ভব্য শ্রীরাম মন্দির ও একটি অনুভব কথন



Updated: 29 January, 2024 8:27 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

শ্রীরাম ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম এক স্তম্ভ; ভারতের আত্মা, চেতনা,নীতি ও বিচারের নাম হল শ্রীরাম। শুধু ভারত নয়, জম্বুদ্বীপ অর্থাৎ সমগ্র এশিয়াতেই তিনি অনুসরণীয় এক চরিত্র। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসে এবং মহর্ষি বাল্মীকির রচনায় তিনি পালনের দেবতা শ্রীবিষ্ণুর অবতার। শ্রীরাম হলেন আদর্শ রাজা, সনাতন হিন্দু ধর্মের রক্ষক, ত্যাগের আদর্শে মহিমান্বিত, অন্যায় ও অধর্মের বিনাশকারী বীর যোদ্ধা। তাই তাঁর জন্মভূমিতে তাঁর মন্দির তৈরি ও পূজা হবে – একথা বলা বাহুল্যমাত্র। কিন্তু ষোড়শ শতকে অযোধ্যার ভূমিতে সেই রমলালার ( শ্রীরামের বাল্যরূপ ) মন্দির ভেঙে বহিরাগত মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি একটি অবৈধ ধাঁচা তৈরি করেছিলেন। সেটিকে সরিয়ে শ্রীরামের ভব্য মন্দির পুনঃ প্রতিষ্ঠা ছিল সনাতন সমাজের কাছে এক অগ্নিপরীক্ষা। আজ প্রায় পাঁচশত বছর পর সনাতন হিন্দু সমাজের সংঘর্ষ সাফল্যের আলো দেখল। ২০১৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ওই স্থানে ভব্য শ্রীরাম মন্দিরের পুনঃ নির্মাণ সুনিশ্চিত হয়েছিল। এরপর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট হয় ভব্য শ্রীরাম মন্দিরের ভূমি পুজন।

আজ ভব্য শ্রীরাম মন্দিরের মূল মন্দিরের কার্য সম্পন্ন হয়েছে। বিগত ২২ জানুয়ারী, ২০২৪, সোমবার শুক্লা দ্বাদশী তিথিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল অযোধ্যার নব নির্মিত ভব্য শ্রীরাম মন্দিরের। এ এক অমৃত কাল, পাঁচশত বছর পর শ্রীরামের ঘরে ফেরার কাল যার সাক্ষী হল আমাদের বর্তমান প্রজন্ম।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা ছিলেন রঘুবীর অর্থাৎ শ্রীরাম। কথামৃতে তিনি বলেছেন, ” যে রাম দশরথের ছেলে, আবার জগত সৃষ্টি করেছেন; আর সর্বভূতে আছেন। আর অতি নিকটে আছেন। অন্তরে বাইরে। ” তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনায় শ্রীরামকে সত্যপরায়ণতা ও নীতির সাকার মূর্তি, আদর্শ তনয়, আদর্শ পতি সর্বোপরি আদর্শ রাজা রূপে বর্ণনা করেছেন। ‘স্বামী শিষ্য সংবাদ’ গ্রন্থে তাঁকে আমরা বলতে শুনি যে দেশটাকে তুলতে গেলে শ্রীরামচন্দ্র ও হনুমানের পূজা, শক্তি পূজা চালাতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রাচীন সাহিত্য নামক প্রবন্ধে বলেছেন, “একথা বলে নাই যে, এ ( রামায়ণ ) কেবল কাব্য কথা মাত্র। ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য নহে, রাম লক্ষণ সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য। ” গান্ধীজীও বুঝেছিলেন রাম নামের মাহাত্ম। তাই শোনা যায় জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তিনি শ্রীরামের নামই করেছিলেন। এহেন ভারতে যেখানে যুগ যুগ ধরে ছোট মেয়েদের দেবীর আর ছেলেদের শ্রীরামের প্রতিরূপ ধরা হয়, সেখানেও আশ্চর্যজনকভাবে হয়েছে শ্রী রামের জন্মভূমিতে শ্রীরামের মন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরোধিতা। যারা সেই বিরোধিতা করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কমিউনিস্ট এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ এবং সঙ্গে মুসলিম সমাজের কিছু অংশ। এরা ভাবেনি ভগবান শ্রীরাম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ কী বলে গেছেন; কেন গান্ধীজী ‘রাম’ নামে আসক্ত ছিলেন। উল্টে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সময় ( ১৯৪৭ , ১৫ আগস্ট) ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করে, ভারতের পূর্বদিকের এক অংশকে এবং পশ্চিম দিকের আরেক অংশকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করে বাকি ভারতকে তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ করার লালসায় তাঁরা শ্রীরামকে নিজ ভূমি ও দেশ থেকে উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয়েছে। এরা ভাবেনি ভারত ভূমিতে যে সকল মানুষ বসবাস করেন, তাদের উপাসনা পদ্ধতি যাই হোক না কেন, তাঁরা সকলেই শ্রীরামের উত্তরসূরী। কারণ শ্রীরাম যে সময়ে রাজত্ব করেছেন, তখন ভারতে একটি ধর্মই ছিল, যেটি হল সনাতন হিন্দু ধর্ম। তাছাড়া মন্দির গড়ে শ্রীরামের পূজার অর্থ হল শ্রীরামের গুণাবলীর পূজা ।

ভগবান বুদ্ধও তাই বলেছেন। বহু জন্ম পূর্বে তিনিই ছিলেন রাম আর গুরু গ্রন্থ সাহেবেও একাধিকবার রয়েছে রাম নামের অস্তিত্ব। যাইহোক, নির্বোধ, ইতিহাস বিকৃতকারী কমিউনিস্ট ও ছদ্ম সেকুলারদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে অবশেষে অযোধ্যার মাটিতে তৈরি হয়েছে প্রভু শ্রীরামের ভব্য মন্দির।

১৯৯০-এর দশকে যখন শ্রীরাম মন্দির পুনঃনির্মাণের জন্য আন্দোলন প্রবল হয়, তখন সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কারণ তখন আমার নিতান্তই বালক অবস্থা। কিন্তু ভগবান শ্রীরাম ভক্তকে নিরাশ করেন না। প্রভুর আশীর্বাদে ভব্য শ্রীরাম মন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে কিছু কাজ করার সুযোগ পাই ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। সেই কাজ ছিল ঘরে ঘরে সম্পর্ক করে মন্দির নির্মাণের জন্য নিধি সংগ্রহ। শ্রীরামপুর নগরের দুটি ওয়ার্ডে জন সম্পর্ক করতে গিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পাই। এমন নয় যে কেউ কটুক্তি করেনি কিংবা নিধি দিতে অস্বীকার করেন নি, কিন্তু সিংহভাগ মানুষ তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিধি দান করেছিলেন আনন্দের সঙ্গে। এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন কখন নিধি সংগ্রহে লোক আসবে। সেই সময় প্রায় ৭৫০টি পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক করে প্রভু শ্রীরামের ইচ্ছায় ১৮২২০ টাকা সংগ্রহ হয়েছিল। সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও নিধি দানের পবিত্র আনন্দ অনুভব করেছিলাম।

ঠিক তিন বছর পরে আবার শ্রীরামের কার্যের অভূতপূর্ব সুযোগ যেন অপেক্ষা করছিল। এবারের কাজ হল অযোধ্যায় রামলালার ভব্য মন্দিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো। পবিত্র হলুদ মেশানো ‘অক্ষত’ চাল, আমন্ত্রণ পত্র আর ভব্য মন্দিরের ছবি নিয়ে গৃহ সম্পর্ক করা আর সেগুলি প্রদান করে গৃহবাসীদের অযোধ্যা আসার আমন্ত্রণ করা। এবারে যা সাড়া পাওয়া গেল সেটা বর্ণনাতীত। এবারে দায়িত্ত্ব ছিল শ্রীরামপুর নগরের চারটি ওয়ার্ডের। সেই চারটি ওয়ার্ডে আমন্ত্রণ জানানো হল ২৩৭২ টি পরিবারকে। বিশেষ সাহায্য পেলাম আরো ২৫ জন রামভক্তের। আমাকে নিয়ে মোট ২৬ জনের দল। প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করে পেলাম অভূতপূর্ব আনন্দ। যখন সমমনোভাবাপন্ন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে জন সম্পর্ক করছিলাম, মনে হচ্ছিল আমরা সবাই যেন প্রভু শ্রীরামের বানর সেনা, যারা প্রত্যেকে ভক্ত কবি তুলসিদাসের ভাষায় ‘রামকাজ করিবে কো আতুর’। শীতের রাতে ঠান্ডা উপেক্ষা করে রাম কাজ করার যে আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। সেই আনন্দ আরো প্রবল হচ্ছিল যখন আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে খুশিতে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল গৃহবাসীদের ; কেউ কেউ আবার জয় ধ্বনি দিচ্ছিলেন শ্রীরামের। সংস্কৃত ভাষায় ‘রাম’ শব্দের অর্থ হল আনন্দদায়ক। রাম সকলকে আনন্দ দিতেন, রাম নাম সংকীর্তনও আমাদের প্রদান করে নির্মল আনন্দ। আর এই রামকাজ করতে গিয়ে যে আনন্দ লাভ হল তা আমৃত্যু স্মরণে থাকবে। যাঁরা আগ্রহ ভরে অক্ষত চাল, ছবি ও আমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ করলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অনেক প্রবুদ্ধ ব্যাক্তি যেমন চিকিৎসক, আইনজীবী, সৈনিক, শিক্ষক, অধ্যাপক, পৌরপ্রতিনিধি প্রমুখ। সম্পর্কিত ২৩৭২ পরিবারের মধ্যে ৮ টি পরিবার বিবিধ কারণে আমন্ত্রণ পত্র গ্রহণ করতে অস্বীকারও করলেন, আবার কেউ কেউ কটুক্তিও করলেন। তবে পরিসংখ্যানের বিচারে তাঁরা এতটাই ক্ষুদ্র সংখ্যক যে তাঁদের উপেক্ষা করা যেতেই পারে। কোন গাছেরই একশো শতাংশ ফুল ভগবানের চরণে নিবেদনের যোগ্য হয় না; দুই একটি ত্রুটিযুক্ত থাকে। এনারাও সেই প্রকার।

পরিশেষে বলা যায় যে আমাদের দেশ তথা হিন্দু জাতি আজ দাড়িয়ে আছে এক যুগ সন্ধিক্ষণে। শ্রী রামের নামে আজ সারাদেশ তথা হিন্দু জাতি ঐক্যবদ্ধ। সারাদেশ আজ রামময়; রামময় সকল গর্বিত হিন্দুর মনও। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। রাম মন্দির আমাদের রাষ্ট্র মন্দির : হিন্দু জাতির অস্মিতার প্রতীক। একে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। সেই মন্দিরের জন্য ক্ষুদ্র কিছু কাজ করে মনে হল দুর হল জীবনের সকল অপ্রাপ্তি। ঈশ্বরের কাছে নিবেদন এই জন্মেই যেন শ্রীরামের কিছু গুণাবলী অনুকরণ করতে পারি আর আগামী জন্মে যেন ফিরে আসি এই ভারতভূমিতে এক গর্বিত হিন্দু পরিবারে আর ভূমিষ্ঠ হই যেন শ্রীরামের স্মৃতিধন্য অযোধ্যার মাটিতে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)