রাম রাম রাম রাম.... দুই দুই দুই দুই.... তিন তিন তিন তিন...
ছিদাম কয়াল চাল মাপছে। শুধু ছিদাম কয়ালই নয়, বাঙ্গলার প্রত্যন্ত গ্রামে গেলেও দেখবেন, প্রত্যন্ততম বাঙ্গালীটিও গণনার সময় 'এক দুই তিন চার...' না বলছি 'রাম দুই তিন চার....' বলে। শ্রীদামের ছেলেটিও ব্যকরণে পড়ার সময় কর্তা ক্রিয়া কর্ম শেখে 'রাম ভাত খায়' এই বাক্যের দ্বারা।
বাঙ্গলার দিকে দিকে রাম নামে জায়গা। আসনি সপ্তাহান্তে সমুদ্র সৈকতে যান ‘রামনগর’ হয়ে দীঘায়। ভারতবিখ্যাত রথযাত্রায় যান ‘শ্রীরামপুরের’ মাহেশে। সুন্দরবনের শোভা উপভোগ করতে যান ‘রামগঙ্গা’ হয়ে। মা তারার কাছে মাথা নত করতে তারাপীঠ যান ‘রামপুরহাট’ হয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণলীলাসঙ্গীনী শ্রী শ্রী সারদা মা জন্মেছিলেন ‘জয়রামবাটিতে’।
বহিরাগত আরব সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ প্রতিহত করে যে টেরাকোটা মন্দিরগুলি আজও দাঁড়িয়ে আছে, তার গায়ে দেখবেন রামায়ণের কাহিনীই সর্বাধিক। শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরামচন্দ্র – এই দুই চরিত্রের জীবনকথা বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরে মন্দিরে শোভাবর্ধন করে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
বাঙ্গালীকে সনাতনী হিন্দুধর্মের ঔপনিষদিক রসে স্নাত করে সমসাময়িক বিপথগামীতা থেকে রক্ষা করেছিলেন যে বাঙ্গালীটি, তাঁর নামেও রাম ছিল- শ্রীরামকৃষ্ণ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙ্গালীকে ই স লা মী যুগ জাত হীনমন্যতা ও মেরুদন্ডহীনতা থেকে শক্তিমান জাতিতে পরিণত করতে ভারতপথিকের ভূমিকা নিয়েছিলেন রামমোহন, তিনিও রাম। পাশ্চাত্য দর্শনের নির্যাস এনে বাঙ্গালীর রক্তে উষ্ণতা এনেছিলেন রামগোপাল ঘোষ। সাংবাদিকতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে শিল্পসুষমায়ন্ডিত করেছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ। আর কত বলব….
অথবা ভাবুন সেই দৃশ্য।
পায়ের নিচে তপ্ত বালি। রাতে ডাকাতের ভয়। প্রতি মুহূর্তে বিধর্মীর ভয়। তবু বাঙ্গালী যাত্রীদল এগিয়ে চলেছে সতীমাতার ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল যেখানে সেই মরুতীর্থ হিংলাজে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখনী আর হেমন্ত মুখার্জীর দরদী কন্ঠে
‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ,
একি অভিশাপ, নাই প্রতিকার?
মিথ্যারই জয় আজ,
সত্যের নাই তাই অধিকার।।’
বাঙ্গালীর স্মৃতিতে ফুটে ওঠে রামরাজ্য। কন্ঠ ভিজে যায়। —
কোথায় অযোধ্যা কোথা সেই রাম
কোথায় হারালো গুণধাম,
একি হল একি হল,
পশু আজ মানুষেরই নাম।
পরিত্রাণ চায় বাঙ্গালী। পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের কঠোর রূপ দেখতে চায়। বলে–
সাবিত্রী সীতার দেশে দাও দেখা তুমি এসে
শেষ করে দাও এই অনাচার।।
তোমার কঠিন হাতে বজ্র কি নাই
হিংসার করো অবসান।
অথবা ফিরে যান প্রায় পাঁচশত বছর আগে। নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামের কৃত্তিবাস ওঝা লিখলেন 'শ্রীরাম পাঁচালী'। বাঙ্গলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি বাল্মীকি-রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে "প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।" রামচন্দ্রের চরিত্র বর্ণনা করলেন --
সর্ব্ব সুলক্ষণ যার হয় অধিষ্ঠান।
হিংসার ঈষৎ নাই, চন্দ্র সূর্যের সমান।
ইন্দ্র যম বায়ু বরুণ যেই বলবান।
ত্রিভুবনে নাই কেহ তাহার সমান।
বৈষ্ণব কবি চৈতন্যজীবনীকার বৃন্দাবন দাস প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে শ্রীরামচন্দ্র নিয়ে লিখলেন
‘ যবনেও যাহার কীর্তি শ্রদ্ধা করি শুনে,
ভজ হেন রাঘবেন্দ্র প্রভুর চরণে।’
বৃন্দাবন দাস, চৈতন্য ভাগবত (অন্ত খণ্ড, চতুর্থ অধ্যায়)
ধর্মবিজ্ঞানী শ্রীরামকৃষ্ণের শৈশবের কাহিনী থেকে জানা যায়, তাঁর গৃহদেবতা ছিলেন রঘুবীর। শ্রীমা সারদার পারিবারিক নিত্য আরাধ্য ছিলেন রামচন্দ্র ( তথ্যসূত্র: ছোটোদের মা সারদা, উদ্বোধন কার্যালয়)। শ্রীরামকৃষ্ণ সাধক জীবনে যখন তন্ময় হয়ে যেতেন রাম নামে তখনকার উপলব্ধি শুনুন–
“সন্ধ্যা হইয়াছে | ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ….আবার রামনাম করিতেছেন-‘রাম, রাম,রাম,রাম ! রাম,রাম,রাম,রাম, রাম!
ঠাকুর এইবার প্রার্থনা করিতেছেন-‘ও রাম! ও রাম! আমি ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীন-আমি ক্রিয়াহীন ! রাম শরণাগত ! ও রাম শরণাগত ! দেহসুখ চাইনে রাম ! লোকমান্য চাইনে রাম ! অষ্টসিদ্ধি চাইনে রাম ! শতসিদ্ধি চাইনে রাম ! শরণাগত, শরণাগত ! কেবল এই করো -যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় রাম ! আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হই না রাম ! ও রাম শরণাগত !
ঠাকুর প্রার্থনা করিতেছেন, সকলে একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন | তাঁহার করুণামাখা স্বর শুনিয়া অনেকে অশ্রু সংবরণ করিতে পারিতেছেন না” |
[শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১৬, পৃ.৫৮৬-৫৮৭]
এর পরেও যারা বলে রাম বাঙ্গলায় অপ্রাসঙ্গিক, বহিরাগত, বাঙ্গালীর কেউ নয়; তারা যে মূর্খ তা নয়, তারা সুযোগ সন্ধানী, বাঙ্গালীর শত্রু। তারা ইতিহাস ভুলিয়ে, সংস্কৃতি ভুলিয়ে, চায় বাঙ্গালীকে আরবের ক্রীতদাস বানাতে।