© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
আসন্ন শিবরাত্রি উপলক্ষে আজ পড়ুন শিব তীর্থ ও রাম তীর্থ রামেশ্বরম এর কথা ।
দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে যে দুটি জ্যোতির্লিঙ্গ দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত তার মধ্যে একটি হল রামেশ্বর। শ্রীরামের স্মৃতি বিজড়িত রামেশ্বর সমুদ্রের শ্বেতশুভ্র জলরাশি বেষ্টিত একটি সবুজ দ্বীপ। এই দ্বীপ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ভারতের পুরাণ ও ইতিহাসে : মূল ভারত ভূমির বাইরে হয়েও ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অপরিহার্য অঙ্গ এই দ্বীপ। মাত্র ৩৪ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফল সমন্বিত এই দ্বীপের সাক্ষাৎ মিলবে ভারতের ভূখণ্ড পার হয়ে ১৯ কিলোমিটার গেলে । এই সেই দ্বীপ যেখানে মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরাম এবং পরমারাধ্যা জানকী দেবীর দ্বারা স্থাপিত জ্যোতির্লিঙ্গ বিরাজ করছেন। রামেশ্বর শব্দের অর্থ হল শ্রীরামের ঈশ্বর। দেবাদিদেব মহাদেব হলেন শ্রীরামের ঈশ্বর। আবার রামেশ্বর শব্দের অর্থ ‘শ্রী রাম যার ঈশ্বর’ – এটাও বোঝায়। এই অর্থেও রামেশ্বর দেবাদিদেব মহাদেবকেই বোঝায়। কারণ দেবাদিদেব মহাদেব এবং ভগবান শ্রীরাম – এই দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক বর্তমান। তুলসী দাসের শ্রীরামচরিতমানস গ্রন্থে আমরা দেখি দেবী পার্বতীকে রামকথা শোনাচ্ছেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। যাইহোক রামেশ্বর অতি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। রামেশ্বরে জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত সম্বন্ধে দুটি কাহিনী শোনা যায়। দুটি কাহিনীর সঙ্গেই জড়িয়ে
রয়েছে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামের নাম।
প্রথম কাহিনী এইরূপ :
রাক্ষসরাজ রাবণ লঙ্কাতে হরণ করে নিয়ে গিয়েছেন সীতাদেবীকে। বানর সেনা নিয়ে শ্রী রামচন্দ্র এবং লক্ষণ গেলেন ভারতের শেষ ভূখণ্ড মন্ডপমে। সামনে উত্তাল সমুদ্র। সীতাদেবীকে উদ্ধার করতে গেলে পার হতে হবে এই সমুদ্র। কিন্তু কিভাবে?
শ্রী রামচন্দ্রের নির্দেশে বানর সেনারা সারাদিন ধরে যা হাতের কাছে পায় তাই দিয়ে সেতু বাঁধার চেষ্টা করে। কিন্তু রোজ রাতে রাবণ এসে সেই সেতু ভেঙে দেয় শ্রীরামের সেতু আর এগোতে পারে না।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর শ্রীরামের অন্যতম সেনাপতি জাম্ববান বললেন রাবণ পরম শিবভক্ত। তাই যতটা সেতু বাধা হবে তার শেষ প্রান্তে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত করে পূজা করে এলে রাবণ আর সেতু ভাঙতে পারবেন না ,কারণ সেতু ভাঙলে শিবলিঙ্গের ক্ষতি হবে।
যথারীতি জাম্ববানের কথামত কাজ হল। সারাদিন সেতু বাধার পর শ্রী রামচন্দ্র শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করলেন আর পুজো করে ফিরে এলেন। রাত্রে রাবণ এসে সেতু ভাঙার পরিবর্তে শিবলিঙ্গকে প্রণাম করে ফিরে গেলেন। শ্রীরামচন্দ্র যে জায়গাটিতে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই জায়গাটির বর্তমান নামই রামেশ্বরম। কথিত আছে শ্রীরামচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে পূজিত হচ্ছেন আজও।
দ্বিতীয় কাহিনীটি এইরূপ:
রাম রাবণের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে দুর্গা মাতার বলে বলিয়ান হয়ে শ্রী রামচন্দ্র বধ করলেন রাবণকে। উদ্ধার করলেন সীতাকে ।কিন্তু রাবনকে হত্যা করে শ্রীরামচন্দ্র ব্রহ্মহত্যা পাপে পতিত হলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রাবণের পিতা বিশ্রবা মুনি ছিলেন ব্রাহ্মণ, আর মাতা কৈকেসি ছিলেন রাক্ষস। তাই রাবণ ছিলেন ব্রহ্মরাক্ষস।
এমতাবস্থায় শ্রীরামচন্দ্র শরণাপন্ন হলেন মুনি এবং ঋষিগণের। তাঁরা সবাই এক বাক্যে ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপ দূর করার জন্য শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজার পরামর্শ দিলেন।
ভগবান শ্রীরাম তখন হনুমানকে কৈলাস পর্বত থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন। হনুমান কৈলাস পর্বতে গেলেন কিন্তু শিবের দেখা তিনি পেলেন না। এদিকে জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা দিনক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার উপক্রম। সীতাদেবী তখন সমুদ্রের বালি দিয়ে করলেন এক শিবলিঙ্গ। সেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা হল। পূজা করলেন শ্রীরামচন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গমূর্তির মূল প্রোথিত হলো ধরিত্রীর কেন্দ্রবিন্দুতে।
শ্রী রামচন্দ্র লিঙ্গ মূর্তি প্রতিষ্ঠার কিছু পরেই দুটি জ্যোতির্লিঙ্গ নিয়ে আবির্ভূত হলেন হনুমান। তিনি যখন দেখলেন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তখন তিনি খুবই দুঃখ পেলেন এবং লেজ দিয়ে বেঁধে শিবলিঙ্গ কে উৎপাটিত করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না। রাগে অন্ধ পবন নন্দন তখন গদা দিয়ে লিঙ্গ মূর্তি ভেঙে ফেলতে উদ্যত হলেন। তখন শ্রীরামচন্দ্র শান্ত করলেন হনুমানকে এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ মূর্তির পাশে প্রতিষ্ঠা করলেন হনুমান আনীত লিঙ্গ মূর্তি দুটিকে। পূজা করলেন সেই লিঙ্গ মূর্তি দুটি। সেই মূর্তি দুটির নাম হল বিশ্বনাথ ও হনুমদীশ্বর। শ্রী রামচন্দ্র হনুমানকে বললেন:
“এখানে এসে প্রথমে বিশ্ব লিঙ্গ মূর্তি পূজা করতে হবে তারপরে হবে রামেশ্বরের পূজা। আগে রামেশ্বরের পূজা করলে সে পূজায় কোন ফল হবে না।
রামেশ্বরম একটি ছোট্ট দ্বীপ। এই দ্বীপে যেতে গেলে নামতে হয় মন্ডপম নামক স্টেশনে। এখানে যেতে গেলে এখনো পেরোতে হয় একটি ব্রিজ যেটি সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত। এই ব্রিজের উপর দিয়েই আড়াই কিলোমিটার চলে ট্রেন। এই ব্রিজটা তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার যাঁর নাম বি. সি. গাঙ্গুলী। পরে তিনি রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ট্রেন যখন ব্রিজের উপর দিয়ে যায় তখন তার গতি থাকে অতি মন্থর। নীচে উত্তাল সমুদ্র আর সমুদ্রের ঢেউ গুলো আঘাত করে ব্রিজের পিলার গুলোতে। আড়াই কিলোমিটার ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেন এসে থামে রামেশ্বরমে।
শোনা যায় এই মণ্ডপমে রাবণ সীতাকে হরণ করে প্রথমে এনেছিলেন। তারপর এইখান থেকে গিয়েছিলেন নিজের রাজ্য লঙ্কাতে। শ্রীরামচন্দ্র এখানে এসেই সেতুবন্ধন করেছিলেন। এই স্থানে এখনো শ্রীরামচন্দ্রের পায়ের ছাপ রাখা আছে।
রামেশ্বরম দ্বীপটির আকৃতি অদ্ভুত। অনেকটা শঙ্খের মত দেখতে এই দ্বীপ। মধ্যিখানে পেটটা মোটা আর দুদিকে সরু। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল ধনুষ্কোডি বন্দর। ঝড়ে সেই বন্দর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পর তৈরি হয়েছে রামেশ্বরম জেটি।রামেশ্বরম থেকে জাহাজ যায় শ্রীলঙ্কায়। এখানে বর্তমান আছে শ্রী রামচন্দ্রের তৈরী সেতুর একটু অংশ। হয়তো রামেশ্বর আছেন বলেই এখনো রয়ে গেছে এই অংশটি। ধনুষ্কোডি থেকে পরিষ্কার দেখা যায় শ্রী রামচন্দ্রের সেতুবন্ধন এর ধ্বংসাবশেষ।
রামেশ্বরের মন্দির চত্বর একটি বিরাট প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। এই প্রাচীর ৮৬৫ ফুট লম্বা , ৬৫৭ ফুট চওড়া।
সমুদ্রের সামনেই মূল মন্দিরের পূর্বদ্বারের গোপুরম অবস্থিত। গোপুরম শব্দের অর্থ শিল্প-সজ্জিত এক স্মারকীয় আকৃতি । দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলিতে গোপুরমের আধিক্য চোখে পরে। পূর্বদ্বারের গোপুরমটি সপ্তদশ শতকে দলভাই সেতুপতি তৈরি করান। গোপুরমটি নয়তলা উঁচু এবং মন্দিরের সকল গোপুরমগুলির মধ্যে সবচাইতে উঁচু। গায়ে রয়েছে নানারকম অলংকরণ।
পূর্বদ্বারের গোপুরমের পাশেই অবস্থিত শঙ্করাচার্যের মঠ। মন্দিরের ছত্রীর উপর অবস্থিত আচার্য শঙ্কর ও তাঁর চার শিষ্যের মূর্তি। গোপুরমের পাশ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশের পথ । মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে ঊর্ধাঙ্গে কোন সেলাই করা পোশাক রাখা যায় না।
মন্দিরের ভিতরে ঢুকেই রয়েছে শ্রীহনুমানের দন্ডায়মান, দক্ষিণমুখী মূর্তি। পাশেই আছে তাঁর দ্বারা আনীত একটি শিবলিঙ্গ। কথিত আছে পবন পুত্র দুটি শিবলিঙ্গ হিমালয় থেকে এনেছিলেন। আরেকটি শিবলিঙ্গ বিশ্বনাথ নামে মন্দিরের অভ্যন্তরে পূজিত হচ্ছেন। মন্দিরের অন্দরমহলে প্রবেশ করলে দেখা যায় গ্রানাইট পাথরের তৈরি একটি বিশাল মণ্ডপ। অপূর্ব কারুকার্যময় এই মন্ডপটি নির্মাণ করান রাজা ভাস্কর সেতুপতি । সেকারণে মণ্ডপের এক প্রান্তে ভাস্কর সেতুপতির একটি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মন্ডপটির নাম সেতুপতি মণ্ডপ। ভাস্কর সেতুপতি ছিলেন রামনাদ রাজ্যের রাজা এবং স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য। উল্লেখ্য এই মন্দিরের প্রধান সেবাইত হলেন রামনাদ রাজ্যে রাজারা। মন্ডপম ছেড়ে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে মহালক্ষীর মন্দির। মহালক্ষ্মী মন্দিরের দক্ষিণে একটি প্রশস্ত হল যেটির নাম কল্যাণমন্ডপম। এখানেই রয়েছে দেবী পর্বতবর্ধিনী বা দেবী ভগবতীর মন্দির। প্রতি শুক্রবার দেবী মূর্তি নবরত্নে সাজিয়ে, সোনার পালঙ্কে বসিয়ে শোভাযাত্রা বের হয় মন্দিরের সামনে। এই স্থানে দেবী ও রমেশ্বরের বাৎসরিক বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় জুলাই , আগস্ট মাসে। দেবী পর্বত বর্ধিনী হলেন শ্রী রামেশ্বরের শক্তি। তাঁকে দেবী অম্বিকা মাতাও বলা হয়।
রামেশ্বর মন্দির চত্বরের মধ্যে রয়েছে তিনটি করিডোর বা বারান্দা। তৃতীয় করিডোরটি একটি দীর্ঘ ঢাকা গলির ন্যায়। লম্বায় ৬৪২ ফুট ও চওড়ায় ৪০০ ফুট। সমগ্র করিডোরে ১২১২টি অপূর্ব কারুকার্যময় স্তম্ভ আছে। স্তম্ভ গুলি পাঁচ ফুট উঁচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত। সপ্তদশ শতকে মুথুরামলিঙ্গ সেতুপতি এটি তৈরি করান। সেই কারণে তাঁর ও তাঁর দুই মন্ত্রীর প্রস্তর নির্মিত মূর্তি এই করিডোর বা বারান্দার প্রবেশ মুখে আছে। দ্বিতীয় করিডোরটি লম্বায় ২২৪ ফুট আর চওড়ায় ৩৫২ ফুট। এটি ষোড়শ শতকে হিরুমালাই সেতুপতির উদ্যোগে তৈরি হয়। তাঁর ও তাঁর সুপুত্র রঘুনাথ সেতুপতির প্রস্তর মূর্তি দেবী পর্বতবর্ধিনির মন্দিরের দক্ষিণ প্রবেশ দ্বারে রয়েছে। প্রথম করিডোরটি দৈর্ঘ্যে ১৭২ ফুট ও প্রস্থে ১৪১ ফুট। এই বারান্দাটি একটি নাট মন্দিরের প্রবেশদ্বার। এটি আয়তাকার একটি গলিপথের বেষ্টনীঘেরা চত্বর। প্রবেশের মুখেই দুইপাশে রয়েছে শ্রীগনেশ ও শ্রী কার্তিকেয়র প্রতিমা। এখানে লাল রঙের গণপতি মূর্তি নৃত্যরত। বিশেষ পূজার দিন এই মহাগণপতি মন্দিরেই প্রথম পূজা হয়। পাশেই কার্তিকেয়র মন্দির। কথিত আছে পিতা মহাদেবের ওপর রাগ করে কার্তিকেয় বিন্ধ্য পর্বতের আড়ালে এই দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই দক্ষিণ ভারতে কার্তিকেয় অন্যতম জনপ্রিয় দেবতা । ষম্মুগम् বা মুরুগান নামে তিনি এখানে পূজিত হয়ে থাকেন।
রামেশ্বরম দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অবস্থিত। রেলিং দিয়ে ঘেরা পথ দিয়ে রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গের গর্ভমন্দিরের সামনে যেতে হয়। গর্ভ মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। তাই দুর থেকেই দর্শন করতে হয় । গর্ভ মন্দিরের দ্বারের চৌকাঠ কালো প্রস্তর নির্মিত এবং নকশা খোদাই করা। সিলিং বা ছাদের ভিতরের দিকে রয়েছে অপূর্ব দক্ষিণী স্থাপত্য শিল্পের নমুনা। এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ শ্রী রামনাথ স্বামী : স্বয়ং শ্রীরাম এবং জানকির হস্তে নির্মিত। জ্যোতির্লিঙ্গের চারদিকে বহু সোনা রুপার অলংকরণ ও ফুলের সাজ। আর তার মধ্যেই রৌপ্প আবরণে ঢাকা রৌপ্প সিংহাসনে রাজকীয় ঐশ্বর্য সহ আসীন শ্রীরামেশ্বর।
জ্যোতির্লিঙ্গ সোনার তৈরি পঞ্চমুখ দিয়ে ঢাকা ।লিঙ্গ মূর্তি হাতখানেক উঁচু এবং মাথার উপরে পঞ্চফণা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছেন কালনাগ। দুইপাশে দক্ষিণী ঢঙের দীপাধার। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, সীতা দেবীর মূর্তি আর রামেশ্বর মন্দিরের পাশেই রামেশ্বরী দেবীর মন্দির। সপ্তাহে একদিন রামেশ্বরী দেবীকে শোভাযাত্রা ও বেদপাঠ সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় রামেশ্বরের কাছে।
মূল গর্ভগৃহের কাছাকাছি অবস্থিত চুন- বালিতে তৈরি ১২ ফুট লম্বা নন্দী মূর্তি। তার পাশ দিয়ে এসে গর্ভ মন্দিরে যেতে হয়। এটি উচ্চতায় ৯ ফুট আর লম্বায় ১২ ফুট। দেবাদিদেবের দিকে মুখ করে বসে থাকা নন্দী দেবের গায়ে নানা অলংকার এবং তাঁর পিছনেই অষ্টধাতুর বিরাট ধ্বজদন্ড । সেখানে বাঁধা আছে ত্রিশূল ও ডমরু। নন্দীদেবের দুই পাশে দুই শিবভক্ত মাদুরাপতি রাজা বিশ্বনাথ এবং কৃষ্ণাপ্পা নাইকারের করজোড়ে দন্ডায়মান মূর্তি বর্তমান।
রামেশ্বর মন্দির এলাকায় বাইশটি কুন্ড রয়েছে। এই কুণ্ড গুলির মধ্যে একটি হলো রুদ্র কুন্ড। এই রুদ্র কুন্ডতে স্নান করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং মুক্ত হয়েছিলেন মাতুল কংস হত্যার পাপ থেকে। এই কুণ্ড গুলির জল পবিত্র বলে মানা হয়। ভক্তের দল এই কুন্ডে স্নান করে পূজা দিয়ে থাকেন।
এই মন্দির চত্বরে রয়েছে বিষ্ণুমন্দির যেখানে শ্বেতপাথরের মাধব রূপী বিষ্ণু প্রতিষ্ঠিত। এখানে এখানে বিষ্ণুর সেতু মাধব নামে পরিচিত। সেতু মাধব কুন্ডে স্নান করে এখানে বিষ্ণুর পূজা করতে হয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে এখানে এসেছিলেন আদি গুরু শ্রী শংকরাচার্যও। পায়ে হেঁটে গঙ্গা থেকে জল নিয়ে এসে সেই জল তিনি রামেশ্বরের মাথায় ঢেলে ছিলেন। এছাড়াও ভগবান শ্রী চৈতন্যদেব এবং জগৎ জননী মা সারদা এসেছিলেন এই রামেশ্বরমে এবং পূজা করেছিলেন রামেশ্বরের।
মন্দিরটি দ্রাবিড় স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সিংহলের রাজা পরাক্রমবাহু দ্বাদশ শতাব্দীতে গর্ভগৃহ সহ মূল মন্দিরটি তৈরি করান । তার আগে সাধক সম্প্রদায়ের হাতে ছিল এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। সাধারণ কুঁড়ে ঘরে রামেশ্বরের সেবা হত। পূজা ছিল ঐশ্বর্যহীন ; ভাবের পূজা। পরে রামনাদের রাজাদের হাতে চলে যায় মন্দিরের দায়িত্ত্ব।
রামনাদের রাজারা মন্দিরের পুরনো অংশগুলি সংস্কার করান এবং সেইসঙ্গে তৈরি করেন আরও কয়েকটি মন্দির। তবে এ মন্দিরটি তৈরি নিয়ে নানারকম মত রয়েছে। শোনা যায় শ্রীরাম চন্দ্র লঙ্কা জয়ের পর সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়েছিলেন তাঁর এক বীর ভক্তের উপর । তখন থেকেই এই বংশ সেতুপতি নামে পরিচিত । প্রাচীন নথি থেকে জানা যায় সেই ভক্ত সেতুপতি প্রথম রামেশ্বরম মন্দির তৈরি করেছিলেন। বর্তমান মন্দির শুরু হয় ১৪০০ সালে এবং শেষ হতে সময় লাগে সাড়ে তিনশো বছরের বেশি।পঞ্চদশ শতকে রামনাদের রাজা উদয়ন সেনাপতি ও নাগুরের এক ব্যবসায়ী পশ্চিমের গোপুরম এবং বাইরের প্রাচীর নির্মাণ করিয়ে দেন। পর্বর্তবর্ধিনী দেবীর মন্দিরের বেষ্টনী তৈরি করিয়ে দেন মাদুরার এক ভক্ত। ষোড়শ শতকে থিরুমালাই সেতুপতি করিডোরের খানিক অংশ তৈরি করিয়ে দেন। এইভাবেই ধাপে ধাপে তৈরি হয় মন্দির।
মন্দিরের কাছেই অবস্থিত যে নাটমন্দির, তার সামনে একটি সোনার তালগাছ রয়েছে । তার পরেই রয়েছে একটি সোনার বেষ্টনী দেওয়া বেদী। সেখানে বেদ পাঠ করা হয়। নাটমন্দিরের পর বারান্দা পেরিয়ে মন্দির । রামেশ্বর মন্দির এর মধ্যে মোট ২২ টি তীর্থ আছে। এগুলি হল- মহালক্ষী, সাবিত্রী, গায়ত্রী, সরস্বতী, মাধব, গন্ধমাদন, গবাক্ষ ,গয়, নল, নীল ,শঙ্খ, শংকর, ব্রহ্মহত্যা, বিমোচন, তীর্থ, সূর্য, গঙ্গা, চন্দ্র, যমুনা ,গয়া, শিব, সত্যামৃত, সর্ব, কোটি তীর্থ। স্কন্দ পুরাণে এই তীর্থের মহিমা বর্ণিত রয়েছে। এই তীর্থ ভ্রমণ করলে ভক্তের অমোঘ ফল লাভ হয়।
তথ্যসূত্র:
১. শিব ঠাকুরের বাড়ি- সোমনাথ: দেব সাহিত্য কুটির।
২. ওম নমঃ শিবায় : গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর।
৩. দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ : স্বামী অচ্যুতানন্দ।