© শ্রী সূর্যশেখর হালদার
শিবলিঙ্গকে দুগ্ধের দ্বারা স্নান করানোর রীতি আমাদের দেশে আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। বর্তমানে একদল মানুষ এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে যেখানে সারা দেশে বহু শিশুর ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটে না, সেখানে দুধের দ্বারা শিবলিঙ্গকে স্নান করিয়ে কি লাভ? তাই এই নিবন্ধে শিবলিঙ্গকে দুধের দ্বারা স্নান করানোর বিজ্ঞানসম্মত কারণ আলোচিত হল।
শিবলিঙ্গের অবস্থান হয় মন্দিরের সবচাইতে পবিত্র স্থানে – মন্দিরের গর্ভগৃহে। এখানে মনে রাখতে হবে সুপ্রাচীনকাল থেকে সনাতন ধর্মের যেসব মন্দির নির্মিত হয়েছে , সেগুলি এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যাতে ভক্তের দল সেখান থেকে পজিটিভ এনার্জি ( সদর্থক শক্তি) গ্রহণ করতে পারেন। সনাতনীরা মন্দিরে তীর্থযাত্রা করেন শুধুমাত্র মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবতার বিগ্রহকে শ্রদ্ধা জানাতে নয়: বরং মন্দির পরিভ্রমণ করে সদর্থক শক্তি সংগ্রহ করতে। প্রতিটি মন্দিরের গর্ভগৃহ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে সেই স্থানে সদর্থক শক্তি থাকে সর্বাপেক্ষা বেশি।
এইবার যখন শিব লিঙ্গের উপর দুগ্ধ ঢেলে শিবলিঙ্গের অভিষেক করা হয়, তখন এই সদর্থক শক্তি শিব লিঙ্গের দিকে জমা হতে শুরু করে। সুতরাং যেসব ভক্ত সেই সময় শিবলিঙ্গের নিকটবর্তী স্থানে থাকেন, যিনি দুগ্ধ ঢেলে শিবলিঙ্গের অভিষেক করান, তাঁদের প্রত্যেকের শরীর ও মনে এই সদর্থক শক্তি প্রবাহ প্রবেশ করে। দুধ হলো খুব ভালো পরিবাহী যেটা এই সদর্থক শক্তিকে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে। দেশি গরুর দুগ্ধ যখন ওম् নমঃ শিবায় – এই মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শিব লিঙ্গের উপর ঢালা হয় তখন ভক্তের মন , দেহ এবং অন্তরের সত্ত্বা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যে দুগ্ধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করানো হয়, সেই দুগ্ধ একটি পাত্রে সংগ্রহ করে ভক্ত ও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে চরণামৃত রূপে বিতরণ করা হয়। এইরূপ ব্যবস্থা প্রতিটা মন্দিরে থাকলে দুগ্ধ নষ্ট হয় না।
এতদসত্ত্বেও বলা যেতে পারে বৃক্ষ, খাদ্য, বাতাস সব ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষ এগুলির কোনটাই সৃষ্টি করেনি, কিন্তু ভোগ করে সব। আমরা যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করি তখন পৃথিবীকে দেবার জন্যে সঙ্গে করে কিছুই আনি না। গাভীর দুগ্ধও আমরা উৎপাদন করি না। গাভীর দুগ্ধ কি ঠিক মানুষের ভোগের জন্যই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন ? এই প্রশ্নের জবাবও অনেক যুক্তিবাদী দার্শনিক দিতে পারবেন না । যদি মানুষ গাভীর দুগ্ধ সৃষ্টি না করে থাকে; যদি গাভীর দুগ্ধ মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি কিনা – এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পাওয়া যায়, তাহলে গাভীর দুগ্ধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করানো উচিত কিনা এই প্রশ্নের কোন যৌক্তিকতা থাকে না।
আরো একটি আশ্চর্যজনক বিষয় এই যে এই ধরনের প্রশ্ন ওঠে শুধু সনাতন ধর্মের প্রথা মানার সময়। অন্য আব্রাহামিক রিলিজিয়ন এর ক্ষেত্রে কোরবানির রীতি আছে। কোরবানির ক্ষেত্রে গরু, ছাগল, মহিষ , উট ইত্যাদি গৃহপালিত জীবকে হত্যা করা হয় শুধুমাত্র তাদের মাংস খাওয়ার জন্য। এখন পাঠক ভাবুন, শিবলিঙ্গকে গোদুগ্ধ দিয়ে স্নান করানো নাকি হাজার হাজার পশু হত্যা করে তথাকথিত দেবতাকে সন্তুষ্ট করা – কোনটি পরিবেশের পক্ষে বেশি ক্ষতিকারক? কোন কাজটি বেশি নির্দয়তা বা নিষ্ঠুরতার বহিঃপ্রকাশ?
আসলে আমাদের দেশে সনাতন ধর্মের প্রথা কে আক্রমণ করা খুব সহজ। এটা করতে পারলে মিডিয়া এবং শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহল সেটিকে উদারতা বলে মনে করে। কিন্তু অন্য মজহব এর প্রথা মানতে গিয়ে যখন হাজার হাজার পশু হত্যা করা হচ্ছে, তখন এই শক্তি বা উৎসাহ সহকারে কাউকে আক্রমণ করতে দেখা যায় না। আমাদের সনাতনীদের উচিত নিজেদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধকে আগ্রাসীভাবে সমর্থন করা, তাহলেই এইসব ভন্ড সেক্যুলার তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী চুপচাপ হয়ে যাবে। আর এই উদ্দেশ্য সাধন করতে আমাদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।