পবনপুত্র হনুমান



Updated: 23 April, 2024 7:23 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

‘জয় হনুমান জ্ঞান গুণ সাগর।
জয় কপীশ তিহু লোক উজাগর।।

রামদূত অতুলিত বলধামা |
অংজনি পুত্র পবনসুত নামা।।’

(হনুমান চলিশা : তুলসীদাস)

রামায়ণের এক অন্যতম চরিত্র হল হনুমান । হনুমানের পিতার নাম পবন দেব আর মাতা হলেন অঞ্জনা। তাঁর ক্ষেত্রজ পিতা ছিলেন বানররাজ কেশরী। ইনি সূর্যের বরে সুমেরু পর্বতে রাজত্ব করতেন। পবন দেব ছিলেন হনুমানের আধ্যাত্বিক পিতা। মাতা অঞ্জনা ছিলেন এক অভিশপ্ত অপ্সরা।

রামায়ণের উত্তর কাণ্ডে মহর্ষি অগস্ত্য শ্রীরামের নিকট হনুমানের জন্ম ও পরিচয় বর্ণনা করেছিলেন। এই বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে হনুমানকে জন্ম দেবার পর তাঁর মাতা অঞ্জনা অরণ্যে ফল আনতে গেলে, শিশু হনুমান ক্ষুধা অনুভব করেন। মা ফিরে আসার আগেই তিনি খাদ্যের অন্বেষণ শুরু করেন । সেই সময়ে আকাশে জবাফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ সূর্য উঠে ছিলেন। হনুমান সূর্যদেবকে ফল মনে করে তাঁকে খাবার জন্য লাফ দিয়ে আকাশে ওঠেন। এইসময় পুত্রকে সূর্যতাপ থেকে রক্ষা করবার জন্য বায়ু তুষার শীতল হয়ে বইতে শুরু করেন । এদিকে ঠিক একই সময়ে রাহু সূর্যকে গ্রাস করতে গিয়েছিলেন। রাহু হনুমানকে দেখে ভয় পেয়ে ইন্দ্রের কাছে আসেন এবং ইন্দ্রকে বলেন যে কেউ একজন সূর্যকে আক্রমণ করেছেন। ইন্দ্র তখন ঐরাবতের পিঠে চড়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং হনুমান ঐরাবত কে প্রকাণ্ড ফল মনে করে ধরতে গেলে, ইন্দ্র তাঁকে বজ্র প্রহার করেন। এতে হনুমান নীচে পড়ে যান এবং অচৈতন্য হয়ে যান। তাঁর বাম হনু ( চোয়াল) ভঙ্গ হয়। শিশুপুত্রের এই দশা দেখে পিতা পবনদেব হনুমানকে নিয়ে এক গুহায় প্রবেশ করেন এবং এর ফলে পৃথিবীতে বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং সকল জীব ব্রহ্মার দ্বারস্থ হয়। তখন ব্রহ্মা বায়ু সমীপে যান এবং তাঁর স্পর্শে হনুমানকে পুনর্জীবিত করেন। তিনি বলেন যে এই শিশু অনেক মহৎ কর্ম সাধন করবে। অতএব সমস্ত দেবতা এই শিশুকে বর প্রদান করুক। তখন ইন্দ্র বললেন যে তাঁর বজ্রে এই শিশুর মৃত্যু হবে না। সূর্য বললেন তাঁর তাপের শতভাগ তিনি এই শিশুকে দিলেন ।এছাড়া তিনি তাঁকে শাস্ত্র জ্ঞান দিতে রাজি হন। বরুণ, যম, কুবের প্রভৃতি সমস্ত দেবতা হনুমানকে নানারূপ বর দেন। ব্রহ্মা বলেন এই বায়ুপুত্র মিত্রদের অভয়প্রদ, শত্রুর কাছে ভয়প্রদ, অজেয়, অব্যাহত গতি ও কীর্তিমান হবে।

ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে যেহেতু এই শিশুর হনু বা চোয়াল ভেঙে গিয়েছিল, তাই এই শিশুর নাম হয় হনুমান। এছাড়াও মারুৎ বা বায়ুর পুত্র বলে হনুমানের আরেক নাম মারুতি। তুলসী দাসের হনুমান চল্লিশাতে তেজস্বী হনুমানকে তেজপ্রতাপ নামেও সম্বোধন করা হয়েছে। আবার শ্রীরামের মঙ্গল কামনায় সীতা মাতাকে সিঁদুর পড়তে দেখে তিনি সারা দেহে বজরং বা সিঁদুর মেখেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় বজরংবলি।

দেবতাদের বরে বলশালী হয়ে বালক হনুমান ঋষিদের আশ্রমে উপদ্রব করতে লাগলেন। তাঁর বিশেষ গুণ ছিল তিনি আকাশ মার্গে ভ্রমণ করতে পারতেন। এক ঋষি বালক হনুমানের উপদ্রবে বিরক্ত হয়ে অভিশাপ দেন যে হনুমান তাঁর সকল শক্তির কথা বিস্মৃত হবে। সঠিক সময়ে তাঁর এই বিস্মৃত শক্তির কথা কেউ একজন মনে করিয়ে দেবেন। সমুদ্র লঙ্ঘনের সময় ব্রহ্মার মানসপুত্র, ঋক্ষরাজ জাম্ববান
হনুমানকে তাঁর এই শক্তির কথা মনে করিয়ে দেন। যাই হোক, বালক হনুমান সূর্যদেবের নিকট থেকে শাস্ত্র শিক্ষা করেন এবং গুরুদক্ষিণা হিসেবে তিনি সূর্যদেবের নিকট প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি চিরকাল সূর্যের পুত্র সুগ্রীবের সহায়ক হবেন। সেই কারণে হনুমান ঋষ্যমুক পর্বতে সুগ্রীবের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। তিনি প্রবল ক্ষমতাশালী হলেও বানররাজ বালিকে বধ করতে পারেননি, কারণ সে সময় তিনি তাঁর শক্তি সম্পর্কে বিস্মৃত ছিলেন।

বাল্মীকি রামায়ণে হনুমানের জন্মের কথা প্রথম উল্লিখিত হয় বাল কাণ্ডের সপ্তদশ সর্গে। ব্রহ্মার নির্দেশে সকল দেবতা ভগবান বিষ্ণুকে রাবণ বধে সাহায্য করবার জন্য তাঁদের বানর অবতার সৃষ্টি করেন। সেইরূপ পবনদেব হনুমানকে সৃষ্টি করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইতিমধ্যেই ভগবান নারায়ন রাবণ বধের নিমিত্তে নিজেকে চার অংশে বিভক্ত করে দশরথের চার পুত্র হয়ে জন্মানোর অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন। হনুমান সম্পর্কে বাল্মীকির বর্ণনায় আমরা পাই :

মারুতস্যাত্মজশ্শ্রীমান্হনুমান্নাম বীর্যবান্ ৷
বজ্রসংহননোপেতো
বৈনতেয়সমো জবে৷৷1.17.15৷৷

(অর্থাৎ, বায়ুর দেবতা পবন হনুমান নামক এক পুত্রের জন্ম দিলেন। তিনি ছিলেন যেমন শক্তিশালী, তেমন সুন্দর । তাঁর দেহ ছিল হীরকের ন্যায় কঠিন আর গতি বিনতার পুত্র গরুড়ের ন্যায়।)

হনুমান চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বাল্মীকি রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা কান্ডের তৃতীয় সর্গতে। মাতা শবরীর দেওয়া পথ নির্দেশ অনুযায়ী শ্রীরাম এবং লক্ষণ যখন চলেছেন ঋষ্যমুক পর্বত উদ্দেশ্যে বানররাজ সুগ্রীবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য, তখন সুগ্রীব পর্বতের উপর থেকে শ্রীরাম এবং লক্ষণকে দেখে ভয় পান। তাঁর অনুমান হয়েছিল হয়তো বালী তাঁকে বধ করবার উদ্দেশ্যে এই সুন্দর, ধনুর্ধারী বীরদের প্রেরণ করেছেন। উল্লেখ্য সুগ্রীব সেসময় বালীর ভয়ে সপার্ষদ ঋষ্যমুক পর্বতে আত্মগোপন করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর মন্ত্রীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান হনুমানকে শ্রীরাম ও লক্ষণ এর কাছে পাঠান তাঁদের উদ্দেশ্য বোঝবার জন্য।

রুপ বদল করতে পটু হনুমান সন্ন্যাসীর বেশে শ্রীরাম ও লক্ষণের সঙ্গে আলাপ করেন। এই সময় হনুমানের বেদ জ্ঞান, ব্যাকরণের ব্যবহার, ভাষার বোধ, মিষ্ট ভাষণএবং তাঁর শিষ্টাচার শ্রীরামের মন কেড়ে নেয়। ভগবান এবং ভক্ত কখনো পরস্পরকে চিনতে ভুল করে না। তাই শ্রীরাম যেমন হনুমানকে প্রথম সাক্ষাতেই পছন্দ করে ফেলেন, হনুমানও বুঝে যান শ্রীরাম আসলে কে। তাই অচিরেই তিনি স্বমূর্তি ধারণ করেন এবং শ্রীরাম ও লক্ষণকে নিজের পৃষ্ঠে বসিয়ে সুগ্রীবের কাছে পৌঁছন। এরপর হনুমানের উপস্থিতিতে শ্রীরাম এবং বানররাজ সুগ্রীব নিজেদের মধ্যে ঐতিহাসিক মিত্রতা স্থাপন করেন। হনুমান অগ্নি প্রজ্বলিত করে এই মিত্রতা কে চিরস্থায়িত্ব প্রদান করেন। হনুমান প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি যেরকম অনুগত ছিলেন, ঠিক সেরকমই তাঁর রাজা সুগ্রীবের প্রতি তাঁর গভীর আনুগত্য ছিল। তাই সুগ্রীবের রাজ্য প্রাপ্তির জন্য তিনি প্রভু শ্রীরামের কাছে অনুরোধ জানান।

হনুমান একজন দক্ষ পরামর্শদাতা তথা মন্ত্রী। তাঁর পরামর্শেই সুগ্রীব শ্রীরামের সঙ্গে মিত্রতা করেন। আবার বালী বধ এর পর রাজত্ব লাভ করে সুগ্রীব যখন রাজকার্য অবহেলা করে অন্তঃপুরে স্ত্রীকে নিয়ে বিহার করছেন, তখনও আমরা হনুমানকে দেখি তাঁর রাজাকে সৎ পরামর্শ দিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রাজা হবার পরে সুগ্রীব শ্রীরামকে দেওয়া তাঁর প্রতিজ্ঞা (সীতার অন্বেষণে বানর সৈন্য প্রেরণ) ভুলে যান। শ্রীরাম তখন লক্ষণকে দূত হিসেবে কিষ্কিন্ধ্যা নগরীতে পাঠান সুগ্রীবকে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। লক্ষণ অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং উগ্রভাবে কিষ্কিন্ধ্যা নগরে প্রবেশ করেন। তাঁর ক্রোধদীপ্ত আগমণে সকলেই, এমনকি সুগ্রীব নিজেও যখন ভীত, তখন হনুমান সুগ্রীবকে লক্ষণের কাছে ক্ষমা চেয়ে লক্ষণের ক্রোধ প্রশমন করবার সদুপদেশ দেন। সুগ্রীব সেই পরামর্শ মেনে উপকৃত হন এবং লক্ষণের ক্রোধ থেকে রাজ্যকে রক্ষা করেন।

বানররাজ সুগ্রীব যখন সীতা-মাতার অন্বেষণে বিভিন্ন দিকে বানর সৈন্যদের প্রেরণ করলেন, তখন হনুমান যথারীতি একটি বানর দলের সঙ্গে সীতা অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। বানরদের এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার যুবরাজ অঙ্গদ। এই দলের মধ্যেই যুক্ত ছিলেন নল, নীল, মৈন্দ, দ্বিবিদ প্রমুখ বানরবীর এবং সর্বোপরি ঋক্ষরাজ জাম্ববান। এই দলটি সীতার অন্বেষণে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাপসী স্বয়ংপ্রভার সাহায্যে তাঁরা দক্ষিণের সমুদ্রতটে পৌঁছন। মহেন্দ্র পর্বতে অবস্থানরত জটায়ুর অগ্রজ সম্পাতির থেকে বানরেরা জানতে পারেন যে লঙ্কাপতি রাবণ সীতাকে সমুদ্রের ওপারে লঙ্কাতে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এই বিশাল সমুদ্র পার হয়ে সীতা মাতার কাছে পৌঁছানো যাবে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বানরেরা হতোদ্যম হয়ে সমুদ্রতটে বসে পড়ে। ঠিক এই মুহূর্তে বৃদ্ধ, জ্ঞানী জাম্ববান হনুমানকে তাঁর আকাশ মার্গে ভ্রমণের ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এরপর মহাবলী হনুমান দেবতাদের এবং পিতৃদেব পবনকে স্মরণ করে তাঁর শরীরকে সমুদ্রের ন্যায় স্ফীত করলেন এবং মহেন্দ্র পর্বত থেকে লম্ফ দিয়ে সমুদ্র পার হলেন। হনুমানের প্রভুর কাজের প্রতি নিষ্ঠা এতটাই ছিল, যে সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় মৈনাক পর্বত সাগরের নির্দেশে হনুমানের কাছে পৌঁছে যান এবং তাকে কিছুক্ষণ পর্বতে অবস্থান করে বিশ্রাম নিতে বলেন। হনুমান তাঁকে বলেন প্রভুর কার্যে বিলম্ব করা যাবে না, আর কাজ শেষ না হলে তিনি বিশ্রামও করবেন না – এইটাই তাঁর প্রতিজ্ঞা। হনুমানের এই অবিচল নিষ্ঠা সম্পর্কে শ্রীরামের ধারণা ছিল। তিনি জানতেন যে কোন বানর বীর যদি সীতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন, তাহলে সেটা হনুমানই পারবেন। তাই হনুমানের হাতেই তিনি অভিজ্ঞান হিসেবে সীতাকে দেবার জন্য তাঁর অঙ্গুরীয় দেন: অন্য কোন বানর সেনাপতিকে তিনি এইরূপ কোন অভিজ্ঞান দেননি। এই ঘটনা প্রমাণ করে হনুমানের প্রতি শ্রীরামের গভীর আস্থা।

রামায়ণের পঞ্চম কান্ড সুন্দর কান্ড যেটি অন্যতম পবিত্র কান্ড হিসেবে বিবেচিত হয়, সেটিতে হনুমানের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা এবং লীলার কথা বর্ণিত হয়েছে। এই কাণ্ডে আমরা হনুমানকে দেখি সমুদ্র লংঘন করতে, লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কিঙ্কিণীকে পরাজিত করে সূক্ষ্ম শরীরে রাত্রিবেলা লঙ্কা প্রবেশ করতে, সূক্ষ্ম শরীরে সমগ্র লঙ্কাপুরী, রাবণের রাজপ্রাসাদ, অস্ত্রভান্ডার, পুষ্পক বিমান রাখার স্থান, সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করতে , অশোকবনে সীতামাতার কাছে শ্রীরামের বার্তা পৌঁছতে এবং স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে লঙ্কা দহন করতে।

মার্জারের মতো সূক্ষ্ম রূপ ধারণ করে হনুমান যখন লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করেন, তখন তিনি প্রথমে রানী মন্দোদরীকে দেখে সীতা বলে ভুল করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল শ্রীরামের থেকে বিচ্ছিন্ন সীতা কখনো এই ধরনের ভোগবিলাসে লিপ্ত হতে পারেন না, যে ধরনের ভোগ-বিলাসের মধ্যে রানী মন্দোদরী ছিলেন। এর পরেই তাঁর দৃষ্টি যায় অশোকবনে। যেখানে তিনি এক তাপসীকে দেখেন ভীষণাকৃতি রাক্ষসী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে থাকতে। তিনি তাঁকে দেখেই বুঝতে পারেন যে ইনি হলেন সীতা মাতা। প্রথমে সূক্ষ্ম রূপে তিনি সীতা মাতাকে শ্রীরাম এবং সীতার জীবনের কাহিনী শোনান এবং সীতা তাঁকে
রামদূত হিসেবে বিশ্বাস করলে তিনি তাঁকে শ্রীরামের অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় দেন। হনুমান যখন সূক্ষ্ম শরীরে অশোকবনে বিদ্যমান তখন তিনি দেখেন রাক্ষসরাজ রাবণ কিভাবে সীতার উপর মানসিক পীড়ন করছেন সেই রাক্ষসকে বিবাহ করার জন্য। সীতা মাতার ধৈর্য, ত্যাগ এবং তেজ হনুমানের মনে গভীর শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। তিনি মাতাকে বলেন তাঁর পৃষ্ঠে আরোহন করতে, যাতে তিনি জানকিকে এখনই লংকা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সীতা মাতা হনুমানকে বলেন যে তিনি চান তাঁর প্রভু এসে তাঁকে এই নির্বাসন থেকে রক্ষা করুন, এবং রাবণকে বধ করুন। হনুমান তাতে সম্মত হন। হনুমানের এ এক অপূর্ব বিনয়। তিনি জানতেন যে তিনি একাই সমগ্র রাক্ষস কুলকে ধ্বংস করতে পারেন, কিন্তু তাতে প্রভুর কৃতিত্ব খাটো হবে, তাই তিনি রাবণ বধ এবং সীতা উদ্ধারের কৃতিত্ব প্রভুর জন্যেই রেখে দিলেন; নিজে কোন কৃতিত্ব গ্রহণ করলেন না। অদ্ভুত এই বিনয় আর প্রভুভক্তি হনুমানকে এক বিশেষ চরিত্রে উন্নীত করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সীতা মাতা হনুমানের সঙ্গে কথা বলার পর হনুমানকে সন্তান স্নেহে ভালোবেসে ফেলেন এবং তাঁকে এক দিব্য চূড়ামণি দেন অভিজ্ঞান হিসেবে
শ্রীরামকে দেবার জন্য।

সীতা-মাতার সঙ্গে সাক্ষাতের পর রাবনকে প্রভু শ্রীরামের শক্তির ইঙ্গিত দেবার জন্য হনুমান অশোকবনে তাণ্ডব চালান। বহু রাক্ষস সৈন্য এবং রাবণের পুত্র অক্ষকুমার হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। এরপর যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ হনুমানকে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে বন্দী করেন। হনুমান এখানে পিতামহ ব্রহ্মাকে সম্মানপূর্বক বন্দিত্ব স্বীকার করেন, তাছাড়া মেঘনাদের ক্ষমতা ছিল না পবনপুত্রকে বন্দী করার। তাঁর বন্দী হবার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হল রাবণের সঙ্গে সাক্ষাৎ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রাতে সূক্ষ্ম রূপে লঙ্কাপুরী পরিদর্শনের সময় হনুমান রাবণকে দেখেন। বিচক্ষণ হনুমান রাবণকে দেখেই বুঝে যান যে রাক্ষসরাজ সত্যই অনেক গুণের অধিকারী, হনুমান বলেন:

“অহো রূপমহো, ধৈর্যমহো সত্ত্বমহো দ্যূতি।
অহো রাক্ষসরাজস্য
সর্বলক্ষণ যুক্ততা”।। 5.49. 17।।

(কি আশ্চর্য মহৎরূপ, মহৎ ধৈর্য, মহৎ পরাক্রম, সর্বলক্ষণ যুক্ত, কি আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের প্রভা। )

কিন্তু রাবণকে দেখে তিনি এটাও বুঝে যান যে তাঁর অধর্ম – তাঁর দম্ভ এবং কাম তাঁকে সুরলোকের পতি হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে। হনুমানের এই বোধ তাঁকে জ্ঞানী রূপে প্রতিষ্ঠা করে। যাই হোক, সভা মাঝে তিনি রাবণকে শ্রীরামের বার্তা দেন এবং সীতা মাতাকে অবরুদ্ধ করে রাখা যে তাঁর উচিত হয়নি , সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। শ্রীরাম, লক্ষণ এবং বানরদের শক্তি-সামর্থের কথা বলে তিনি রাবণের মনে ভীতির সঞ্চার করারও চেষ্টা করেন।

রাবন হনুমানের মতন এক বানরকে তাচ্ছিল্য করেন এবং প্রাণে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন। অবশেষে ধার্মিক বিভীষণের হস্তক্ষেপে হনুমানের প্রাণদন্ড রদ হয় কিন্তু হনুমানের লেজে তৈলযুক্ত কাপড় জড়িয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হনুমান এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে দিনের আলোকে লঙ্কাপুরী পরিদর্শন করেন এবং সমগ্র পুরীতে অগ্নিসংযোগ করে দেন। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা বশত বিভীষণের প্রাসাদে তিনি অগ্নিসংযোগ করেন নি। হনুমানের লঙ্কা দহন তাঁর অপার, অসীম শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করে এবং রাবণকে দুত হিসাবে তিনি সঠিক বার্তা পৌঁছে দেন। রামদূতের যথাযোগ্য কার্য সমাপন করে সীতা মাতার আশীর্বাদ নিয়ে হনুমান আবার সাগর পেরিয়ে শ্রীরামের কাছে ফিরে আসেন এবং সীতার অভিজ্ঞান প্রদর্শন করে প্রভুকে আশ্বস্ত করেন। হনুমানের লঙ্কা দহন নিঃসন্দেহে তাঁর বীরত্ব, প্রভুভক্তি এবং রাজনীতি জ্ঞানের পরিচায়ক।

সমুদ্রপৃষ্ঠে সেতুবন্ধনের পর শ্রীরামকে পিঠে বসিয়ে তিনি লঙ্কা নিয়ে আসেন। এরপর লঙ্কার যুদ্ধে তিনি অন্যতম মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বাল্মীকি রামায়ণে আমরা দেখি মেঘনাদের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে যখন অধিকাংশ বানর সৈন্য সহ শ্রীরাম এবং লক্ষণ মূর্ছিত হয়েছেন, তখন হনুমান ত্রাতা হয়ে দেখা দেন। অভিজ্ঞ জাম্ববানের পরামর্শে হিমালয় থেকে তিনি মৃতসঞ্জীবনী ঔষধ নিয়ে আসেন। এই সময় আমরা দেখি জাম্ববান অন্যান্য বানর সেনাপতিদের কুশল জিজ্ঞাসা না করে শুধু হনুমান জীবিত আছেন কিনা তা জানতে চান। কারণ তিনি জানতেন হনুমান যদি বেঁচে থাকে তাহলে রাম- লক্ষণ সহ সকল সৈন্যবাহিনী আবার চৈতন্য লাভ করতে পারবে। হনুমানের ওপর ব্রহ্মার মানসপুত্র জাম্ববানের এই ভরসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধ চলাকালীন হনুমান আরেকবার হিমালয় গমন করেন মৃতসঞ্জীবনী ঔষধ আনার জন্য। এই সময় মেঘনাদ বধের প্রতিশোধ নেবার জন্য রাবণ লক্ষণকে শক্তিশেল বিদ্ধ করেন। এক রাত্রের মধ্যে যদি ঔষধ না আসে, তাহলে লক্ষণের প্রাণ দীপ নিভে যাবে। বৈদ্যরাজ সুষেনের এই ভবিষ্যৎবাণী শ্রীরামকেও বিচলিত করে তুলেছিল। লঙ্কার সমুদ্রতটে অচৈতন্য ভাইয়ের মাথা কোলে নিয়ে বসে সকলের ত্রাতা রঘুবীর তখন প্রায় ক্রন্দনরত! এই ঘোর বিপদের সময় এগিয়ে এলেন মারুতি। তিনি করজোড়ে প্রভুকে অনুরোধ করলেন ভক্তের শক্তির উপর আস্থা রাখতে। তার পরেই ঘটল সেই অলৌকিক কর্মকাণ্ড। এক রাত্রের মধ্যে গন্ধমাদন পর্বত তুলে নিয়ে এলেন রামভক্ত হনুমান, কৃতিত্ব দিলেন শ্রীরাম প্রভুর আশীর্বাদকে। সেই দিন শ্রীরাম তাঁকে নাম দিলেন সংকটমোচন। আজও ভক্তরা বিপদে নাম নেন হনুমানের। তুলসী দাস বলেছেন :

“সংকট সে হনুমান ছুড়াবৈ |
মন ক্রম বচন ধ্যান জো লাবৈ ‖” ( হনুমান চলিশা)

এছাড়াও লঙ্কার যুদ্ধে হনুমানের আক্রমণে ধুম্রাক্ষ, অকম্পন, জম্বুমালি প্রভৃতি রাক্ষস সেনাপতিদের এবং রাবণের দুই পুত্র ত্রিশিরা এবং দেবান্তকের মৃত্যু হয়। অতিকায় এর সঙ্গে যুদ্ধের সময় হনুমান লক্ষণকে তাঁর পৃষ্ঠে বহন করেন । নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে যুদ্ধের সময়ও শ্রীরাম হনুমানকে ভাই লক্ষণের রক্ষাকর্তা হিসেবে পাঠান। রাক্ষস সৈন্যদলের কাছে হনুমান ছিলেন সাক্ষাৎ যম। কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে অহি রাবণ শ্রীরাম ও লক্ষণকে মায়াবলে পাতাল লোকে বন্দী করলে , হনুমান অহিরাবণ মহিরাবণ বধ করে শ্রীরাম ও লক্ষণকে পাতাল লোক থেকে উদ্ধার করেন। অর্থাৎ সব দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, হনুমান ভিন্ন শ্রী রামের লঙ্কা জয় সম্ভব ছিল না।

রাবণ বধের পর শ্রীরাম তাঁর দূত হিসেবে হনুমানকে সীতা-মাতার কাছে পাঠান।সীতা মাতার উপর যে সমস্ত রাক্ষসী দীর্ঘকাল ধরে অত্যাচার করেছিল, হনুমান চেয়েছিলেন’ তাদেরও বধ করতে, কিন্তু মাতার কথাতে তিনি তাদের ক্ষমা করেন। লংকা থেকে থেকে ফেরার পথে শ্রীরাম তাঁর দূত রূপে শৃঙ্গবেরপুরে নিষাদ রাজ গুহের কাছে এবং নন্দীগ্রামে ভরতের কাছে হনুমানকে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল শ্রীরামের প্রত্যাবর্তনের বার্তা দেওয়া। হনুমান সেই কাজও সফলভাবে সমাপন করেন। এই সময় আমরা দেখি
ভরতক হনুমানকে পঞ্চম ভাতা হিসেবে স্বীকার করছেন। শ্রীরামের প্রতি হনুমানের যে কর্তব্য, সেটাই ছিল এই স্বীকৃতির কারণ। আর শ্রীরাম তো আগেই হনুমানকে ভরত সম প্রিয় ভাই বলে সম্বোধন করেছিলেন।

শ্রীরামের রাজ্যভিষেকের সময়ও উপস্থিত ছিলেন হনুমান। সিংহাসনে আরোহন করাবার পর শ্রীরাম সীতাকে একটি অতি মূল্যবান মুক্তাহার উপহার দেন। সীতা হনুমানের প্রতি এতটাই প্রীত ছিলেন যে শ্রীরামের আদেশ নিয়ে সেই মুক্তাহার তিনি হনুমানকে প্রদান করেন। বাল্মীকি রামায়ণের উত্তর কান্ডতে আমরা দেখি হনুমানকে শ্রীরামের থেকে বিদায় গ্রহণ করতে। বিদায় গ্রহণের সময় হনুমানকে আমরা দেখি
শ্রীরামের কাছে প্রণাম পূর্বক নিবেদন করতে , যে শ্রী রামের প্রতি তাঁর ভক্তি যেন অবিচল থাকে। যতদিন পৃথিবীতে
রামকথা থাকবে, ততদিন যেন তিনি বেঁচে থাকেন। শ্রী রাম স্নেহ পূর্বক হনুমানকে আলিঙ্গন করে বলেন যতদিন ধরাতলে শ্রীরাম কথা প্রচলিত থাকবে, ততদিন হনুমানের কীর্তি বিদ্যমান থাকবে এবং হনুমান শরীর ধারণ করে বাস করবেন।

হনুমান এক পরম শ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ। তিনি চিরঞ্জীবী। অনেক মহাত্মা আজও সূক্ষ্ম শরীরে হনুমানকে দেখতে পান। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে হনুমানের পূজা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ মহাবীর হনুমানের প্রশংসা করেছিলেন এবং ঘরে ঘরে তাঁর পূজা করতে বলেছিলেন। হনুমানের পূজা মানে হনুমানের গুণগুলির পূজা। একাধারে তিনি যেমন বলবান, তেজস্বী অন্যদিকে তিনি ঠিক সেরকমই বিদ্বান এবং জ্ঞানী। একদিকে তিনি যেমন ভীমরূপে অসুর দমন করেন, অন্যদিকে তিনি ঠিক তেমনই সহজ, সরল । আর তাঁর আনুগত্য তো প্রশ্নাতীত। তিনি ছিলেন একজন উচ্চকোটির যোগী, যিনি তাঁর দেহ, মন দিয়ে প্রভু শ্রীরামের সেবা করেছেন। আজকের দিনে অনেক তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী হনুমানকে একটি মজার চরিত্র হিসেবে দেখেন। হনুমান শব্দটিকে তাঁরা মূর্খ বা বোকা শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখব তাঁর মত জ্ঞানী এবং বলশালী অথচ সরল সাদাসিধে মহাপুরুষ পৃথিবীতে বিরল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে হনুমান ছিলেন বানর জাতির সদস্য। না, তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা কোন উচ্চবর্ণের মানুষ ছিলেন না: তিনি ছিলেন সাধারণ এক বনবাসী। কিন্তু অচল ভক্তি তাঁকে শ্রীরামের প্রধান ভক্ততে উন্নীত করেছে। শ্রীরাম এবং হনুমানের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সুপ্রাচীন ভারতে বর্ণের পার্থক্য প্রভু আর ভক্তের মধ্যে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এর অর্থ এটাই যে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বিরুদ্ধে যে বর্ণভেদ করার অভিযোগ করা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা, তাছাড়া হনুমানের মতন একজন অব্রাহ্মণ, বনবাসী বৈদিক জ্ঞান সম্পন্ন যোগী এবং শ্রেষ্ঠ ভক্ত হতে পারতেন না। আজকের দিনে শিশুদের চরিত্র গঠনের জন্য হনুমান চরিত্র অবশ্যই বিদ্যালয় পাঠ্য হওয়া উচিত।

সকলকে জানাই হনুমান জয়ন্তীর শুভেচ্ছা।