© শে খ র ভা র তী য়
পুরো ভারতে সাজোসাজো রব, ইক্ষ্বাকু বংশের মহারাজা অজের প্রপৌত্রের রাজ্যাভিষেক হবে। পুরো শহর রাজপ্রাসাদ আলোতে সাজানো, ছেলেটিও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাজ সিংহাসনে আরোহন করার জন্য এরকম সময় এক দূত এসে জানাল, দাদা আপনাকে এই মুহূর্তে বনবাসে যেতে হবে রাজ্য ত্যাগ করে। প্রায় একরাতে নোটিশে রাজ্য-রাজত্ব নিজের পরিচয় ছেড়ে এক কাপড়ে স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন যুবক, হাঁটা লাগালেন, ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজ্যসীমা ছাড়াতে হবে যে৷ যুবকের নাম? শ্রী রামচন্দ্র। কি কিছু মিল পেলেন?
নোয়াখালি/কুমিল্লা কিংবা এরকমই কোথাও জমিদার বাড়ির বড় ছেলে ডাক্তারি পাশ করেছে কয়েকদিনের মধ্যেই তার বিয়। সে জন্য পুরো জমিদার বাড়ি সেজে উঠেছে পুরো আলোয় আলোয়, গ্রামেও খুশির জোয়ার৷ হঠাৎ এক দূত এসে খবর দিল,
রাতারাতি বনবাসের যন্ত্রণা বাঙালিদের মতো করে সারা ভারতে আর কারা বুঝতে পারবে? রামকে সারা ভারতে বাঙালির থেকে আর ভালো কে অনুভব করবে? রাম সারা ভারতে বাঙালির চেয়ে আর বেশি কার?
যে দিন অযোধ্যা থেকে রাজত্ব ছেড়ে বনবাসে বেরিয়েছিলেন দশরথের বড় ছেলেটি সেদিন তাঁর পরিচয় ছিল দশরথ তনয়, বনবাসে এসে প্রতিপদে যাকে লড়াই করতে হয়েছিল একমুঠো খাবারের জন্য, স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য৷ কখনও পরস্ত্রী এসে প্রলোভন দিয়েছে বিপথগামী হওয়ার কখনও কুচক্রীরা এসে হরণ করেছে স্ত্রীকে৷ সে সময় সারা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশ ইক্ষ্বাকু বংশের জ্যোষ্ঠপুত্রকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল সারা ভারতের রাজারা। কিন্তু না, বনবাসী রাম বাকল পরেছেন, জল কাদা, জঙ্গলে কাঁচা বাড়ি বানিয়ে থেকেছেন, বনের উপজাতিদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী রাবণের বিরুদ্ধে, আদিবাসী সবরীর এঁটো কুল খেয়ে জাতিবাদের বিরুদ্ধে খড়্গ ধরেছেন। একদিন বনবাসী হয়ে রাজ্য ত্যাগ করেছিলেন ১৪ বছর পর ফিরেছেন মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম হয়ে৷
ঠিক যেন মরিচঝাঁপি কিংবা ওড়িশার জঙ্গল, জল কাদায় খড় বাঁশের ঘরে আশ্রয় নিয়ে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা কোন বাঙালি ছেলে। রাম তো শুরু থেকেই বাঙালি জীবনের অংশ। রামের লড়াইকে তো বারবার পাথেয় করেছে বাংলা।
মহাপরাক্রমশালী রাবন, যার বিরুদ্ধে সে সময় সারা ভারতে অস্ত্র ধরতেও ভয় পেত, সেই রাবনের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র আন্দোলন করার পর বিভীষণ যখন সোনার লঙ্কাতে কিছুদিন কাটানোর কথা বলছেন তখন শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় শ্রীরাম বলছেন,
জননী জন্মভূমিশ্চ সর্গাদপী গরীয়সী।
এ যেন দেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হিটলারের পাশে বসে জানিয়ে আসা, ‘যা করছি দেশের জন্য, যা করছি জন্মভূমির জন্য।’
এ যেন, নোবেল পেয়ে দেশে ফিরে এসে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা শিকাগো জিতে দেশে ফিরে আসা স্বামী বিবেকানন্দের জীবন শৈলী, জন্মভূমির চেয়ে বড় আর কী? এভাবেই তো রামের জীবনশৈলী বরাবর সাধারণ হিন্দু বাঙালির জীবন জুড়ে প্রবাহিত হয়েছে৷
রাম কোনও মহাকাশের ঈশ্বর নন, রাম কোনও কল্পনা পুরুষও নন, না রাম উত্তরভারতের ৷ অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য WBCS -এর প্রস্তুতি ছেড়ে প্রাইভেট ফার্ম কিংবা টিউশানিতে যোগ দিচ্ছে যে বাঙালি ছেলেটি, ভাইকে পড়াবে বলে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে কাঁচি চালাচ্ছে যে বাঙালি যুবক৷ স্কুলের প্রেমিকাকে স্ত্রী হিসেবে নিজের কাছে পেতে বছরের পর বছর ধরে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে যে বাঙালি যুবক সেই তো রাম৷ রামের আলাদা কোনও গ্রহান্তরের মানুষ নন, রাম এক ভারতীয় আদর্শ, যা প্রতিটি ভারতীয়ের মতোই বাঙালি সমাজ জীবনযাপনে মিশে রয়েছে, যদি আমাদের জীবনে শ্রীরাম রয়েছেন ততদিন আমাদের জীবন রামায়ণের মতো গতিশীল, মৃত্যুহীন, কালজয়ী৷ রাম সরলেই ব্যস…
আজ সারা দেশ জুড়ে এক শ্রেণির মানুষ রামকে, রামের সংস্কার ও সংস্কৃতিকে বিপক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কেন জানেন? কারণ রাম হচ্ছে সেই DNA যার মধ্যে ভারতীয় সভ্যতার সমস্ত কোড সাজানো আছে৷ যা এত বছর পরেও নতুনদের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির বীজ বুনে চলেছেন৷ রাম এমন এক নাম যা সারা ভারতকে এক সূত্রে বাঁধে৷ রাম নামের DNA টিকে ভাঙতে পারলেই ভারতীয় সভ্যতা ও একতাকে ভাঙা সহজ হবে, এটা ওরা জানে৷ সেটার চেষ্টা হচ্ছে সব রকমভাবে, রাবন মারা গিয়েছে রাবনের DNA তো এখনও শেষ হয়নি!
কৃত্তিবাস ওঝা ছাড়ুন, বিজেপি, আরএসএস ছাড়ুন। বাংলার হৃদয়ে রাম এমনভাবে মিশে রয়েছেন যে খোদ কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
নব দূর্বাদল-শ্যাম জপ মন নাম শ্রীরঘুপতি রাম।
সুরাসুর কিন্নর যোগী মুনি ঋষি নর,
চরাচর যে নাম জপে অবিরাম॥
সজল-জলদ-নীল নব-ঘন-কান্তি
নয়নে করুণা, আননে প্রশান্তি
নাম শরণে টুটে শোক-তাপ-শ্রান্তি
রূপ নেহারি মূরছিত কোটি কাম॥