© শ্রী তপন কুমার ঘোষ
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। তারপর যজুর্বেদ এবং অথর্ব বেদও নিজেদের শ্লোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এই মন্ত্রকে। এই অন্তর্ভুক্তি কি আখেরে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের জনপ্রিয়তার ফল ? না কি বহুল পাঠের কারণে চারটি বেদের (ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব বেদ) মধ্যে তিনটিতেই গৃহীত হয়েছে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ? এমনই তার মাহাত্ম্য। শ্লোকের দিকে তাকালেই এই মন্ত্রের মাহাত্ম্য স্পষ্ট বােঝা যাবে।
ঋগ্বেদে বলছে —
ওম্ ত্র্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্ধনম্
উর্বারূকমিব বন্ধনান মৃত্যুর্মুক্ষীয় মামৃতাম্ ।।
অর্থাৎ, হে রুদ্র, তােমার বন্দনা করি। তুমি জন্ম, জীবন ও মৃত্যুত্রয়ীর জ্ঞানদৃষ্টির অধিকারী। তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের যােগানদাতা। তুমি সকল ভয়ঙ্কর ব্যাধি হতে ত্রাণকারী। আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তিদান কর, অমৃতত্ত্ব থেকে নয়।
মন্ত্রটিকে বিশ্লেষণ করলেও এর অর্থবহ দিকটিও আমাদের কাছে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে।
ওম্ঃ বলাই বাহুল্য হিন্দু সংস্কৃতির প্রায় কোনও মন্ত্রই ওম্ ছাড়া শুরু হয় না। বিশেষ করে শিবমন্ত্র। তাই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপের শুরুতেই ও উচ্চারণ করে শুদ্ধ করে নিতে হয় আত্মাকে। আর লক্ষ্য না করলেই নয়, ও উচ্চারণেও রয়েছে এক বিশেষ পদ্ধতি। নাভি থেকে উপরের দিকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে করতে হয় ওম শব্দের ধ্বনি। মানে, প্রাণায়াম শুরু হল এই ধ্বনি উচ্চারণ দিয়েই।
এ্যম্বকম্ঃ শিবের একটি নাম এ্যম্বক। মানে, যাঁর তিনটি চোখের মধ্যে একটি সূর্য, একটি চন্দ্র এবং অপরটি অগ্নি। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের এই তিনটিই তেজ প্রয়ােজন। তাই যে মন্ত্র উদ্ধার করতে পারে মৃত্যু থেকে, তার অধিকর্তা ঈশ্বরকে সম্বােধন করা হয়েছে এ্যম্বক নামে।
যজামহেঃ যজামহে মানে ত্র্যম্বককে যজন বা উপাসনা করি। তাকে শ্রদ্ধা জানাই।
সুগন্ধিমঃ যে ঈশ্বরকে ( রুদ্ররূপী মহাদেব ) এই মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি সুগন্ধিযুক্ত। এখানে শিবের সর্বাঙ্গে যে ভস্মের অনুলেপন, তাতেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে সুগন্ধি হিসাবে। মানে স্পষ্ট – এই নশ্বর জীবন একদিন ভস্মেই পরিণত হয়। কিন্তু মােক্ষ লাভ করতে পারলে, মৃত্যুভয় ( নশ্বর জীবনে মৃত্যু শাশ্বত সত্য ) কেটে গেলে ওই ভস্মই হয়ে ওঠে সুগন্ধির সমতুল্য।
পুষ্টিবর্ধনমঃ শিব, যিনি আমাদের মৃত্যু থেকে রক্ষা করেন, তিনি আমাদের পুষ্টিবর্ধনেরও সহায়ক। লক্ষ্য করার মতাে বিষয় – পুষ্টি হলেই শরীর নিরােগ হয়। তাই মহামৃত্যুঞ্জয়মন্ত্র শিবকে বর্ণনা করেছে। পুষ্টিবর্ধন রূপে।
উর্বারূকমিবঃ সংস্কৃতে উর্ব শব্দটি নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কারুর মতে উর্ব শব্দের অর্থ বিশাল, কেউ বা বলেন মৃত্যুর মতােই ভয়ানক। আর আরুকম মানে যা আমাদের রক্ষা করে এই ভয় থেকে।
বন্ধনানঃ বন্ধনান শব্দের মধ্যে বন্ধন শব্দটির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতাে। বিশাল, মৃত্যুর মতাে ভয় আসলে বন্ধনেরই নামান্তর। সেই বন্ধন থেকে আমাদের রক্ষা করেন মহামৃত্যুঞ্জয় শিব।
মৃত্যুর্মুক্ষীয়ঃ মৃত্যু থেকে উদ্ধার করা। অর্থাৎ শব্দটির সরলীকৃত করলে স্পষ্ট বােঝা যায় মৃত্যু ভয় থেকে উদ্ধার করা।
মামৃতামঃ মা শব্দটির অর্থসংস্কৃতে না। তাহলে দাঁড়ায় ? এই শব্দবন্ধে বলা হয়েছে যে, শিব আমাদের এখানে জীবনের আনন্দেই বােঝাচ্ছে।
মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র কীভাবে পৃথিবীতে এল? শিবপুরাণ বলে, এই মন্ত্রের আবিষ্কর্তা ঋষি মার্কেন্ডেয়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করে তিনি উদ্ধার পান মৃত্যুর হাত থেকে। তারপর এই মন্ত্র পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়। অন্য পুরাণ থেকে জানা যায়, প্রজাপতি দক্ষ চন্দ্রকে ক্ষয়রােগের অভিশাপ দিলে শিব পত্নী সতী এই মন্ত্র দান করেন চন্দ্রকে। সােমনাথ তীর্থে এই মন্ত্রপাঠ করে ক্ষয়রােগ থেকে মুক্তি পান চন্দ্র। আবার, স্বয়ং শিব এই মন্ত্র দান করেছিলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচাৰ্য্যকে। এই মন্ত্র পাঠ করেই তিনি দেবতাদের হাতে নিহত অসুরদের বাঁচিয়ে তুলতেন। তাই একে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রও বলা হয়।
পরিশেষে বলা চলে, ধর্মে বিশ্বাস থাকুক বা নাই থাকুক, মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের একনিষ্ঠ এবং সঠিক উচ্চারণ আমাদের চালনা করে সুস্থ জীবনের পথে। তার মূলে রয়েছে প্রাণায়াম। শারীরিক ও মানসিক শক্তির জোরেই মানুষ বলিষ্ঠ হয়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র মানুষকে উভয়দিক দিয়েই সতেজ করে। মৃত্যুকে জয় করা যায় না, কিন্তু মৃত্যুভয়কে জয় করাই মহাপ্রাণের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণ করে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দু সংহতির মাসিক মুখপত্র স্বদেশ সংহতি সংবাদের মে, ২০১৭ সংখ্যায়।