© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
এই পরম পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গ মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী নগরীতে অবস্থিত। উজ্জয়িনী ভারতের একটি প্রাচীন জনপদ । শিপ্রা নদীর তীরে অবস্থিত এই উজ্জয়িনী পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এই নগরের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নগরীর প্রাচীন নাম ছিল অবন্তিকা ক্ষেত্র। ভারতের সাতটি মোক্ষদাত্রী তীর্থক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম হলো অবন্তিকা ক্ষেত্র। বাকি ছয়টি হল অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, কাঞ্চি, পুরী ও দ্বারাবতী। এই নগরের নাম উজ্জয়িনী হওয়ার কারণ রূপে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাণ অনুযায়ী ত্রিপুরাসুরকে বধ করার জন্য স্বয়ং মহাদেব এই অঞ্চলের মহাকাল অরণ্যে রক্তদন্তিকা চন্ডী দেবীর আরাধনা করেন এবং দেবীর নিকট থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভ করেন। সেই অস্ত্রের দ্বারা তিনি ত্রিপুরাসুরকে বধ করেন। শত্রুকে উজ্জিত বা পরাজিত করার অস্ত্র এই স্থান থেকেই মহাদেব লাভ করেছিলেন বলে এই স্থানের নাম হয় উজ্জয়িনী। আর অবন্তিকা কথাটি এসেছে অবন শব্দ থেকে। অবন অর্থাৎ রক্ষা করেন। প্রাচীনকাল থেকে এই নগরী দেবতা, তীর্থ, ওষধি, বীজ ও প্রাণীদের রক্ষা করে আসছে । তাই এই নগরীর নাম অবন্তিকা। বাল্মীকি রামায়ণ, মহাভারত, শিব পুরাণ অগ্নিপুরাণ লিঙ্গ পুরাণ, গরুর পুরাণ – সর্বত্র এই পবিত্র নগরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মগধ সম্রাট বিন্দুসার এবং অশোকের সময়ও উজ্জয়নী ছিল এক ঐশ্বর্যশালী নগরী। অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রার জন্ম হয় এই নগরীতেই । সম্রাট বিক্রমাদিত্য ছিলেন উজ্জয়িনীর মহাপরাক্রান্ত নরপতি। সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এই স্থান কে নাভি তীর্থ বলেছেন। আজকের পৃথিবীতে যেই রূপ গ্রীনিচকে পৃথিবীর মধ্যবিন্দু বলে ধরা হয় , সেইরূপ প্রাচীনকালে
উজ্জয়িনীকে পৃথিবীর মধ্যবিন্দু বলে ধরা হত। এই নগরীকে কেন্দ্র করে সময় বা কালের হিসাব করা হত বলেই এই নগরীর অধিপতিকে মহাকাল বলা হয়।
কবি কালিদাস উজ্জয়িনী কে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
” দিব: কান্তিমৎখন্ডসেকম্ “
অর্থাৎ স্বর্গ থেকে খসে পড়া একটি অংশ। আরো যেসব বিখ্যাত আমরা উজ্জয়িনী শাসন করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন হর্ষবর্ধন। হর্ষবর্ধনের আমলে ভারতে আসা চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর বিবরণীতে উজ্জয়িনী নগরের বর্ণনা করেছেন। সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আমলে ভারতে আসা আরেক চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন এর বর্ণনা থেকেও আমরা উজ্জয়িনীর উল্লেখ পাই। হর্ষবর্ধনের পরে এই রাজ্যের অধিকার নিয়ে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট বংশের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং এরপর এখানে পারমার বংশ আধিপত্য স্থাপন করে। পারমার বংশের শেষ রাজা শিলাদিত্য মন্ডর সুলতানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলে উজ্জয়িনী মুসলিম সুলতানদের হস্তগত হয় এবং শুরু হয় উজ্জয়িনীর দুর্দশা কাল। মোঘল আমলের একেবারে শেষ দিকে উজ্জয়িনী মারাঠা সিন্ধিয়া বংশের হাতে আসে। তখন থেকে উজ্জয়িনী তে আবার মন্দিরগুলির সংস্কার হয় শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের আবার প্রসার ঘটে।
এহেন উজ্জয়িনীতে অবস্থান করছেন শ্রী মহাকালেশ্বর। মহাভারত, শিব পুরাণ এবং স্কন্দপুরাণে এই জ্যোতির্লিঙ্গের মহিমা সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
এই জ্যোতির্লিঙ্গের আবির্ভাব নিয়েও বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই দেবতা ও অসুরদের মধ্যে চলছিল দীর্ঘ সংগ্রাম। সংগ্রামের কারণ অমৃতের অধিকার। অবশেষে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সাময়িক সন্ধি হয়। ঠিক হয় যে অমৃত লাভের জন্য ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করা হবে l অমৃত পাওয়া গেলে দেবাসুর তা সমান ভাগে ভাগ করে নেবে।
এই সন্ধি অনুযায়ী শুরু হলো সমুদ্র মন্থন। মন্দার পর্বত হল মন্থন দন্ড: শেষ নাগ রজ্জু। দেবতারা ধরলেন শেষ নাগের লেজের দিকটা আর অসুররা সামনের দিকটা। দীর্ঘদিন ধরে চলল সমুদ্র মন্থন। লক্ষীদেবী থেকে শুরু করে ধন্বন্তরী পর্যন্ত অনেক কিছু প্রাপ্তি হল সমুদ্র মন্থনে, কিন্তু সেসব দিকে কারুর লক্ষ্য নেই। সবাই অপেক্ষা করে আছেন অমৃত কুম্ভের । শেষপর্যন্ত দেবী কমলা অমৃত কুম্ভ নিয়ে উঠে এলেন।
ক্লান্ত শ্রান্ত দেবাসুর গণ যখন সাময়িকভাবে বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখন পরিকল্পনামাফিক ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত অমৃত কুম্ভ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। প্রথমে অসুররা তা খেয়াল করেননি। কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেয়ে জয়ন্তকে তাড়া করলেন অসুররা। ছুটতে লাগলেন জয়ন্ত। সারাদিন ছোটার পর সন্ধ্যাবেলায় অমৃতকুম্ভ জলের নীচে রেখে বিশ্রাম নিলেন। পরদিন ভোর থেকে আবার ছুট। এভাবে পথে তিনি চার জায়গায় অমৃতকুম্ভ রেখেছিলেন। এই চার জায়গা তেই কুম্ভ থেকে অল্প অল্প অমৃত পড়েছিল। তাই এই চারটি জায়গা বড় পবিত্র। এই চার জায়গার মধ্যে রয়েছে শিপ্রা তীরবর্তী উজ্জয়িনী, গোদাবরী তীরবর্তী নাসিক, ত্রিবেণী সঙ্গমে অবস্থিত প্রয়াগরাজ, আর গঙ্গাতীরের হরিদ্বার।
বারো দিন পরে জয়ন্ত ধরা পড়লেন। কিন্তু শ্রীনারায়ণের নারী অবতার মোহিনী অসুরদের থেকে ছলনা করে ছিনিয়ে নিলো সেই অমৃত। কামাতুর অসুররা মোহিনীর ছলনায় অমৃত হাতছাড়া করলেন। দেবতারা পেলেন অমৃত। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্যদিকে। শেষ নাগের মুখ থেকে বের হতে লাগল বিশ্ব
প্লাবী হলাহল। বিষের প্রভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছিল সৃষ্টি। সৃষ্টি রক্ষা করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা তখন স্তব করতে লাগলেন মহাকালের। শিপ্রা ও গন্ধবতী নদীর সঙ্গম এর পাশে প্রতিষ্ঠিত হলো শিবলিঙ্গ। আবির্ভূত হলেন মহাদেব, আর সেই হলাহল পান করে তিনি হলেন নীলকন্ঠ।
শিপ্রা নদী তীরের সেই শিবলিঙ্গই মহাকাল নাম নিয়ে, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম জ্যোতির্লিঙ্গ হয়ে আজও বিদ্যমান।
আরেকটি কথা অনুযায়ী এই উজ্জয়িনী নগরে একদা চার ভাই ছিলেন – দেবপ্রিয়, মেধাপ্রিয়, শুক্রত আর ধর্মবাবু। এই চার ভাই ছিলেন পরম শিব ভক্ত এবং তাঁদের দিন কাটতো শিব পূজা করে । এই সময় দূষণ নামে এক রাক্ষসের আবির্ভাব ঘটে। ব্রহ্মার বরে তিনি ছিলেন দুর্বিনীত। নিজের শক্তি প্রতিষ্ঠা করবার জন্য তিনি শেষ করে দিচ্ছিলেন সবাইকে। একে একে সবাই তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে থাকেন । যিনি অবাধ্য হলেন তাঁকেই মেরে ফেললেন দূষণ।
অবন্তিকার নিরীহ মানুষরা কেউই রেহাই পেল না দূষণের অত্যাচার থেকে। অবশেষে সাধারণ মানুষ শরণাপন্ন হল শিব ভক্ত চার ভাইয়ের। সেই চার ভাই অত্যাচারীর হাত থেকে নগরকে রক্ষা করতে বসলেন শিব পূজায়। ঠিক তখনই আবির্ভাব ঘটলো দূষণ আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের। দূষণ দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো শিব পূজারত চার ভাই আর উপস্থিত জনতার উপর।
ঠিক তখনই প্রচন্ড শব্দে ফেটে গেল মাটি। আবির্ভূত হল এক শিবলিঙ্গ। প্রকট হলেন ভগবান শংকর আর দূষণ দের দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর হুংকার করে উঠলেন। সেই হুংকার আর তেজ সহ্য করার ক্ষমতা ছিলনা দূষণ আর তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গদের। অচিরেই ধ্বংস হলো দূষণ ও তাঁর সঙ্গীরা।
মহাকাল তখন ফিরে তাকালেন তাঁর চার ভক্তের দিকে। হাতজোড় করে ভক্তগণ মহাদেব কে আবেদন জানালেন,
” প্রকট যখন হয়েছেন, থেকে যান এখানেই। এই পবিত্র জায়গা তে যারা আপনাকে দর্শনের অভিলাষ নিয়ে আসবে তারা যেন আপনার দেখা পায়। “
সেই থেকে শিব রয়ে গেলেন জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে, আর নাম হলো শ্রী মহাকালেশ্বর
এই জ্যোতির্লিঙ্গ বিষয়ে আরো একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পুরাকালে উজ্জয়িনীতে তখন রাজত্ব করতেন রাজা চন্দ্রসেন। তিনি ছিলেন পরম শিব ভক্ত। একদিন রাজা যখন শিবপূজা রত ছিলেন, তখন রাজ বাড়ির পাশ দিয়ে শ্রীকর নামে একটি পাঁচ বৎসরের গোপ বালক মায়ের সঙ্গে যাচ্ছিল। রাজার শিবপূজা দেখে সে অত্যন্ত বিস্মিত ও কৌতূহলী হয়ে ওঠে। সে নিজেও ওই প্রকার সামগ্রী সহকারে শিব পূজা করার জন্য ব্যাকুল হয়। কিন্তু এতসব সামগ্রী সে সংগ্রহ করতে পারে না। শুধুই এক টুকরো পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসে, ওই পাথরটি কে শিব রূপে স্থাপন করে, পুষ্প ও চন্দন শোভিত করে, শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করতে থাকে।
মা তাকে খাবার জন্য ডাকলেও, সে পূজা ছেড়ে ওঠেনা। মা বিরক্ত হয়ে ওই পাথরের টুকরোটি তুলে দূরে ফেলে দেন। ছেলেটি দুঃখ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে উচ্চৈঃস্বরে ভগবান শিবকে ডাকতে থাকে। শেষে কান্নার ফলে সেখানেই অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ে।
ভগবান শিব বালকের এই ভক্তি ও প্রীতিতে অত্যন্ত প্রসন্ন হন। চৈতন্য যখন ফিরে আসে, তখন সেই বালক দেখে তার সামনেই স্বর্ণ ও রত্নাদি ভূষিত এক বিশাল সুন্দর মন্দির। আর সেই মন্দিরের মধ্যে অবস্থান করছেন ভাস্বর, তেজস্বী জ্যোতির্লিঙ্গ।
বালক আনন্দে বিভোর হয়ে শিবের স্তুতি করতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে তার মা ছুটে আসে। রাজা চন্দ্রসেন সেখানে উপস্থিত হন। বিশাল জনসমাগম ঘটে। তখন সেখানে প্রকটিত হন শ্রীহনুমান। তিনি বলেন,
” ভগবান শংকর বালকটির ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাকে এমন ফল দান করেছেন, যে বড় বড় ঋষি, মুনি কোটি কোটি জন্মের তপস্যা দ্বারা লাভ করতে পারেন না। এই বালকটির অষ্টম বংশে নন্দ গোপের জন্ম হবে। আর দ্বাপর যুগে ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণ অবতার রূপে তাঁর ঘরে নানাপ্রকার লীলা করবেন।”
এই বলে হনুমানজি অন্তর্হিত হলেন। আর সেই স্থানেই জ্যোতির্লিঙ্গের আরাধনা করে শিবলোক প্রাপ্তি হল রাজা চন্দ্র সেন আর শ্রীকর গোপের।
উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের গর্ভগৃহ ভূগর্ভস্থ। শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মহাকালের নিকট যেতে হয়। মহাকাল বেশ বড়, কালোপাথরের দক্ষিণমুখী স্বয়ম্ভু জ্যোতির্লিঙ্গ। যেহেতু উজ্জয়িনী তান্ত্রিকদের সাধন ক্ষেত্র , তাই মহাকাল এখানে দক্ষিণামূর্তি। জ্যোতির্লিঙ্গের পূর্ব প্রান্তে বিশাল রৌপ্য নির্মিত ত্রিশূল ও ডমরু। মন্দিরের উত্তর দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে অবস্থান করছেন শ্বেতপাথরের দ্বারা নির্মিত দেবী পার্বতীর মূর্তি। পশ্চিম দিকের কুলুঙ্গিতে রয়েছেন শ্রীমান গণপতি আর পূর্বদিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রয়েছেন শ্রী কার্তিকেয়। মহাকালের মন্দিরে সপরিবার মহাকালের পূজাই হয়ে থাকে। মহাকালের পূজার বিশেষত্ব হচ্ছে চিতা ভস্ম দ্বারা মহাকালের আরতি। প্রত্যহ ভোরে এই ভস্মারতি হয়ে থাকে।মহাকালের একপাশে দুটি অখন্ড জ্যোতি প্রদীপ অবস্থান করছে । এদের একটি তেলের, অন্যটি ঘিয়ের। পাশে রয়েছে রুপা নির্মিত বিরাট সর্প ফণা। ভূগর্ভস্থ এই গর্ভগৃহের উপরে এক তলায় রয়েছে আরেকটি শিব মন্দির একতলায় অবস্থানরত শিব হলেন লিঙ্গ নাথ ওংকারেশ্বর আর দ্বিতলে রয়েছেন শিব নাগচন্দ্রেশ্বর। মন্দির নাগ পঞ্চমীর দিন সর্বসাধারণের জন্য খোলা হয়।
উজ্জয়িনী শ্রীমহাকালেশ্বর মন্দির এর কাছেই ছিল সন্দীপনি মুনির আশ্রম। শহর থেকে দূরে সুন্দর গাছপালায় ঘেরা পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত এই তপোবন। এই আশ্রমেই দাদা বলরাম আর বন্ধু সুদামাকে নিয়ে শাস্ত্র ও শস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এখানে একটি বহু প্রাচীন শিবলিঙ্গ এবং আরো প্রাচীন একটি নন্দীমূর্তি আছে। সামনেই রয়েছে বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক শ্রী বল্লভাচার্যের আশ্রম। এখানে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুদামার পাথর নির্মিত বিদ্যার্থী মূর্তি । গুরু সন্দীপনী মুনির মূর্তিও রয়েছে সেখানে। আর সেখানে আছে একটি কুণ্ড। কথিত আছে এই কুন্ডে গুরুদেবের স্নানের জন্য গোমতী নদীর আবির্ভাব ঘটান শ্রীকৃষ্ণ।
এই উজ্জয়িনীতে ই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ভারতীয় ঋষিরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের প্রথম মানমন্দির। খ্রিস্টের জন্মের দীর্ঘদিন আগে গ্রীস দেশের পণ্ডিতরা এই মান মন্দিরে বসে জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা করে গেছেন। সেই মানমন্দির আজ ধুলোয় মিশে গেছে।
উজ্জয়িনীর পথে পথে ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। বিষ্ণুগুপ্তের নির্দেশে উজ্জয়িনী কে রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। বিন্দুসারের রাজত্বকালে অশোক ছিলেন উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা। সম্রাটের মৃত্যুর খবর পেয়ে অশোক সৈন্য সামন্তসহ রাজধানী মগধে যান ও বড় ভাই কে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। তারপর তিনি যান কলিঙ্গ অভিযানে। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক এর হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে। চন্ডাশোক পরিণত হন
ধর্মাশোকে। সন্ন্যাসী উপগুপ্তের কাছে নেন দীক্ষা। তারপর উজ্জয়িনীতে গড়ে তোলেন বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা কেন্দ্র হিসাবে।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য মগধ থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন উজ্জয়িনীতে। তাঁর রাজসভার নবরত্নগণ (অমরসিংহ, কালিদাস,
ক্ষপণক,ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি,
বরাহমিহির, বররুচি, বেতালভট্ট, ও শঙ্কু ) তাঁদের পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার দ্বারা এই নগরকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করেন।
মহাকাল মন্দিরের একটু দূরেই অবস্থিত হরসিদ্ধি মন্দির। এই মন্দিরটি একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম। কথিত আছে এখানে দেবীর কনুই পতিত হয়েছিল। এখানে গর্ভ মন্দির ছোট এবং সেখানে অবস্থান করছে দেবীর সিঁদুর দীপ্ত শিলাময়ী মূর্তি। এই মন্দিরটির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নাম। সম্রাট ছিলেন তান্ত্রিক সাধক( প্রমাণ পাওয়া যায় বিক্রম বেতাল গল্পের দ্বারা) । কথিত আছে দেবীর কাছে রাজা বিক্রমাদিত্য ঘোর তপস্যা করে ছিলেন এবং এগার বার নিজের মাথা কেটে মায়ের চরণে অর্পণ করেছিলেন। মায়ের কৃপায় আবার তাঁর মাথা জোড়া লেগে যায় এবং তিনি বেতাল সিদ্ধ হন। জনশ্রুতি আছে এখানেই দেবী মহাদেবের ইচ্ছায় ছন্দ ও প্রচন্ড নামে দুই অসুর কে বধ করেছিলেন। দেবী হরসিদ্ধির ভৈরব হলেন গৈরিক বসন ধারী মঙ্গল নাথ। মঙ্গল নাথের মন্দির অবস্থিত বেশ খানিকটা দূরে শিপ্রা ও গন্ধবতী নদীর তীরে। দুটি মন্দিরের মধ্যে ব্যবধান কয়েক মাইলের। পূর্বে দুটি মন্দির ছিল কাছাকাছি। দুটি ই ছিল নগরের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। কিন্তু মুসলিম শাসকদের আমলে অনেক মন্দির ধ্বংস করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হরসিদ্ধি মন্দির ও। তারপর নতুন করে দক্ষিণ প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী হর সিদ্ধি। হরসিদ্ধি মন্দিরে রয়েছে শ্রী গনেশ এবং পঞ্চমুখী হনুমানের মূর্তি। এখানে বিরাটকায় গণেশ মূর্তির দুই পাশে রয়েছেন দেবী ঋদ্ধি ও সিদ্ধি।
হরসিদ্ধি মন্দিরের নিকটেই রয়েছে বিক্রমাদিত্য মন্দির। এখানে সম্রাট বিক্রমাদিত্য রাজকীয় ভাবে বসে রয়েছেন সিংহাসনে । আর তার চারপাশে, ওপরে ও নিচে বত্রিশটি পুতুল সাজানো । কথিত আছে এটাই সেই কিংবদন্তি বত্রিশ সিংহাসন।
উজ্জয়িনীর আরো একটি দর্শনীয় স্থান রাজা ভর্তৃহরির গুহা। রাজা ভর্তৃহরি ছিলেন মালব্য রাজ গন্ধর্ব সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর তিনি উজ্জয়িনীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং ভোগবিলাসে মত্ত হন। পরবর্তীকালে তাঁর মনে পরিবর্তন আসে এবং তিনি এক গুহার মধ্যে কঠোর তপস্যা করে আত্মদর্শন করেন। এই গুহাই হল ভর্তৃহরি গুহা।এখানে রাজা ভর্তৃহরির কালোপাথরে নির্মিত ছোট মূর্তি রয়েছে । তার পাশে রয়েছে একটি ত্রিশূল । এছাড়াও নাথ সম্প্রদায়ের গোরক্ষনাথ ও গোপীচন্দ্রের মূর্তি রয়েছে এখানে।
১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস উজ্জয়িনী জয় করেন এবং প্রাচীন মহাকাল মন্দির ও প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। এরপর থেকে শুরু হয় উজ্জয়িনীর অন্ধকার যুগ। অবশেষে ১৭৩৩ সালে জয়পুরের রাজা জয় সিং, মারাঠা নেতা সিন্ধিয়া ও তাঁর ধর্মপত্নী বায়জা বাঈ এর চেষ্টায় উজ্জয়িনী ধীরে ধীরে তার প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরে পেতে লাগল। অষ্টাদশ শতকে রুদ্র সাগরের কাছে আবার তৈরি হলো মহাকাল মন্দির। বর্তমানে এই মন্দিরে অবস্থান করছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম শ্রী মহাকালেশ্বর।
শ্রীমহাকালেশ্বর এর অবস্থানের জন্যই উজ্জয়িনী সনাতনধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান। আজ ওইখানে বসে কুম্ভমেলা, যা বিশ্বের বৃহত্তম মেলা হিসাবে পরিগণিত হয়। কুম্ভ যোগে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী স্নান করেন উজ্জয়িনীর শিপ্রা নদীতে!
‘উজ্জয়িন্যাং পূর্ণকুম্ভে
চতুর্দেশসমন্বিতে/ যোগে শিপ্রা নদে স্নানং পূর্বজন্ম ন বিদ্যতে।’
তথ্য ঋণ:
১. শিব ঠাকুরের বাড়ি: সোমনাথ
দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড।
২. ওম নমঃ শিবায়: গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর।
৩. দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ : স্বামী অচ্যুতানন্দ । উদ্বোধন কার্যালয় , কলকাতা