© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘৫০ বছরে দেশে ৭৫ লাখ হিন্দু কমেছে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় (১৪.১১.২০২১)। সেখানে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশে সকল ধর্মাবলম্বীদের সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার কথা থাকলেও। বাস্তবে তার বাস্তবায়ন হয়নি। যা ক্রমবিলীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য যেমন দুর্ভাগ্যজনক, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্যও লজ্জার। প্রথম আলো পত্রিকার সেই গবেষণাধর্মী লেখায় বলা হয় :
“দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার ক্রমাগত কমছে। গত ৫০ বছরে মোট জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ কমেছে। এই সময়ে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার হার মোটামুটি একই আছে।
স্বাধীন দেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। তখন হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আরও চারটি আদমশুমারি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হিন্দু।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদনে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, হিন্দুদের আউট মাইগ্রেশন হচ্ছে, অর্থাৎ হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট তুলনামূলক কম। অর্থাৎ হিন্দু দম্পতিরা তুলনামূলকভাবে কম সন্তান জন্ম দেন।
বিবিএস বা সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীভিত্তিক প্রজনন হারের কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশসহ (আইসিডিডিআরবি) তিনটি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষক দেশের একটি ছোট এলাকার জনমিতি বিশ্লেষণ করে বলছেন, দেশত্যাগ ও প্রজনন হার কম হওয়া ছাড়াও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে নবজাতক মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে সামান্য বেশি।
…১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৯৮ হাজার। এর মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার; যা মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ৮৫ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল মুসলমান।
হিন্দুদের জনসংখ্যার হার যদি ৫০ বছর আগের মতো থাকত, তাহলে বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুর সংখ্যা কত হতো, তা একটি প্রশ্ন। ২০১১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার। ৫০ বছর আগের হার (১৩ দশমিক ৫ শতাংশ) ঠিক থাকলে হিন্দুর সংখ্যা ২ কোটি ২ লাখ ১৯ হাজার হওয়ার কথা।
কিন্তু সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার সাড়ে ৮ শতাংশ ছিল হিন্দু। এ হিসেবে সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখের কিছু বেশিতে। অর্থাৎ ৫০ বছরে হিন্দুদের যে সংখ্যা হতে পারত, তার চেয়ে প্রায় ৭৫ লাখ কম।
জনসংখ্যাবিদেরা একে বলছেন ‘মিসিং হিন্দু পপুলেশন’ বা ‘হারিয়ে যাওয়া হিন্দু জনগোষ্ঠী’। প্রতি দশকে ১৫ লাখের বেশি হিন্দু কমে যাচ্ছে। এর পেছনে দেশান্তর হওয়ার পাশাপাশি প্রজনন হার কমা এবং মৃত্যুহার বেশি হওয়ার বিষয়টি যুক্ত।”
প্রথম আলোর গবেষণায় দেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এর দায় বিভিন্ন প্রকার তত্ত্বের বাক্যের জাল বিস্তার করে রাষ্ট্রযন্ত্র এড়িয়ে যেতে পারে না। রাষ্ট্রযন্ত্রের দায় সিংহভাগ। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা হ্রাসে প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিজেদের।এরপরে সর্বক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সহমর্মিতা ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে কটূক্তি করে অনেকেই জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে তাদের মানসিক নির্যাতন করে থাকে। এর সমাধানে ব্যাপকভাবে সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক মানসিক নির্যাতনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ থেকে এমপি মন্ত্রী কেউ বাদ যায় না। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ পরবর্তীতে তৎকালীন এমপি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক মালাউন বলে গালি দিয়েছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উচিত সুতীব্র ভাষায় এ মানসিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করা এবং এ সম্পর্কে সচেতন থাকা।
প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দির সরকারি খরচে পুনর্নির্মাণ করে দিয়ে অতিদ্রুত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী ও ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ প্রদান করে যথাযথভাবে তাদের সুরক্ষা প্রদান করতে হবে।
সংখ্যালঘু পল্লীতে হামলার ঘটনায় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে এর উস্কানিদাতা, মদতদাতা এবং হামলাকারীসহ সকল দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।সংখ্যালঘুদের উপরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনকারীদের বিচারের এবং সর্বোচ্চ শাস্তিদানের লক্ষ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মতো ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ‘স্থায়ীভাবে গঠন করতে হবে।
বর্তমান সরকারের শাসনকালসহ ২০০১ সাল থেকে গত ২০ বছরে হিন্দু সম্প্রদায়সহ যত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নির্যাতিত হয়ে অনিচ্ছাকৃত দেশত্যাগ করেছে, তাদেরকে স্বদেশে ক্ষতিপূরণসহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেও ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য নিবেদিত থাকবে এই মন্ত্রণালয় এবং এটা অবশ্যই শতভাগ সংখ্যালঘু কর্মকর্তা -কর্মচারী কর্তৃক পরিচালিত হতে হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয় যেন একটি বিশেষ ধর্মের ধর্ম মন্ত্রণালয় না হয়ে বাংলাদেশ সংবিধান অনুসারে সকল ধর্মাবলম্বীদের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং দেশে বসবাসরত ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যেন আন্তঃধর্মীয় বিদ্বেষ না বাড়ে সে লক্ষ্যে ধর্ম মন্ত্রনালয়ের নামকরণ করতে হবে ‘ধর্ম এবং সম্প্রীতি মন্ত্রণালয় ‘ (Ministry of Religion and Harmony). এই মন্ত্রণালয়ে অন্তত একজন প্রতিমন্ত্রী অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে নিতেই হবে।পাকিস্তান এবং ভারতের কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্য সরকারে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় থাকতে পারলে – বাংলাদেশে কেন নয়? বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
অবিলম্বে পূর্ণাঙ্গ সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীন ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠন করে সংখ্যালঘুদের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করে সার্বিক নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, জীবনমান উন্নয়ন, দেশত্যাগ প্রতিরোধ, সামগ্রিক কল্যাণ প্রভৃতি জরুরী বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অতিদ্রুত গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তায় ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ‘ অতিদ্রুত তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত ২০০১ সাল থেকে যে ধারাবাহিক সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অমানবিক নৃশংস সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলছে, তার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে একটি সংরক্ষিত ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা বাহিনী’ গঠন করতে হবে। ফায়ারসার্ভিস, ইন্ডাস্ট্রি পুলিশ, কোস্টগার্ড প্রভৃতি বাহিনী যেমন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ক দায়িত্বই পালন করে থাকে ; একইভাবে এই ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা বাহিনী’ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং জরুরী মুহূর্তে সুরক্ষার জন্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় দায়িত্ব পালন করবে।
আরেকটি বিষয় অত্যন্ত প্রয়োজন। তা হল ‘হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট’কে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের আদলে হিন্দু কল্যাণ ফাউন্ডেশনে পরিণত করা। এর মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটবে। গত একযুগ থেকে শুরু হওয়া ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রীয় বিবিধ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
লেখক পরিচিতি:
শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়