© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
পুরাকালে শ্রীরামের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন যাঁর নাম ছিল সগর। রাজা সগরের ছিল দুই রানী – বিদর্ভের রাজকন্যা কেশিনী এবং কশ্যপের কন্যা ও গরুড়ের ভগিনী সুমতি। মহর্ষি ভৃগুর আশীর্বাদে কেশিনির গর্ভে রাজার একটি পুত্র এবং সুমতির গর্ভে একটি পুত্রের জন্ম হয়। কেশিনীর পুত্রের নাম ছিল অসমঞ্জ। এই অসমঞ্জ কালক্রমে দুর্বৃত্ত ও অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। তাই রাজা সগর তাঁকে নির্বাসিত করলেন। অংশুমান নামে তাঁর একটি পুত্র ছিল। অংশুমান ছিলেন প্রিয়ভাষী ও বীর্যবান।
একবার রাজা সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী দেশে এই যজ্ঞের আয়োজন হল । অংশুমান যজ্ঞের অশ্বের অনুগমনে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু ইন্দ্র রাক্ষসের মূর্তি ধারণ করে যজ্ঞের অশ্ব চুরি করলেন এবং কপিল মুনির আশ্রমে অশ্বকে বেঁধে রাখলেন। এদিকে যজ্ঞের অশ্ব না পেয়ে রাজা তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে অশ্ব অন্বেষণ করতে পাঠালেন। তিনি রাজপুত্রদের বললেন যে যজ্ঞের অশ্ব অনুসন্ধানে পৃথিবী তন্ন তন্ন করতে।
রাজপুত্ররা সর্বত্র অনুসন্ধান করেও যজ্ঞাশ্ব পেলেন না। তখন তাঁরা প্রত্যেকে শূল ও হল দ্বারা ধরিত্রী ভেদ করতে লাগলেন। সগর সন্তানদের পৃথিবী খননে বহু প্রাণী বিনষ্ট হল। তখন দেবতা ও গন্ধর্ব গণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা বললেন বাসুদেব বর্তমানে কপিল রূপ ধারণ করেছেন। কপিলের রোষে সগর পুত্ররা ধ্বংস হবে। ধরাতল খনন করতে করতে সগর পুত্ররা অবশেষে উত্তর-পূর্বে বাসুদেবের নিকট উপস্থিত হলেন। আশ্রমের অদূরে তাঁরা যজ্ঞের অশ্বটিকে দেখতে পেলেন। তখন তাঁরা কপিলকে যজ্ঞের অশ্ব হরণকারী মনে করে আক্রমণ করলেন। মহাত্মা কপিল তখন ষাট হাজার সগর সন্তানকে ভস্ম করলেন।
এদিকে পুত্রদের ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় সগর তাঁর পৌত্র অংশুমানকে তাঁর পিতৃব্যদের অন্বেষণে পাঠালেন। অংশুমান তাঁর পিতৃব্যদের দ্বারা খনন করা একটি ভূগর্ভস্থ পথ দিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে তিনি যজ্ঞের অশ্বটিকে দেখতে পেলেন। অংশুমানের মাতুল গরুড় তাঁকে তাঁর পিতৃব্যদের পরিণতি সম্পর্কে অবহিত করলেন, এবং বললেন যে একমাত্র গঙ্গার সলিলে সগর সন্তানদের ভস্মরশি প্লাবিত করলে, তবেই তাঁরা স্বর্গলোকে যাবেন। অংশুমান যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে ফিরে এসে পিতামহকে সকল সংবাদ দিলেন। সগরের যজ্ঞ সমাপন হল, কিন্তু গঙ্গাকে আনার কোন উপায় তিনি নির্ধারণ করতে পারলেন না।
রাজা সগর স্বর্গলোকে গমন করলে অংশুমান ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা হলেন । অংশুমান তাঁর পুত্র
দিলীপকে রাজ্যভার দিয়ে হিমালয়ে তপস্যা করতে গেলেন এবং শেষে তিনিও স্বর্গ লাভ করলেন। দিলীপ অনেক চিন্তা করেও গঙ্গা অবতরণের উপায় অনুসন্ধান করতে পারলেন না। অবশেষে তাঁরও ইন্দ্রলোক প্রাপ্তি হল এবং ইক্ষ্বাকু বংশের নতুন রাজা হলেন তাঁর পুত্র ভগীরথ।
ভগীরথ ছিলেন ধর্মহীন কিন্তু নিঃসন্তান। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্য চালনার ভার দিয়ে গোকর্ণ প্রদেশে গিয়ে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসার জন্য ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করলেন । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রপিতমহদের মুক্তি। মহারাজ ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা প্রকট হলেন এবং ভগীরথকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। ভগীরথ দুটি বর চাইলেন। প্রথমত: তাঁর প্রপিতামহগণের স্বর্গলাভ আর দ্বিতীয়তঃ ইক্ষ্বাকু
বংশের বিলুপ্তি প্রতিরোধ (যেহেতু তিনি নিঃসন্তান)।
ব্রহ্মা তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবার বর দিলেন, কিন্তু বললেন যে গঙ্গার পতন পৃথিবী সহ্য করতে পারবে না। তাই গঙ্গা অবতরণের সময় স্বয়ং মহাদেব যেন গঙ্গাকে ধারণ করেন। মহাদেবকে এই কাজে নিযুক্ত করার জন্য ভগীরথ অঙ্গুষ্ঠাগ্রে ধরাতলে ভর দিয়ে এক বৎসর কঠোর তপস্যা করলেন। মহাদেব এই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে গঙ্গাকে মস্তকে ধারণ করতে সম্মত হলেন । এইবার গঙ্গা বিরাট কায় ধারণ করে আকাশ থেকে দুঃসহ গতিতে মহাদেবের মস্তকে পড়তে লাগলেন। গঙ্গার ইচ্ছা হল তিনি স্রোতের বেগে শংকরকে ভাসিয়ে পাতালে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ভগবান শংকর গঙ্গার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে ক্রুদ্ধ হলেন এবং বুদ্ধি করে তাঁর জটামন্ডলীতে গঙ্গাকে অবরুদ্ধ করলেন।
তস্যাবলেপনং জ্ঞাত্বা ক্রুদ্ধস্তু ভগবান্ হর:৷৷1.43.6৷৷
তিরোভাবযিতুং বুদ্ধিং চক্রে ত্রিনযনস্তদা৷ ।।
তখন মহারাজ ভগীরথ আবার তপস্যা করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলেন এবং মহাদেব গঙ্গাকে বিন্দু সরোবরের দিকে পরিত্যাগ করলেন। গঙ্গা এবার সপ্তস্রোতে প্রবাহিত হতে লাগলেন – পূর্বে হ্লাদিনি, পাবনী ও নলিনী ; পশ্চিমে সুচক্ষু, সীতা ও সিন্ধু; সপ্তম স্রোত ভগীরথের পশ্চাতে। গঙ্গার এই অবতরণ দেখতে দেবর্ষি, গন্ধর্ব, যক্ষ ও সিদ্ধগণ উপস্থিত হলেন।
তদদ্ভুততমং লোকে গঙ্গাপতনমুত্তমম্৷৷1.43.19৷৷
দিদৃক্ষবো দেবগণা: সমীযুরমিতৌজস:৷
গঙ্গার সেই প্রবাহ কোথাও দ্রুতবেগে, কোথাও ধীরে, কোথাও প্রসারিত বা কোথাও সংকুচিত হয়ে বইতে লাগল। কোথাও কোথাও জলরাশির সঙ্গে জলরাশির সংঘর্ষ হল এবং জল প্রবাহ ঊর্ধপথে গিয়ে ধরা তলে নিক্ষিপ্ত হল। গঙ্গার পবিত্র ধারায় ধরিত্রী বাসী স্নাত ও পাপ মুক্ত হল। গঙ্গার প্রবাহ পথের এক স্থানে জহ্নু মুনি যজ্ঞ করছিলেন। প্রবল জলস্রোতে যজ্ঞভূমি প্লাবিত হওয়ায় তিনি ত্রুদ্ধ হলেন এবং গঙ্গার সমস্ত জল পান করে নিলেন। দেবতারা তখন জহ্নুকে পূজন করে মুনিকে বললেন যে গঙ্গাকে তাঁর দুহিতা স্বরূপ ভাবতে। মহর্ষি জহ্নু তখন প্রীত হয়ে নিজের কর্ন রন্ধ্র দিয়ে গঙ্গাকে মুক্তি দিলেন। এই কারণে গঙ্গা নদীর আরেক নাম জাহ্নবী।
গঙ্গা ভগীরথের অনুগমন করে সাগরে পতিত হলেন এবং তারপর রসাতলে প্রবেশ করে সগর পুত্রদের ভস্ম রাশি তাঁর পবিত্র সলিলে প্লাবিত করলেন। সগর সন্তানগণ পাপ মুক্ত হলেন । তখন ব্রহ্মা ভগীরথকে আশ্বস্ত করে বললেন যতকাল সাগরে জল থাকবে ততকাল তাঁরা ( সগর সন্তানগণ) স্বর্গে বাস করবেন। আর ব্রহ্মার আশীর্বাদে গঙ্গা হলেন ভগীরথের জ্যেষ্ঠ কন্যা । তাই গঙ্গার আরেক নাম ভাগীরথী। আবার গঙ্গা যেহেতু স্বর্গ থেকে অবতরণ করে মর্ত্যলোক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাতাল প্রবেশ করেন , অর্থাৎ স্বর্গ – মর্ত্য – পাতাল, এই তিন লোক দিয়ে প্রবাহিত হন, তাই গঙ্গার আরেক নাম হয় ত্রিপথগা।
গঙ্গা অবতরণের এই বিবরণ রামায়ণের ‘বাল’ কান্ডের আটত্রিশ সর্গ থেকে চুয়াল্লিশ সর্গতে বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষণকে গঙ্গা অবতরণের কথা শুনিয়েছিলেন। এই কথা আধুনিককালে কল্পিত এবং অদ্ভুত গল্প মনে হতে পারে। কিন্তু রূপকের আড়ালে এই কথা রচিত এবং এই বর্ণনাকে বিশ্লেষণ করলে আসল সত্য পাওয়া যেতে পারে। অশ্বমেধ যজ্ঞকে একপ্রকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ধরা যেতে পারে। কেননা প্রবল খরার সময় জলের অনুসন্ধান করতে এইরূপ যজ্ঞ করা হত। সগরের ষাট হাজার সন্তান হল রাজ্যের প্রজা। কারণ ভারতীয় বিশ্বাস অনুযায়ী প্রজারা রাজার সন্তান। তাই হতেই পারে রাজা সগরের ষাট হাজার প্রজা জলের অনুসন্ধানে ধরিত্রী খনন করতে থাকেন। কপিল কথার সমার্থক শব্দ হলো বিষ্ণু, যাঁর রং কালো আর কাল অর্থে আমরা কয়লা ধরতে পারি। সুতরাং অনুমান করা যায় কয়লা খনিতে পৌঁছে রাজা সগরের ষাট হাজার প্রজার প্রাকৃতিক গ্যাসের কারণে মৃত্যু হয়। জলের অনুসন্ধান করতে করতেই তাঁরা এই খনিতে পৌঁছন।
এই দুর্ঘটনার পর রাজা অংশুমান, দিলীপ এবং শেষে ভগীরথ স্বর্গ অর্থাৎ সুউচ্চ হিমালয় থেকে গঙ্গাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন। মহাদেবের জটা হতে পারে কোন বিশাল বাঁধ যা ভগীরথ নির্মাণ করেন দীর্ঘ পরিশ্রম ও কারিগরি বিদ্যার বুদ্ধিতে। জহ্নু মনির কর্ণরন্ধ্র দিয়ে গঙ্গাকে নির্গত করা খাল কেটে গঙ্গার প্রবাহকে অন্যদিকে সরানো বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী গঙ্গা নদীকে ভারত ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত করার কৃতিত্বের দাবিদার রামের পূর্বপুরুষ ভগীরথ । তাই ভগীরথকে আমরা সুপ্রাচীনকালের একজন নির্মাণ প্রকৌশলী এবং জলবিদ্যাবিদ বলে অভিহিত করতে পারি। রাজা অংশুমান এবং দিলীপ হয়তো তাই ছিলেন। তবে তাঁরা যা করতে পারেননি, ভগীরথ তাই করে দেখান।