ভারতে পর্তুগিজ উপনিবেশের অবসানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভূমিকা



Updated: 21 July, 2023 5:29 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

ভারতীয় মাত্রই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। অহিংসা এবং হিংসা – উভয় পথেই দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিত হয়েছিল। অনেক বলিদান ও আত্মত্যাগের পর ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে লালকেল্লার উপর উত্থিত হয় ভারতমাতার নিশান- ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা। সময়টা 1947 সালের 15 ই আগস্ট। কিন্তু তখনও ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল পরাধীন হয়ে রয়ে গিয়েছিল। আমাদের অনেকের কাছেই এই তথ্য অজ্ঞাত যে ব্রিটিশ ছাড়াও আরো বেশ কিছু ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলকে নিজেদের অধীনস্থ করে রেখেছিল। 1947 সালের 15 আগস্টের পরেও তারা এইসব ভূখণ্ডকে ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে অস্বীকার করে। এইসব ইউরোপীয় শক্তি গুলি হল ফ্রান্স এবং পর্তুগাল। ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে 1961 সালে পর্তুগিজ উপনিবেশ গুলি এবং 1962 সালে ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ গুলি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই নিবন্ধে অখন্ড ভারতের যেসব অংশ পর্তুগীজদের ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল, সেই সকল অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা আলোচিত হবে।

ভারতে পর্তুগিজরা যে সকল অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল সেগুলি হল গোয়া, দমন ও দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলি। একত্রে এই অঞ্চলগুলি এস্তাদো দা ইন্ডিয়া ( Estado da India ) নামে পরিচিত ছিল। ইংরেজ নয় , পর্তুগিজ শাসনে ভারতের এই অঞ্চলগুলো শাসিত হত। সেই কারণেই ইংরেজ ভারত ছাড়ার সময় এইসব অঞ্চল গুলিকে স্বাধীন ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারেনি। এই অঞ্চল গুলির মধ্যে গোয়াতে পর্তুগিজ শাসন চলছিল 1510 খ্রিস্টাব্দ থেকে। দমন- দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলি পর্তুগীজদের দখলে ছিল 1500 সাল থেকে। 1947 সালে স্বাধীন ভারত সরকার আত্মপ্রকাশ করলেও পর্তুগিজ সরকার এই অঞ্চল গুলিকে ভারতের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে। উল্টে পর্তুগালের সরকার যুক্তি দেখায় যে এই অঞ্চল গুলির উপর কোন অধিকার ভারতের নেই। কারণ ভারত নামক কোন রিপাবলকের অস্তিত্ব সেই সময় ছিলই না, যখন এই অঞ্চলগুলিতে পর্তুগিজ শাসনের পত্তন ঘটে। অতএব এই অঞ্চল গুলি অখন্ড পর্তুগালের অংশ। বাকচাতুর্যের দ্বারা সত্যকে অস্বীকার করা পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই এটা স্বাভাবিক যে দুর্বৃত্ত, লুটেরাদের সরকার , যারা ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, তারা এই ধরনের কথা বলবেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গোয়ার প্রাচীন নাম ছিল গোমন্ত এবং মহাভারত অনুযায়ী গোমন্ত রাজ্য ছিল দ্বরকার যাদব বংশের দ্বারা শাসিত। অর্থাৎ যে যাদব ( ঋকবেদে উল্লিখিত রাজা যদুর বংশ ) কুলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নেন, সেই বংশের রাজারাই গোমন্ত রাজ্য শাসন করতেন। আবার গোয়ার অন্যতম নদী হলো মান্ডবী। গোয়ার রাজধানী পানাজি এই মান্ডবী নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীর নামকরণ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে নদীটি নামাঙ্কিত হয়েছে রামায়ণের অন্যতম চরিত্র ভরতের পত্নী তথা সীতা মাতার বোন মান্ডবীর নামে । এর থেকে প্রমাণিত হয় যে গোয়া সহ বাকি অন্য অঞ্চলগুলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক – সবদিক থেকেই অখন্ড ভারতের অংশ ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক বিদেশী সরকার নিজেদের স্বার্থেই সে কথা স্বীকার করতে চাইছিল না। এই কারণেই 1953 খ্রিস্টাব্দের 11 জুন ভারত সরকার লিসবনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

পর্তুগাল সরকারের অসঙ্গত দাবি ভারতের সকল নাগরিককে উত্তেজিত করে তোলে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন না। তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে তারা পর্তুগালের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন করবে। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসঙ্ঘচালক ছিলেন পরম পূজনীয় শ্রী গুরুজী । তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে 1954 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট পুনের সংঘ চালক বিনায়ক রাও আপটের পরিচালনায় একশত স্বয়ংসেবক দাদরা ও নগর হাভেলির পর্তুগিজ উপনিবেশ প্রবেশ করলেন। সংঘের স্বয়ংসেবক ছাড়াও এই দলে ছিলেন ইউনাইটেড ফ্রন্ট অফ গোয়ানস , ন্যাশনাল মুভমেন্ট লিবারেশন অর্গানাইজেশন, আজাদ গোমন্তক দলের স্বেচ্ছাসেবকরা এবং একদল সশস্ত্র ভারতীয় পুলিশ। এই সঙ্ঘবদ্ধ দল গেরিলা কায়দায় দাদরা ও নগর হাভেলির সেলভাসায় প্রবেশ করে এবং প্রধান পুলিশ চৌকি আক্রমণ করে। এই ঘটনায় 175 জন পুলিশ কর্মী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে 1979 খ্রিস্টাব্দের 2 আগস্ট সেলভাসার মানুষ একশত স্বয়ং সেবককে বীরের সম্মানে ভূষিত করে। 1955 খ্রিস্টাব্দের 22 জুলাই এই সঙ্ঘবদ্ধ স্বাধীনতা সৈনিকদের হাতে পুলিশ সার্জেন্ট এনিসেটো ডো রোজারিও এবং কনস্টেবল অ্যান্টোনিও ফার্নান্ডেজ নিহত হন। ওই বছরের 28 জুলাই সঙ্ঘবদ্ধ স্বাধীনতা বাহিনী নারোলির দখল নেয়।

এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে 1955 সালের 15 আগস্ট রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতৃত্বে 3000 – 5000 জন ভারতীয় পর্তুগিজ শাসিত গোয়াতে প্রবেশ করে। ওই বছরই গোয়ার একজন স্বয়ংসেবক- শিক্ষক সর্বপ্রথম পানাজি সেক্রেটারিয়েটের উপর ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সে কারণে তিনি লিসবনের কারাগারে 17 বৎসর নির্যাতিত হন। পর্তুগিজ জেলে এইরকম হাড়ভাঙ্গা অত্যাচার সহ্য করেন জনসংঘের কার্যকর্তা জগন্নাথ রাও যোশী। যাইহোক 1955 সালের 15 আগস্ট সংঘের কার্যকর্তাদের নেতৃত্বে যে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় পর্তুগিজ শাসিত গোয়ার মাটিতে প্রবেশ করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। কিন্তু পর্তুগিজ বাহিনী হিংসার দ্বারা ভারতীয়দের রোধ করার চেষ্টা করে এবং গুলি চালিয়ে দু’ডজন প্রতিবাদীকে হত্যা করে। ঔপনিবেশিকদের গুলিতে যাঁরা বলিদান দেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন সোহোদরা দেবী, রাজাভাও মহানকল প্রমুখ। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভারত সরকার গোয়ার দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। তবে এখানেই এই হিংসার শেষ হল না। 1961 সালের 24 নভেম্বর পর্তুগিজ সেনা একটি যাত্রীবাহী নৌকার ওপর গুলি চালায়। নৌকাটি পর্তুগীজদের দখল করা আঞ্জিদীভ থেকে ভারতের কোচি বন্দরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। এই আক্রমণে একজন যাত্রী নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তখন ভারত সরকারের কাছে পর্তুগিজ উপনিবেশের উপর সামরিক আক্রমণের দাবি জানায়।

অবশেষে ভারতীয় সেনা 1961 সালের 18 ডিসেম্বর অপারেশন বিজয়ের সূচনা করে। পর্তুগিজ বাহিনী পরাজিত হয় এবং পরের দিন অর্থাৎ 19 ডিসেম্বর রাত 8: 30 মিনিটে পর্তুগিজ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ততক্ষণে গোয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল ভারতের দখলে চলে এসেছে। এই যুদ্ধে 22 জন ভারতীয় সৈন্য এবং 30 জন পর্তুগিজ সৈন্য আত্ম বলিদান দেন। অপারেশন বিজয় গোয়াতে প্রায় সাড়ে চারশো বছরের বিদেশি শাসনের অবসান ঘটায় । বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশ গুলি, USSR, শ্রীলংকা ( তৎকালীন সিলোন) এবং আরব দেশ গুলি ভারতকে সমর্থন জানায়. USA এবং UK কিন্তু সে সময় ভারতের বিরোধিতা করেছিল। পর্তুগিজ সরকার 1955 সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে যায়, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি।

একথা ঠিক অপারেশন বিজয় এর মাধ্যমে ভারতীয় সেনা তাদের বীরত্বের দ্বারা গোয়া, দমন – দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলিকে বিদেশি শাসনমুক্ত করে। কিন্তু সেই সঙ্গে এই মহৎ কার্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভূমিকা ভুলে গেলে চলবে না। সংঘই প্রথম ভারতের সীমানার মধ্যে 400 বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা বৈদেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে, সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিচালনা করে এবং 1955 খ্রিষ্টাব্দে সংঘের আন্দোলন গোয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যায়। এই আন্দোলনের সময়ে দেশের অন্যান্য রাজ্য যেমন মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকদের সংগঠিত করে গোয়াতে নিয়ে গিয়েছিল সংঘের স্বয়ংসেবকরা। এইসব আন্দোলনকারীদের থাকা ও খাওয়ার দায়িত্ব ছিল সংঘের স্বয়ংসেবকদের উপর। এছাড়াও সংঘের বেশকিছু স্বয়ংসেবক ও সেবিকা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্ম বলিদান দেন। তাই আজ যে আমরা বিনা পাসপোর্ট বা ভিসাতে গোয়া কিংবা দমন ও দিউতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি, তার কৃতিত্ব যে ভারতীয় সেনা এবং সংঘের স্বয়ংসেবকদের, সে নিয়ে সন্দেহ নেই।

Disclaimer:

(নিবন্ধটি পূর্বে স্বস্তিকা পত্রিকার প্রকাশিত: প্রকাশ কাল – ১২ জুলাই ২০২১। লেখকের অনুমতি নিয়ে পুনরায় প্রকাশ করা হলো)