সেঙ্গল বা রাজদণ্ড: গৌরবময় ইতিহাসের পুনঃপ্রতিষ্ঠা



Updated: 22 June, 2023 10:41 am IST

© সূর্য শেখর হালদার

বিগত ২৮ মে ২০২৩ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্ত্বপূর্ণ দিবস। এই সেই দিন, যেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন স্বাধীন ভারতে নির্মিত নতুন সংসদ ভবন । ওই সংসদ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পূর্বে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি সেঙ্গল(Sengol) বা দন্ড যা ধর্মনিষ্ঠ এবং সার্বভৌমভাবে রাজ্য শাসনের প্রতীক। একুশ জন অধিনাম বা পুরোহিত চেন্নাই থেকে নতুন দিল্লি এসে এই দণ্ড প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ বলেন যে সেঙ্গল হল পবিত্র রাজদণ্ড যা স্বাধীনতার সময় ব্রিটিশদের থেকে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় একই প্রকার সেঙ্গল তুলে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর হাতে। দক্ষিণ ভারতের চোল রাজারা রাজ্যাভিষেকের সময় এই রূপ সেঙ্গল ধারণ করতেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, চোল রাজবংশ দক্ষিণ ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে রাজত্ব করে এবং চোল রাজবংশ বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ যা স্থায়ী ছিল ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, অর্থাৎ দেড় হাজারেরও কিছু বেশি সময় ধরে। চোল রাজারা ছিলেন হিন্দু, আর হিন্দু ধর্মের পরম্পরা মেনেই তাঁরা সেঙ্গল ব্যাবহার করতেন। কিন্তু কি সেই পরম্পরা যা সেঙ্গলের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করল আধুনিক ভারতকে?

বঙ্গ এবং হিন্দী ভাষায় সেঙ্গল শব্দের অর্থ হয় দণ্ড। মনুস্মৃতি এবং মহাভারতে সার্বভৌম শাসনের প্রতীক রূপে দন্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। মনুস্মৃতির ৭. ১৫- ২০ শ্লোকে দন্ডের উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। ৭.১৫ শ্লোক অনুযায়ী পরমাত্মা তাঁর পুত্র রূপে দন্ডের সৃষ্টি করেন। পরে মনুস্মৃতিতে বলা হয় যে দন্ড ব্যবহার করতে হলে সেটা করা উচিত কোন গুণসম্পন্ন শাসকের যিনি রাজ্য শাসনের সমস্ত নীতি ও আইন ভালোভাবে জানেন। রাজ্যকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই এই দন্ড ব্যবহারযোগ্য : কোনরকম বাজে উদ্দেশ্যে দন্ড ব্যবহার করা অনুচিত।

মহাভারতের শান্তি পর্বের ১২২ তম অধ্যায় দন্ডকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রক্ষক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে দন্ড হল দেবী সরস্বতী দ্বারা নির্ধারিত নিয়ম ও আইন মেনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিরাপদ রাখার পন্থা । মহাভারতে দন্ডের উৎপত্তির ইতিবৃত্তও বর্ণিত হয়েছে। একবার ব্রহ্মা স্থির করলেন যে তিনি যজ্ঞ করবেন। তিনি হাজার বছর ধরে তাঁর গর্ভকে কপালে প্রতিস্থাপন করে যজ্ঞ করতে লাগলেন। একবার ব্রহ্মা হঠাৎ হাঁচি নির্গত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গর্ভের ভ্রূণ পতিত হল। সেই ভ্রূণ থেকে জন্মানো সন্তানের নাম হল ক্ষপ। যিনি পরবর্তীকালে ব্রহ্মার যজ্ঞের পুরোহিত হলেন কিন্তু যজ্ঞের দিকে অধিক মনোযোগ দেবার ফলে দন্ড অন্তর্হিত হল। ফলত: সর্বত্র শুরু হল বিশৃঙ্খলা। তখন ব্রহ্মা শিবের নিকট পৌঁছলেন। শিব অনেক চিন্তা করে নিজেই দন্ডের আকার ধারণ করলেন। ( এই কারণেই দন্ড বা সেঙ্গলে আমরা নন্দীদেবকে দেখতে পাই। শিব পুরাণ অনুযায়ী তিনি হলেন শিবের অবতার) ভগবান শিব বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন প্রমুখ সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব ব্যবহারের ক্ষমতা তাঁদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। দেবতাদের রাজা রূপে তিনি নিযুক্ত করলেন ইন্দ্রকে। যজ্ঞ শেষ হয়ে যাবার পর ভগবান শিব দণ্ড তুলে দিলেন ভগবান বিষ্ণুর হাতে। ভগবান বিষ্ণু দণ্ড প্রদান করলেন মহর্ষি অঙ্গিরাকে। মহর্ষি অঙ্গিরা দিলেন মহর্ষি মরীচিকে। হস্তান্তরিত হতে হতে শেষে ভগবান মনু দণ্ডপ্রাপ্ত হলেন। উল্লেখ্য এই মনুই হলেন বিশ্বের অধিপতি ইক্ষ্বাকু কিম্বা রামের পূর্ব পুরুষ।

এভাবেই দেখা যায় ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী দন্ড হল ধর্মরক্ষার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রীর হাতে দন্ড তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন ঘটল। ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পাঠান, মোঘল আর ইংরেজদের নিকট পরাধীন থাকার পর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পায় ভারত। তবে অনেক শিক্ষিত ভারতীয় এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঔপনিবেশিক মানসিকতা । ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা এবং পরানুকরণের মাধ্যমে এনারা নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে সচেষ্ট। সে কারণেই ভারতের কিছু নাগরিককে দেখা গেল নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে সেঙ্গলের ব্যবহারের বিরোধিতা করতে।

CLICK HERE to read the original Story