নেতাজি ও ডাক্তারজী



Updated: 23 January, 2023 6:01 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং ডঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারজী ভারতের ইতিহাসে দুই খ্যাতনামা চরিত্র। দুজনেই তাঁদের দেশপ্রেম, সাংগঠনিক দক্ষতা আর চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য আজও ভারত তথা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে শ্রদ্ধাস্পদ হয়ে রয়েছেন। মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করবার জন্য নেতাজি যেমন আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন, ঠিক তেমনই ডাক্তারজী তৈরি করেছিলেন এক বিশাল স্বয়ংসেবক বাহিনী (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা RSS) যা দেশবাসীর চরিত্র গঠনের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমিকে পরম বৈভবশালী করার স্বপ্ন দেখে। এই দুই মহাপুরুষের বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এই নিবন্ধটি সেই সাক্ষাৎকার গুলির উপরেই আলোকপাত করবে।

নেতাজী ও ডাক্তারজীর প্রথম সাক্ষাত ঘটে 1928 সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে। ডাক্তারজী সে সময়ে কংগ্রেসের মধ্য প্রান্তের কার্যকারিনী সভার সদস্য ছিলেন। এই অধিবেশনে দুই মহাপুরুষের মধ্যে কথাও হয়। নেতাজি অধিবেশনে উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকদের বিশৃঙ্খল আচরণ দেখে দুঃখিত হন। ডাক্তারজী তাঁকে জানান যে তিনি নাগপুরে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নেতাজি এই ব্যাপারে উৎসাহিত হন এবং বলেন যে একমাত্র এইরূপ কাজই জাতির পুনর্জাগরণে পথ দেখাতে পারে। উল্লেখ্য এই অধিবেশনেই ডাক্তারজীর সঙ্গে বীর সাভারকার এবং ভগৎ সিং এর অন্যতম সহকারি রাজগুরুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এই অধিবেশন সম্পর্কে ডাক্তারজী পরে এক জায়গায় লিখেছিলেন যে কলকাতায় তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবীর জন্য 65 হাজার টাকা খরচ হয়েছিল।

1938 সালে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নাগপুর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ডাক্তারজীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁকে ডক্টর হেডগেওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেন। 1939 সালে নেতাজি ডাক্তারজীর কাছে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়ে মতামত জানতে চান। সেই সময় ডাক্তারজী খুব অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি পুরো বিষয়টা আগ্রহভরে শোনেন এবং নেতাজি কে বলে পাঠান যে ব্রিটিশ কে ধাক্কা দিতে পারার মত পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে তবেই যেন তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে যান।

নেতাজি শেষবারের মতো ডাক্তারজীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন 1940 সালের 18 জুন। তখন তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করেছেন। তাঁর সঙ্গে সেদিন ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা রামভাউ রুইকার। কিন্তু ডাক্তারজী তখন ভীষণ অসুস্থ। সেদিনই তাঁকে নাগপুরের মেও হাসপাতাল থেকে সিভিল লাইনসে বাবাসাহেব ঘটাটের বাংলোতে আনা হয়েছিল। সেই স্থানেই ডাক্তারজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন নেতাজি। কিন্তু আগের রাত্রে ( 19 জুন ) ডাক্তারজীর একফোঁটা ঘুম হয়নি। তাই সেই দিন সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। নেতাজি যখন তাঁর কাছে আসেন, তখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। দরজায় উপস্থিত স্বয়ংসেবক ডেকে দিতে চেয়েছিলেন
ডাক্তারজীকে। যদিও নেতাজি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই এসেছিলেন বলে জানান, তবুও অসুস্থ ডাক্তারজীকে আর জাগাতে চাননি তিনি। পরে আসবেন বলে ডাক্তারজীর উদ্দেশ্যে নমস্কার করে তিনি চলে যান। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারজীর ঘুম ভেঙে গেল, এবং তাঁকে জানানো হলো যে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। দেখা না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করলেন ডাক্তারজী এবং অস্ফুট ভাবে ‘সুভাষ বাবু’ বলে তিনিও তাঁর উদ্দেশ্য নমস্কার করলেন। পরদিন ডাক্তারজী ইহলোক ত্যাগ করে অমৃতলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আর সুভাষ বাবুও কয়েক মাস বাদেই ঘর ছেড়ে পাড়ি দেন ইউরোপে অনেক বড় লক্ষ্য নিয়ে।

যদি সেদিন এই দুই মহাপুরুষের সাক্ষাৎ হত, তাহলে সেটা যে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটত সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিধি বাম। তবে এই ঘটনা প্রমাণ করে দুই মহান নেতার পরস্পরের প্রতি আগ্রহ এবং শ্রদ্ধাবোধ। দুঃখের বিষয় ভারতের মূল ধারার ইতিহাস এই দুই নেতাকেই প্রান্তিক করে রেখে দিয়েছে।