সিরাজের পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় নয়



Updated: 23 June, 2023 3:41 pm IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় নয়। সিরাজউদ্দৌলার মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। তাইতো সিরাজউদ্দৌলাকে যখন ইংরেজ সেনা বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তার দুপাশের অসংখ্য কৃষকেরা নিশ্চিন্তমনে জমি চাষ করছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুশিতে হাতেতালিও দিচ্ছিলেন। তাদের কাছে এ যুদ্ধ ছিল দুই সাম্রাজ্যবাদীর লড়াই। বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার ‘মৃদুভাষণ’ নামক প্রবন্ধ গ্রন্থে। শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন:

“২৬ মার্চ যখন ফিরে আসে তখন কবিগুরুর অনুপম চরণগুলো হৃদয়-মনকে উতলা করে তোলে।
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসে গর্ব করার মতো কি আছে তা নিয়ে অনেকেই লেখালেখি করেছেন। আমি এসব অতীত কাহিনী পড়ে তেমন উজ্জীবিত হই না। পাঠান আমলে বাংলাদেশে একটা স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এও সত্য যে, তৎকালীন পাঠানরা কোনো বিচারেই বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি জাতীয়তাবোধ তাঁদের কাছে অজ্ঞাত ছিল বলে আমি মনে করি। রাজ্য শাসনের সুবিধার জন্য এবং স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তাঁরা স্থানীয় ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা বাংলায় কথাও বলতেন না এবং আচার আচরণে খাঁটি বাঙালি সমাজের কাছাকাছিও ছিলেন না। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব স সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতির কাহিনী পড়ে আমরা বেদনা অনুভব করি, কিন্তু কেউ কি দাবি করবেন যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন? ইতিহাসে পড়েছি নবাব আলীবর্দী খান ইরান দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর দৌহিত্র সর্বাংশেই একজন ইরানী ছিলেন। হয়তো সে কারণেই আমরা দেখি, যখন পলাশীর আম্রকাননে লড়াই হচ্ছে তখন, তার পাশেই, শস্যক্ষেত্রে বাঙালি কৃষকরা নির্বিকারভাবে কৃষিকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল দুই বিদেশী শক্তির মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল অনুপস্থিত।”
(শাহ এ এম এস কিবরিয়া, ১৯৯৭: ৫)

এ প্রসঙ্গে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থের মধ্যযুগ নামক দ্বিতীয় খণ্ডে শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন:

২৯শে জুন ক্লাইব ২০০ ইউরোপীয়ান ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য লইয়া বিজয়গর্বে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করিলেন। ক্লাইব লিখিয়াছেন যে এই উপলক্ষে বহু লক্ষ দর্শক উপস্থিত ছিল। তাহারা ইচ্ছা করিলে শুধু লাঠি ও ঢিল দিয়া ইউরোপীয় সৈন্যদের মারিয়া ফেলিতে পারিত। কিন্তু বাঙ্গালীরা তাহা করে নাই । কারণ তাহারা এই মাত্র জানিয়াই নিশ্চিন্ত ছিল যে—
এক রাজা যাবে পুনঃ অন্য রাজা হবে ।
বাংলার সিংহাসন শূন্য নাহি রবে ।”
(শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, ২০০৫ : ১২২)

মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে মাত্র একবছর দুইমাসের মত শাসন ক্ষমতা ছিল। তিনি ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর্যন্ত কিঞ্চিদধিক এক বছর শাসন করেন। অথচ আমরা আমাদের বাল্যকাল থেকে পাঠপুস্তকসহ প্রত্যকটি স্থানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রসঙ্গে যে আলোচনা শুনেছি, তাতে আমার ধারণা ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা বহুদিন বাংলার শাসক ছিলেন। পরবর্তী ধীরেধীরে জানতে পারলাম তিনি মাত্র একবছরের মত বাংলার শাসক ছিলেন। প্রথম এ বিষয়টি জেনে আমি আশাহত হই। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে গিয়ে আরও নতুনভাবে অনেক তথ্য জানলাম। যে সকল তথ্যের অধিকাংশই পূর্বে জানা ছিল না। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে বিভিন্ন মিথ বাংলায় প্রচলিত আছে, যার অধিকাংশই সত্য নয়। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই তৈরি করে ইতিহাসের নামে চালানো। কিন্তু যার ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বিভিন্ন মিথের পিছনে দুটি কারণ। প্রথমত ধর্মগত সাদৃশ্যের কারণে, তার পূর্বপুরুষ তুর্কি থেকে আগত হলেও তাকে অনেক বাঙালি স্বদেশীয় প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তাদের অন্যতম যুক্তি হল, বাংলায় বা ভারতবর্ষে তুর্কি, পাঠান বিভিন্ন শাসকেরা বিদেশি বংশদ্ভূত হলেও, তারা যেহেতু এদেশে বসবাস করত তাই তার এদেশীয় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গৌরবান্বিত করার বিবিধ প্রচেষ্টা শুরু করে। সে লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করে।ব্রিটিশেরা যেহেতু নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে ধীরেধীরে বাংলার শাসনভার নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। তাই তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বার্থে ব্রিটিশ পূর্ববর্তী নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ অন্যান্য শাসকদের মহিমান্বিত করতে শুরু করে।

সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি ছিলেন না, তিনি বাংলায় কথা বলতেন কিনা সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত নয়। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সম্পূর্ণ নাম ছিল, মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ছিলেন আলীবর্দী খানের দৌহিত্র এবং জৈনুদ্দীন আহমদ খান ও আমিনা বেগমের পুত্র। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা তুর্কি জাতির বংশধর ছিলেন।আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম মির্জা মুহম্মদ আলী।তার পিতার নাম ছিলো মির্জা মুহম্মদ মাদানি। তুর্কি বংশোদ্ভূত মির্জা মুহম্মদ মাদানি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহের দরবারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দাদু আলীবর্দী খানের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। শুধুই তিন কন্যাসন্তান ছিল। তিনি তার কন্যাদের বড়ভাই হাজি আহমদের তিন ছেলের সাথে বিবাহ দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা দাদু আলিবর্দী বা ঠাকুর্দা হাজি আহমেদের বাবা মির্জা মুহম্মদ মাদানি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত। তাই পিতৃপুরুষের পরিচয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা আদতে তুর্কি বংশোদ্ভূত, কোনমতেই বাঙালি নয়।

আরেকটি বিষয় প্রতিনিয়ত বলা হয় যে, নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তথ্যটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, তথ্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রকৃত তথ্য হল, তখনো পর্যন্ত ভারতবর্ষ মুঘল শাসনের অধীনে ছিল। যেহেতু মুঘল সম্রাট ছিলেন, তাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন স্বাধীন শাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন, তৎকালীন দিল্লীর মুঘল সম্রাটের পক্ষে বাংলার আঞ্চলিক প্রতিনিধি। এককথায় বলতে গেলে, তিনি সম্রাট ছিলেন না, তিনি ছিলেন সম্রাটের অধিনস্থ বাংলার নবাব। অনেকটা বর্তমানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধিনস্থ মুখ্যমন্ত্রীর মত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র সম্পর্কে ইতিহাসকারগণ যে সকল তথ্য দিয়েছেন, সেই তথ্যানুযায়ী তাকে সচ্চরিত্রের অধিকারী হিসেবে চিহ্নিত করা দুষ্কর। মাতামহ আলিবর্দী খানের মৃত্যুশয্যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তার ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করানো হয় যে, তিনি মদ্যপান থেকে বিরত থাকবেন। নিয়মিত মদ্যপান অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য তিনি মদ্যপান থেকে পরবর্তীতে বিরত ছিলেন কিনা এ নিয়ে ইতিহাসকারগণ ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি।বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’ -তে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ প্রবন্ধে নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে বলা হয়েছে:

“এটি সম্ভবত সত্য যে, নওয়াব হিসেবে সিরাজ ছিলেন খানিকটা উদ্ধত এবং খুব সম্ভবত কিছুটা অসহিষ্ণু। এক কথায় তিনি সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অস্থির চিত্তের সিরাজের মধ্যে দৃঢ়তার অভাব ছিল। এছাড়া সংকটকালে সিদ্ধান্তহীনতাও তাঁর অন্যতম ত্রুটি। তবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে, সিরাজ তখন ছিলেন মাত্র চবিবশ বছরের এক অপরিণত যুবক। ক্ষমতা ও উচ্চাসন তাঁকে কিছুটা বেপরোয়াও করে তুলেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল এই যে, অনভিজ্ঞতার কারণে তিনি তাঁর সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই সাথে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন, তারা যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে সেরূপ কোন পদক্ষেপ তিনি নেন নি। এরূপ সাবধানতা অবলম্বনে তাঁর ব্যর্থতা এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করার মতো মানসিক দৃঢ়তার অভাবের কারণেই তাঁর পতন হয়।”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক মহান বাঙালি ছিলেন। তাঁর রচনায় কারো সম্পর্কে খুব একটা নেতিবাচক মন্তব্য চোখে পড়ে না। কিন্তু তিনি তাঁর রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ’ গ্রন্থে নবাব সিরাজুদ্দৌলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্বোধ, নৃশংস, ও অবিমৃশ্যকারী, কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক মানুষের সঙ্গী, নারীর সতীত্ব লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোন সুশাসক ছিলেন না। তিনি ছিলেন নিয়ন্ত্রণহীন এক তরুণ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কাছে পরাজয় না হলেও তার নবাবী দিল্লির মুঘল সম্রাটেরা এমনিতেই কেড়ে নিতেন। কারণ সকতজঙ্গের বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদানসহ সুবাদারীর প্রার্থনায়, দিল্লীর মুঘল সম্রাট একপ্রকার সম্মত হয়ে গিয়েছিলেন।

“সকতজঙ্গ, সিরাজউদ্দৌলার সুবাদার হইবার কিঞ্চিৎ পূর্বে, রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহারা উভয়েই তুল্যরূপ নির্বোধ, নৃশংস, ও অবিমৃশ্যকারী ছিলেন; সুতরাং, অধিককাল, তাঁহাদের পরস্পর সম্প্রীত ও ঐক্যবাক্য থাকিবেক, তাহার কোনও সম্ভাবনা ছিল না।

সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কর্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল । তাহারা, প্রতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্রায় কোন ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই ।

রাজ্যের প্রধান প্রধান লোকেরা, এই সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া, তাঁহার পরিবর্তে, অন্য কোনও ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইবার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। তাঁহারা, আপাততঃ, সকতজঙ্গকেই লক্ষ্য করিলেন। তাঁহারা নিশ্চিত জানিতেন, তিনি সিরাজউদ্দৌলা অপেক্ষা ভদ্র নহেন; কিন্তু, মনে মনে এই আশা করিয়াছিলেন, আপাততঃ, এই উপায় দ্বারা, উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইয়া, পরে, কোনও যথার্থ ভদ্র ব্যক্তিকে সিংহাসনে নিবিষ্ট করিতে পারিবেন।

এ বিষয়ে সমুদয় পরামর্শ স্থির হইলে, সকতজঙ্গের সুবাদারীর সনন্দ প্রার্থনায়, দিল্লীতে দূত প্রেরিত হইল।আবেদন পত্রে বার্ষিক কোটি মুদ্রা কর প্রদানের প্রস্তাব থাকাতে অনায়াসেই তাহাতে সম্রাটের সম্মতি হইল।”
(বিদ্যাসাগর, ২০০২: ১১১৯)

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথার সত্যতা পাওয়া যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে। তার রচিত ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা -ই-মহব্বত জঙী’ গ্রন্থে তিনি নবাব সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে বলেছেন:

“সিরাজ-উদ-দৌলা এই পৃথিবীর রাজত্বে তৃপ্ত ছিলেন না এবং (কোনো কিছুতেই তিনি) সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর অত্যধিক অত্যাচারের মাত্রা, অত্যধিক রক্তপিপাসুতা ও সীমাহীন গালিগালাজপ্রিয়তা এই দেশের সব সিংহের পিত্তকে পানিতে পরিণত করতে পারত। আজ তাঁর মাথার উপরে ছিল একটি টুপি, (পরিধানে) ছিল পায়জামা এবং কাঁধে ছিল একটি কম্বল। সেই অবস্থায় পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি এই ধরণীর একটি ক্ষুদ্র কোণ মাত্র প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাঁর এই বিধ্বস্ত দেহ বিরাট বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ালে তিনি তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণের সুযোগ আর পাননি এবং মহা প্রতিশোধ গ্রহণকারী বিচারকের আদেশে মৃত্যুর তরবারি তাঁর সব আকাঙ্ক্ষার শিকল ছিন্ন করে দেয়। মীর মোহাম্মদ জা’ফর খান বাহাদুরের আদেশে তাঁকে মহাবত জঙের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়। এই ঘটনা এগারশ একাত্তর হিজরী সনের ১৫ই শওয়াল তারিখে ঘটে। তাঁর রাজত্বকাল দুর্যোগপূর্ণ হলেও এক বছর তিন মাস ছিল।”
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, ১৯৯৭:১৯০-৯১)

নবাব সিরাজউদ্দৌলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, ফরাসী অধ্যক্ষ জ্যাঁ ল সিরাজের বন্ধু ছিলেন, সুতরাং তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না । তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে যা লিখেছেন তার সারমর্ম হলো :

“আলীবর্দীর মৃত্যুর পূর্বেই সিরাজ অত্যন্ত দুশ্চরিত্র বলিয়া কুখ্যাত ছিলেন। তিনি যেমন কামাসক্ত তেমনই নিষ্ঠুর ছিলেন । গঙ্গার ঘাটে যে সকল হিন্দু মেয়েরা স্নান করিতে আসিত তাহাদের মধ্যে সুন্দরী কেহ থাকিলে সিরাজ তাঁহার অনুচর পাঠাইয়া ছোট ডিঙ্গিতে করিয়া তাহাদের ধরিয়া আনিতেন। লোক-বোঝাই ফেরী নৌকা ডুবাইয়া দিয়া জলমগ্ন পুরুষ, স্ত্রী ও শিশুদের অবস্থা দেখিয়া সিরাজ আনন্দ অনুভব করিতেন। কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে বধ করিবার প্রয়োজন হইলে আলীবর্দী একাকী সিরাজের হাতে ইহার ভার দিয়া নিজে দূরে থাকিতেন, যাহাতে কোন আর্তনাদ তাঁহার কানে না যায়। সিরাজের ভয়ে সকলের অন্তরাত্মা কাঁপিত ও তাঁহার জঘন্য চরিত্রের জন্য সকলেই তাঁহাকে ঘৃণা করত।”
(শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, ২০০৫ : ১১৮-১১৯)

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমসাময়িক ইউসুফ আলি খানের বিবরণে ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী’ গ্রন্থের মত নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু এবং পরবর্তী মৃতদেহের বিবরণ ‘মোজাফফরনামা’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়। মোজাফফরনামা গ্রন্থটির রচয়িতা হলেন, করম আলি খান। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহকে কি পরিমাণে অমর্যাদা করা হয়েছিলো সে বিবরণ করম আলি খানের মোজাফফরনামায় পাওয়া যায়:

“সিরাজের দেহে বিশটি আঘাত করেও কাজ শেষ করতে না পেরে মোহাম্মদী বেগ তাঁর সঙ্গীদের মধ্য থেকে একজন মোঘলকে এ কাজের জন্য নিযুক্ত করে এবং সে ব্যক্তি ছোরার এক আঘাতেই সিরাজের জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। তাঁর দেহ একটি হস্তীর পৃষ্ঠে স্থাপন করে সীমাহীন অমর্যাদার সঙ্গে সমগ্র নগরে ঘোরানো হয়। সেই হস্তী সিরাজের জননীর বাসভবনের সামনে আসলে তিনি খালি পায়ে ও খালি মাথায় দৌড়িয়ে এসে হস্তীর পায়ের কাছে নিজেকে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু খাদিম হোসেন খানের লোকজন তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। (সিরাজের মৃতদেহ নিয়ে) খাদিম হোসেন খানের বালাখানার সামনে উপস্থিত হলে তিনি নির্লজ্জ হয়ে মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য একখানা বস্ত্র মৃতদেহের উপর নিক্ষেপ করেন।

অবশেষে সিরাজের মৃতদেহ বাজারের চত্বরে নিক্ষেপ করা হলে কেউ তা দাফন করতে সম্মত হয়নি। এই পরিবারের ঐতিহ্যকে স্মরণ রেখে এবং নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে মীর্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল মৃতদেহকে গোসল করান এবং একটি কফিনে ভরে তা আলিবর্দীর কবরের পাশে সমাধিস্থ করেন। সিরাজের রাজত্বকাল পনেরো মাস স্থায়ী হয়।”
(আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, ১৯৯৮: ১২৮)

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয়ে বাঙালির পরাজয়ে বাঙালি পরাধীন হয়নি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন প্রভু বদল হয়েছিল মাত্র।এদেশীয় ক্ষমতা এক সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে গিয়েছিলো মাত্র। তুর্কিদের হাত থেকে ক্ষমতা গিয়েছিলো কিছুটা সভ্য ব্রিটিশদের হাতে। অবশ্য ব্রিটিশরাও এদেশে কম অপকর্ম করেনি, তাদের বিবিধ অপকর্মের অভিঘাতে উদ্ভুত হয় এই বাংলায় কয়েকটি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। এর মধ্যে ভয়াবহ ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৭৭০) সংগঠিত দুর্ভিক্ষটি। ইতিহাসে এ দুর্ভিক্ষটি ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। সে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করে প্রায় এক কোটি অসহায় বাঙালি।

তথ্য সহায়তা:
১. আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত), ইউসুফ আলী খান, তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙী, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, জুন১৯৯৭

২.আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (অনূদিত),
মোজাফফরনামা ও নওবাহার- ই-মুর্শিদকুলী খানি,ঢাকা: বাংলা একাডেমী, মার্চ ১৯৯৮

৩. তীর্থপতি দত্ত ( সম্পাদিত),বিদ্যাসাগর রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা: তুলি-কলম, মার্চ ২০০২

৪. শাহ এ এম এস কিবরিয়া, মৃদুভাষণ, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড,১৯৯৭

৫. সিরাজউদ্দৌলা,বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৫

৬.শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, কলিকাতা: জেনারেল পাব্লিশার্স, ২০০৫

লেখক পরিচিতি:

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়