© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
ঋগ্বেদ সংহিতার অষ্টম মণ্ডলের একটি মন্ত্রে গোরুকে “মাতা রুদ্রাণাং”, অর্থাৎ একাদশ রুদ্রের জননী বলে অবিহিত করা হয়েছে। এবং মন্ত্রের শেষে সর্বজনজননী স্বরূপা অদিতি বলে অবিহিত করে গাভীকে কখনো বধ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং
স্বসাদিত্যানা মমৃতস্য নাভিঃ ।
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়
মা গা মনাগামদিতিং বধিষ্ট ৷৷
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৮.১০১.১৫)
” তিনি একাদশ রুদ্রের জননী, অষ্টবসুর কন্যা, দ্বাদশাদিত্যের ভগিনী, অমৃতের নাভি অর্থাৎ অমৃত স্বরূপ দুগ্ধের জনয়িত্রী, অতএব হে পরিচারকগণ! এই অনপরাধা, মহানুভাবা, অদীনা, সর্বজনজননী স্বরূপা গাভীকে কখনো বধ করো না— যাঁরা প্রজ্ঞাবান তাঁদের একথা বলছি।”
অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ এ মন্ত্রটি সামবেদের মন্ত্রব্রাহ্মণ (২.৮.১৫), তৈত্তিরীয় আরণ্যকসহ (৬.১২.৫) বেদের বিভিন্ন স্থানে আছে। ঋগ্বেদীয়, সামবেদীয়, যজুর্বেদীয় বিবিধ গৃহসূত্রেও আছে। ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন গৃহসূত্রে আছে:
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাম্ ইতি
জপিত্বোমুত্ সৃজতেত্যুত্স্রক্ষ্যন্।।
(আশ্বলায়ন গৃহসূত্র: ১.২৪.২৫)
“মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাম্—’ (ঋ. ৮.১০১.১৫) এই মন্ত্রটি জপ করে গাভীটিকে ছেড়ে দিতে গিয়ে বলবেন—ওম্ উৎসৃজত। অর্থাৎ হ্যাঁ, এ গাভীটিকে ছেড়ে দাও।”
সামবেদের গোভিল গৃহসুত্রে বলা হয়েছে :
মাতা রুদ্রাণা মিত্যনুমন্ত্রযেত।
(গোভিল গৃহসুত্র: ৪.১০.১৯)
“অর্হণীয় ব্যক্তির তাদৃশ আদেশানুসারে বধার্থ বদ্ধ গাভীটিকে খাঁড়াতে নাপিত ছেড়ে দিলে, অর্হণীয় ব্যক্তি ‘মাতা রুদ্রাণাং(ঋ. ৮.১০১.১৫)” –মন্ত্রে সেই গাভীটিকে অনুমন্ত্রণ করবে।”
যজুর্বেদীয় পারস্কর গৃহসূত্রে বলা হয়েছে:
প্রত্যাহ।
মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং
স্বসাদিত্যানা মমৃতস্য নাভিঃ ।
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়
মা গা মনাগামদিতিং বধিষ্ট ৷৷
মম চামুষ্য চ পাপ্মানং হনোমীতি যদ্যালভেৎ ।
(পারস্কর গৃহসূত্র: ১.৩.২৭)
“তখন পূজ্যপুরুষ প্রতিবচন হিসাবে ‘মাতা রুদ্রানাম …ইত্যাদি মন্ত্রটি পাঠ করবে।
আর যদি গরুটিকে স্পর্শ করে, তাহলে বলতে হবে যে, আমার এবং যজমানের যত পাপ আছে সমস্ত নষ্ট করছি।”
মন্ত্রটির মাধবীয় বেদার্থপ্রকাশ ভাষ্যে সায়ণাচার্য বলেছেন- “অনাগামনপরাধাং গামুক্তরূপেণ মহানুভাবাং অদিতি অদিতিবদ্দেবাদি সর্বমাতৃভূতাং মা বধিষ্ট। হে দেবা হিংসাং মা কুরুত।” বিখ্যাত বাঙালি বেদ ভাষ্যকার সত্যব্রত সামশ্রমী তাঁর মন্ত্রার্থমঞ্জরী ভাষ্যে এ মন্ত্রটি প্রসঙ্গে বলেছেন-“তথাচ গোদুগ্ধপানাত্ শরীরে বৈদ্যুতাগ্নিঃ, জাঠরাগ্নিঃতাপশ্চ জায়তে পোষিতশ্চ ভবতীতি গোরাদরণীয়তা সূচিতা। সা চ অনাগাঃ অনপরাধা অতএব অদীনা অবধ্যা অতো তদ্বধী যজ্ঞান্যত্র ন বিধেয় ইত্যাদেশঃ।”
বেদের পরে আমরা দেখতে পাই মহাভারতেও গোরুকে মাতা বলে অবিহিত করা হয়েছে। মহাভারতে বলে হয়েছে, গোমাতা সমস্ত প্রাণীরই মাতা এবং সে বিবিধ প্রকারের সুখ প্রদান করে। অতএব বুদ্ধিমান উন্নতিকামী মানুষ নিত্য গোপ্ৰদক্ষিণ করবে। কারণ গোগণ মঙ্গলের স্থান এবং দেবীতুল্যা।
তথৈব গাঃ প্রশংসন্তি ন তু দেয়ং ততঃ পরম্। সন্নিকৃষ্টফলান্তা হি লব্ধার্থাশ্চ যুধিষ্ঠির ॥
মাতরঃ সর্বভূতানাং গাবঃ সর্বসুখপ্রদাঃ।
বৃদ্ধিমাকাঙ্ক্ষতা নিত্যং গাবঃ কার্য্যাঃ প্রদক্ষিণাঃ ॥ সন্তাড্যা ন তু পাদেন গবাং মধ্যে ন চ ব্রজেৎ। মঙ্গলায়তনং দেব্যস্তস্মাৎ পূজ্যাঃ সদৈব হি ॥
(মহাভারত: অনুশাসন পর্ব, ৫৭.৬-৮)
” হে যুধিষ্ঠির, মুনিগণ গোরুর সর্বদা প্রশংসা করে থাকেন ৷ জগতে গো অপেক্ষা উৎকৃষ্ট দেয়বস্তু আর নেই। গোদানের ফল অচিরকালমধ্যেই লাভ হয় এবং মানুষ গোরুর হতে প্রয়োজনীয় সকল কিছুই লাভ করে।
গো সমস্ত প্রাণীরই মাতা এবং সে বিবিধ সুখ প্রদান করে। অতএব বুদ্ধিমান উন্নতিকামী মানুষ নিত্য গোপ্ৰদক্ষিণ করবে।
পাদদ্বাবা গোতাড়ন করতে নেই এবং গোগণের মধ্যে অকারণে বিচরণ করবে না। কারণ, গোগণ মঙ্গলের স্থান এবং দেবীতুল্যা। অতএব সৰ্বদাই গোগণের সেবা করবে।”
গোমাতার মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে মহাভারতের অনুশাসন পর্বে দেবগুরু বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রকে বলেছেন, সূৰ্য্য, বায়ু, অগ্নি এবং লোকমাতা গো -এ দেবতাদের স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছেন; তাই মনুষ্যদেরকে মর্ত্যলোকের সকল বিপদ হতেই তারা উদ্ধার করতে সমর্থ। অনুশাসন পর্বে দেবগুরু বৃহস্পতি গোমাতাকে ‘লোকমাতা’ নামে অভিহিত করেছেন।
ভানুমাননিলশ্চৈব হব্যবাহশ্চ বাসব৷
লোকানাং মাতরশ্চৈব গাবঃ সৃষ্টাঃ স্বয়ম্ভুবা ॥
লোকাংস্তারয়িতুং শক্তা মর্ত্যেষ্বেতেষু দেবতাঃ।
সর্বে ভবন্তঃ শৃণ্বন্তু একৈকং ধৰ্মনিশ্চয়ম্ ॥
(মহাভারত: অনুশাসন পর্ব, ১০৬.৫৯-৬০)
“হে দেববাজ! সূৰ্য্য, বায়ু, অগ্নি এবং লোকমাতা গো এ দেবতাদের স্বয়ং ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছেন।
এই দেবতারা মর্ত্যলোকের সকল বিপদ হতেই উদ্ধার করতে সমর্থ। সে যা হোক, আপনারা সকলে এক এক মাহাত্ম্যপূর্ণ ধর্মতত্ত্ব শ্রবণ করুন।”
শুধুমাত্র সনাতন ধর্ম শাস্ত্রে নয়, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রেও গোমাতা সম্পর্কে এ সকল কথা বলা হয়েছে।ভগবান বুদ্ধের বাণী ত্রিপিটকের সুত্র পিটকের সুত্তনিপাতের ব্রাহ্মণ ধম্মিক সুত্তে বলা হয়েছে-মাতা, পিতা, ভাই এবং পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়ের ন্যায় গোজাতি আমাদের পরম মিত্র স্বরূপ। কারণ তাদের থেকে বিবিধ প্রকারের জীবনদায়ী ওষুধের উৎপত্তি হয়। গোগণ বিভিন্ন প্রকারের অন্ন, শারীরিক বল, বর্ণ ও সুখপ্রদানকারী। তাই এ বিষয়টি জ্ঞাত হয়ে ব্রাহ্মেণেরা কখনই গোহত্যা করতেন না।
উপট্ ঠিতস্মিং যঞ্ঞস্মিং, নাস্সু গাবো হনিংসু তে,
যথা মাতা পিতা ভাতা, অঞ্ঞে বাপি চ ঞাতকা।
গাবো নো পরমা মিত্তা, যাসু জায়ন্তি ওসধা ।
অন্নদা বলদা চেতা, বন্নদা সুখদা তথা,
এতমত্থবসং ঞত্বা, নাসসু গাবো হনিংসু তে।
সুখুমালা মহাকাযা, বন্নবন্তো যসসসিনো,
ব্রাহ্মণা সেহি ধম্মেহি, কিচ্চাকিচ্ছেসু উসসুকা;
যাব লোকে অবত্তিংসু, সুখমোধিথ’যং পজা।
( ত্রিপিটক: সুত্র পিটক, সুত্তনিপাত, ব্রাহ্মণ ধম্মিক সুত্তং,১৩-১৫)
“তাঁরা যজ্ঞসময়ে উপস্থিত হলেও, কখনো গো হত্যা করতেন না। যেমন মাতা, পিতা, ভাই এবং অন্যান্য আত্মীয়ের ন্যায় গোজাতি আমাদের পরম মিত্র স্বরূপ এবং তাদের থেকে বিবিধ প্রকারের জীবনদায়ী ওষুধের সৃষ্টি হয়।
গোগণ অন্ন, বল, বর্ণ ও সুখপ্রদানকারী। এ বিষয়টি জ্ঞাত হয়ে ব্রাহ্মেণেরা কখনই গোহত্যা করতেন না।
তাঁরা সুকুমার, মহাকায়, বর্ণবান, যশস্বী ও স্বভাবতঃ ব্ৰাহ্মণ ছিলেন; তাঁরা নিজ নিজ কর্তব্য পালনে আগ্রহপূর্ণ ছিলেন। যতদিন এই উচ্চ আদর্শধারী ব্রাহ্মণগণ জগতে বর্তমান ছিলেন, ততদিন এই জাতি সুখসমৃদ্ধ ছিল।”
লেখক পরিচিতি:
ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়