© ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
যখন অনুভব করবো সব পেয়েছির এক দেশে রয়েছি; এক অবাধ, অভূতপূর্ব স্বাধীনতার নেশা ধরেছি; যার ঘোর কিছুতেই কাটছে না৷ যাঁর কাছে যাবার পথটা নান্দনিক, থরে-বিথরে আনন্দে ভরা। আমার অন্তরের মধ্যে তিনি অনায়াস-জায়গা করে নিচ্ছেন, তাঁর মধ্যেও রেখে দিচ্ছেন আমার প্রকোষ্ঠ। যে প্রকোষ্ঠে আমি আর তিনি অভিন্ন, অমোচ্য, অপূর্ব এবং অনন্ত; আমিই ‘সেই’ — তিনি মেঘ, আমি মেঘাস্থি; তিনি ভূমি, আমি ভৌমজল; তিনি পর্বত, আমি পার্বত্য শিলা; তিনি আনন্দ, আমি উৎফুল্লতা। আর্দ্রতার জলকণা দিয়ে অভিন্ন করে রেখেছি তাঁর কর্দম কণা, যে কাদার একমেটে দোমেটে দিয়ে তিনিই আমার ঐশী-কাঠামো গড়বেন। তিনি আমার গুরু। আজ সেই গুরু আমার জীবনে আবির্ভূত হোন।
গুরু এবং আচার্যের প্রভেদ কী?
গুরু সার্বিক মানসচর্চার স্ফূরণে সহায়তা করেন, ফলে শিষ্য এক পবিত্র-সুন্দর জীবনচর্যা পান।শিক্ষক বা আচার্য অধীত সর্বোত্তম জ্ঞান বিদ্যার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত করেন, জীবনে প্রয়োগ-পথের সন্ধান দেন। অনেক আচার্য গুরু হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু সব গুরুই যে আচার্য হবেন, এমন নাও হতে পারে। গুরু বা বরিষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশে একজন শিষ্য এক বা একাধিক শিক্ষক বা আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। গুরু সার্বিক দিকটি দেখেন, সার্বিক জীবনবোধ তৈরি করে দেন।গুরুর দর্শনকে বিশ্বাস করেন যিনি, মানেন যিনি, দীক্ষা নেন যিনি; তিনিই তাঁর শিষ্য।
গুরুপূর্ণিমা দিবসের তাৎপর্য
এ বছর ৩ রা জুলাই, ২০২৩ গুরুপূর্ণিমা। এই দিনে আমি জন্মগুরু, শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু নির্বিশেষে শিক্ষার সকল উৎসমুখকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই আর স্নেহ-ভালোবাসা জানাই সেই প্রবহমান ধারার নিম্নমুখ অর্থাৎ ছাত্র-শিষ্য-বিদ্যার্থীদের।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল গুরুমুখী। যার কেন্দ্রাচার ছিল আষাঢ়ী গুরুপূর্ণিমা উদযাপন।”গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণু গুরর্দেবো মহেশ্বরঃ।/ গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নম।।” জ্ঞান সমুদ্রের সমস্ত স্রোত গুরুর থেকে নেমে আসছে। তিনিই সব হয়েছেন। তিনিই চৈতন্যস্বরূপ।
উপনিষদে আছে ‘সোহহম’, আমিই সেই, ‘I am He’। এটা কোন আমি? আমি দু’প্রকার: প্রত্যক্ষ আমি বা ‘অহং’। যাকে বলতে পারি ‘একলা আমি’, ‘স্বার্থগত আমি’; রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কাঁচা আমি’; স্বামীজী বলছেন ‘ছোট আমি’। আর একটি হচ্ছে অপ্রত্যক্ষ আমি বা ‘ভূমা’; এ হল ‘বড় আমি’, ‘পাকা আমি’, সকল আমির সমষ্টিগত আমি। ‘আমার’ এই নিত্য পথ পরিক্রমা। কে দেখাবেন পথ? আমার গুরু, আমার শিক্ষক। আমার মধ্যেই সব আছে। তা সুপ্তিতে আছে। স্বামীজী বলছেন, “Education is the manifestation of perfection already in man”. গুরু বা শিক্ষক হচ্ছেন একটি ‘উশকো কাঠি’। বৌদ্ধশাস্ত্রে আছে ‘ব্রহ্ম বিহার’ কর। ছোট আমির মধ্যে বড় আমির প্রকাশ মধুর কর। নিজের মধ্যে অন্যের জন্য মৈত্রী পোষণ কর।
শিক্ষক ছাত্রের ক্ষেত্রে এটা কি হবে? শিক্ষক-শিক্ষকে কি হবে? ছাত্রে-ছাত্রে কি হবে? উপনিষদে আছে — ” ওঁ সহনাববতু সহনোভুনক্তু সহবীর্যং করবাবহৈ/ তেজস্বীনাবোধিতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ। / ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।” আমরা শিক্ষক-ছাত্র সমভাবে বিদ্যার্জন করব; সমভাবে বিদ্যার ফল লাভ করব; সকলে সুস্থ-সবল নীরোগ জীবনযাপন করব; কেউ কারো প্রতি বিদ্বেষী হব না; আমাদের মধ্যে সকল শান্তি-সুখ বিরাজিত হোক।
বিদ্যাগার থেকে পূর্ণ মানুষ হয়ে বেরোতে হবে — নিজেকে অবিরত চিনে, নিজেকে জেনে, নিজের চিন্তা চেতনাকে উপলব্ধি করে। তবেই কিন্তু বৈজ্ঞানিক ঘটনাবলীকে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারব।কারো ধার করা চিন্তা নয়, চিন্তা চুরি করে নয়। স্বাধীন চিন্তাধারা না এলে জ্ঞান-বিজ্ঞান পরিপুষ্ট হবে না। উল্টোদিকে জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে যা মণি-মাণিক্য খুঁজে পেলাম তাকে জীবনের প্রয়োজনে আনতে হবে; জীবনের সমস্যা সমাধানের কাজে লাগাতে হবে।
সমস্ত Biological system, Solar system যদি অনুধাবন করি, দেখব সবই শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাই জীবনপথে চলাটাও হবে শৃঙ্খলাবদ্ধ। ‘একলা আমি’-র সিদ্ধান্ত নয়, সকল আমির সহমতই হচ্ছে সভ্যতার চালিকা শক্তি। বিদ্বেষ -বিষ নাশ করতে না পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগোবে না, সমাজ গতি পাবে না। পূর্ণ মানুষই যথার্থ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ। মনুষ্যত্ব লাভ করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
গুরুপূর্ণিমার পুণ্যদিনে ব্যক্তি নয়; জ্ঞান-ত্যাগ-সংযম-পরাক্রম সহ নানান শুভঙ্করী গুণের প্রতীক পরম পবিত্র গৈরিক ধ্বজকে পরম শ্রদ্ধায় গুরুর আসনে বসিয়ে আত্মসমর্পণের ভাবগাম্ভীর্য বহন করে আনে। ব্যক্তি মানুষ নয়, সমাজ বা রাষ্ট্রই হল আরাধ্য দেবতা, দেশের মাটিই হল জননী। গুরুপূর্ণিমার দিনে এই গৈরিক ধ্বজ বা মোক্ষ-রঙের রূপক-সংকেতে আপন অন্তরের সকল মণিমাণিক্য নিয়ে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণই হল শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা।
গুরু বন্দনা
মনের সুপ্তি-পূর্ণতা যাহা তাহা
স্ফুলিঙ্গ আসি সহসা পাড়িল তারে
কে তুমি, দীপ জ্বালাইলে মম দ্বারে?
স্নেহ বারি রাশি ঝরিয়া পড়িল, আহা।
মনের সুপ্তি-পূর্ণতা যাহা তাহা।
তোমা হতে নামি আসিল গো দেব, মানি
বনিলে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর;
জ্ঞান সাগরের যত ছিল চরাচর
তুমি এনে দিলে অনিকেত মহা-বাণী।
তোমা হতে নামি আসিল গো দেব, মানি।
বিদ্বেষ-বিষ দূর করো মোর যত
অর্জিব মোরা সমভাবে সব শিখন
নীরোগ দেহে কাড়ি নিব যম-লিখন;
শান্তি সুখ দূরিবে মনের ক্ষত।
বিদ্বেষ-বিষ দূর করো মোর যত।
ওগো সুন্দর, আমার জীবন গড়ো
চিনি যেন মোরে নিজেরেই অবিরত
চেতনা মিলিবে মুক্তি ডালায় যত
পূর্ণ করি রে, নিজে হই বড়সড়।
ওগো সুন্দর, আমার জীবন গড়ো।
সাগর সেঁচিয়া খুঁজে পাই মণি-মানিক
প্রয়োজনে তাহা লাগে জীবনের কাজে
যেথা যত রোগ জীবনের দুখ বাজে
সমাধান আনি, যে যত পেরেছি খানিক।
সাগর সেঁচিয়া খুঁজে পাই মণি-মানিক।
জীবনের সুর বাধা আছে একতানে
জীবনপথে চলাটা শেখাও প্রভু
মন-রথে যেন অসুর না হই কভু
মোর সংগীত মিলুক তোমার গানে।
জীবনের সুর বাধা আছে একতানে।