেল মেয়েটি । তরুণ স্বামীজি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে উঠালেন। মেয়েটির আঘাত কোথাও না লাগলেও তার কলসীটি ভেঙে গিয়েছিল। মেয়েটি সেই কারণে কাঁদতে আরম্ভ করল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল যে কলসী ভেঙে ফেলার জন্য তার বাবা তাকে মারবে। তরুণ সন্ন্যাসী তখন তাকে একটা নতুন কলসী এনে দিলেন । তখন সে শান্ত হয়ে আবার জল আনতে চলল।
সন্ন্যাসীর এই দয়ার কথা আশেপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সবাই এই দয়াবান সন্ন্যাসীকে দর্শন করবার জন্য আসতে লাগলেন এবং সন্ন্যাসী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে পরিচয় করলেন। গ্রামবাসী গণ তাদের দুঃখ-দুর্দশা র কথা তরুণ সন্ন্যাসীকে বলতে লাগলেন আর সন্ন্যাসীও যেন গ্রামবাসীদের মধ্যে দরিদ্র নারায়নের সাক্ষাৎ করলেন। তিনি শুরু করলেন গ্রামবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার পরিকল্পনা। গ্রামবাসীরাও তাঁর কথামতো কাজ করতে লাগল এবং সেখানে এক সুন্দর আশ্রম তৈরি করল।
প্রতিদিন রাত্রে নিদ্রা যাওয়ার সময় সেই সন্ন্যাসী স্থির করতেন বাকি কাজ পূর্ণ হয়ে গেলেই তিনি এইখান থেকে গঙ্গোত্রীর পথে যাত্রা করবেন, কিন্তু পরদিন আবার সকল গ্রামবাসী সঙ্গে কথাবার্তা হত আর পূর্বের সব কথা ভুলে গিয়ে গ্রামবাসীদের কল্যাণের কাজে মগ্ন হয়ে যেতেন। এইভাবে মাস, বছর কাটার পর সন্ন্যাসী সিদ্ধান্ত করলেন যে এই সারগাছি গ্রামই তাঁর হিমালয় এবং গঙ্গোত্রী।
গ্রামের মানুষদের সেবা করাই তাঁর জীবনের ধ্যান-ধারণা ও তপস্যা। তিনি এখন থেকে সারগাছিতে থেকেই গ্রামবাসীর সেবাকার্য করাকে নিজের জীবনের কর্তব্য বলে স্থির করলেন। তাঁর এই মনের কথা পত্র দ্বারা তিনি জানালেন তাঁর গুরুভাই তথা বিশ্ববন্দিত সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকে। অত্যন্ত খুশি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সারগাছি আশ্রমের জন্য দুজন দক্ষ কার্যকর্তা এবং প্রচুর অর্থ পাঠালেন। তরুণ সন্ন্যাসীকে লেখা এক পত্রে স্বামী বিবেকানন্দ লিখলেন :
” যেমন যেমন তোমার কাজের বিস্তারিত সংবাদ আমি পাচ্ছি তেমন তেমন আমার মন আনন্দে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। একথা সত্য যে এই ধরনের কাজের দ্বারাই বিশ্ব বিজয় হতে পারে, এ ধরনের কাজে না জাতিভেদ না মতভেদ এর কোন স্থান আছে। তুমি ধন্য। তোমাকে আমি আমার হৃদয়ের কোটি কোটি ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ জানাচ্ছি। “
সেই তরুণ সন্ন্যাসী তারপর সারা জীবন সারগাছিতে থেকে জনসেবার মাধ্যমে জীবন কাটিয়ে ছিলেন। ধুপ যেমন নিজে জ্বলে সর্বত্র গন্ধ বিতরণ করে ঠিক সেরকমই তিনি নিজের জীবন অপরের সেবায় ব্যয় করেছিলেন। এভাবেই জনসেবা করতে করতে যখন সেই তরুণ সন্ন্যাসী বৃদ্ধ হয়েছেন, তখন একদিন তাঁর সাক্ষাতে এলেন এক তরুণ মারাঠি যুবক। তিনি এক সদাচারী শিক্ষকের পুত্র। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় এমএসসি ডিগ্রী অর্জন করেছেন এই যুবক। বংশের একমাত্র প্রদীপ তিনি। বাবা – মায়ের ইচ্ছা ছিল এই মেধাবী সন্তান যেন বিবাহ করে সংসার ধর্মে স্থিত হয়। কিন্তু যুবকের মনে তখন দেশসেবার কাজে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার ইচ্ছা। ভারতের সনাতন ধর্ম , সংস্কার তাঁর মনে। প্রকৃতিগত ভাবে সাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্বিক।
তাই মাকে বুঝিয়ে দেশ সেবার জন্য ততদিনে গৃহ ত্যাগ করেছেন তিনি। আজকের সমাজে যেখানে পরিবারকে দেখাশোনার জন্য জীবিকা নির্বাহ করা আমাদের জীবনের নিয়ম, সেখানে যুবক মাকে বুঝিয়েছিলেন যে দেশসেবার জন্য তাঁর পরিবারের ধারা যদি বিনষ্ট হয় তো হোক, তবুও তিনি বংশ রক্ষাr দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেশসেবার কর্তব্যে অবিচল। সেই যুবকই ঘুরতে ঘুরতে তাঁর জন্মস্থান নাগপুর থেকে এসে পড়লেন সারগাছি আশ্রমে: সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলেন গৈরিক বসন ধারী সন্ন্যাসীকে । সন্ন্যাসী তাঁর পাশে বসালেন যুবককে। কিছু প্রশ্ন করে নাম, ধাম ও যুবকের পারিবারিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নিলেন। তারপর বললেন :
” তুই এতদিনে এলি! অনেক দেরি হয়ে গেল তোর।
আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি, অসুস্থ হয়ে পড়েছি, বেশ পরিশ্রান্ত বোধ করছি। সুতরাং আমি কি তোকে আর পথ প্রদর্শন করতে পারব ? “
মারাঠি যুবক বললেন :
” স্বামীজি আপনি আমাকে শুধুমাত্র আপনার সেবা করার সুযোগ দিন। আপনার সেবা করতে পারলে আমি সবকিছুই পাব। উপযুক্ত সময় দেখে আমাকে অনুগ্রহ করলে আমি কৃতার্থ হব। “
স্বামীজি বললেন , ” ঠিক আছে তুমি এখানেই থাকো, তারপর ঠাকুরের যেমন ইচ্ছা হবে তেমন হবে। “
স্বামীজীর মুখ থেকে এই শব্দ শোনা মাত্র মারাঠি যুবক অত্যন্ত আনন্দ পেলেন এবং সেই মুহূর্ত থেকে সেই সন্ন্যাসীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। সন্ন্যাসীর পূজার সমস্ত দ্রব্য সম্ভার প্রস্তুত করা, ভোজন তৈরি করা, আশ্রম ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, বাসন মাজা, কাঠ কাটা, কাঠ চেরাই করা প্রভৃতি নানা ধরনের কাজ অত্যন্ত তৎপরতা সহযোগে করতে থাকলেন প্রাণিবিদ্যায় মাস্টার্স করা সেই মারাঠি তরুণ। দিবারাত্র যখনই সন্ন্যাসী তাঁকে ডাকতেন, তখনই হাতজোড় করে তিনি সেখানে উপস্থিত হতেন। ধীরে ধীরে সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন মারাঠি যুবকের গুরুদেব। গুরুদেব যুবকের বহু কঠিন পরীক্ষা নিতেন আর সমস্ত পরীক্ষাতে উত্তমরূপে উত্তীর্ণ হতেন তিনি। এভাবেই সন্ন্যাসী প্রসন্ন হলেন সেই যুবকের প্রতি।
অবশেষে এলো 1937 সালের 13 ই জানুয়ারি। মকর সংক্রান্তির শুভ দিন। গুরুদেব দীক্ষা দিলেন তাঁর প্রিয় মারাঠি শিষ্যকে। আর আশীর্বাদ করে বললেন:
” তোমাকে হিমালয়ে যেতে হবে না, পর্বত গুহায় গিয়ে বসতে হবে না, তোমাকে জনসমাজের কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে। এক মহান কার্য অপেক্ষা করছে তোমার জন্য তুমি যেখানেই যাবে সেখানেই যশ প্রাপ্ত হবে। আর দেখ তোমার এই সুন্দর কেশরাশি আর দাড়ি তোমার মুখমন্ডলে অপূর্ব শোভা দিচ্ছে – এগুলোকে কক্ষনো তুমি কেটো না । “
এর কয়েকদিন বাদেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন সন্ন্যাসী। অনেক ধরনের চিকিৎসা করেও শরীর আর সুস্থ হল না সন্ন্যাসীর। উত্তম চিকিৎসার জন্য আশ্রমবাসীরা সন্ন্যাসীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থ করলেন। স্বামীজীকে বেলুড়মঠে নিয়ে আসা হল। স্বামীজীর নির্দেশে মারাঠি যুবকও এলেন স্বামীজীর সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য। গুরুদেবের পাশে বসে রাতের পর রাত কাটাতেন সেই মারাঠি যুবক। স্বামীজীর সেবার কোন ত্রুটি রাখতেন না। কিন্তু তবুও মানুষ মাত্রই মরণশীল, তাই এসে গেল সেই দিন – 7 ফেব্রুয়ারি 1937 : ইহলীলা সাঙ্গ করলেন সেই সন্ন্যাসী। তবে দেহত্যাগ করবার আগে প্রিয় শিষ্যকে কাছে বসিয়ে উপদেশ দিলেন । স্বামীজীর দেহত্যাগ ব্যথিত করল মারাঠি যুবককে। গুরুর নির্দেশে তিনি কামারপুকুর জয়রামবাটি প্রভৃতি পবিত্র স্থান দর্শন করে, দেড় মাস যাবৎ কলকাতায় থেকে 1937 সালের মার্চ মাসে ফিরে গেলেন নাগপুর। সেখানে আরেক বড় দায়িত্ত্ব অপেক্ষা করছিল যুবকের জন্য। সে দায়িত্বও তিনি কাঁধে নিলেন এবং আমৃত্যু সফলতার সঙ্গে পালন করলেন ।
পাঠক , নিশ্চয় ভাবছেন
শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্য এই সন্ন্যাসী আর এই মারাঠি যুবকের নাম। এই সন্ন্যাসী হলেন শ্রীমৎ স্বামী অখন্ডানন্দ ( 1864- 1937) আর মারাঠি যুবক হলেন মাধব রাও সদাশিব গোলওয়ালকার ( 1906 – 1973) যিনি শ্রী গুরুজী নামে অধিক পরিচিত।
স্বামী অখন্ডানন্দ ছিলেন আধুনিক কালের ভারতের গ্রামোন্নয়ন এর প্রথম কান্ডারী। 1934 থেকে 1937 পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ পদে আসীন হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের এই গুরুভাই। আর তাঁর প্রিয় শিষ্য গোলওয়ালকর ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক। 1940 থেকে 1973 পর্যন্ত দীর্ঘ 33 বছর সংঘকে পরিচালনা করেছেন তিনি : বিস্তৃত করেছেন সারা ভারতে: তাঁর উৎসাহে তৈরি হয়েছে ভারতীয় মজদুর সংঘ , অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ প্রভৃতি বহু বিবিধ সংগঠন যা সংঘের আদর্শকে নিয়ে গেছে অনেক অনেক মানুষের কাছে। দাদরা ও নগর হাভেলির স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ: চীন ভারত যুদ্ধে, 1965 সালের পাক- ভারত যুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করতে , কন্যাকুমারিকাতে বিবেকানন্দ মন্দির নির্মাণ করতে সংঘের স্বয়ংসেবকরা যে অভিযান চালিয়েছিলেন এবং যে
আত্মত্যাগ করেছিলেন সেটা স্বামী অখন্ডানন্দের শিষ্য এই গুরুজীর অনুপ্রেরণাতেই।
আজ শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ- দুটি সংগঠনই বটবৃক্ষের ন্যায় সারা পৃথিবী জুড়ে প্রসারিত। দুটি সংগঠনই হিন্দুত্ববাদী, যদিও তাদের কর্মধারা পৃথক। তবে দুই সংগঠনের অন্তরাত্মা যে এক সেটা বোঝা যায় স্বামী অখন্ডানন্দজী আর গোলওয়ালকারজীর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার এবং তার তাৎপর্য মূল ধারার ইতিহাসে ব্রাত্য। কারণ স্বাধীন ভারতের মূলধারার ইতিহাস লেখা হয়েছে সেক্যুলার দৃষ্টি ভঙ্গী থেকে। আর এই দুই মহাত্মার কেউই সেক্যুলার ছিলেন না। তবে মানুষের হৃদয় জুড়ে যে এনারা আছেন সেটা বোঝা যায় তাঁদের সংগঠনের বিস্তার দেখে। মনে হয় না কোন সেক্যুলার সংগঠন রামকৃষ্ণ মিশন বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মত এত বিস্তৃত।