মোগা গনহত্যা: গৈরিক পতাকা বাঁচাতে খালিস্তানি জঙ্গিদের হাতে স্বয়ংসেবকদের বলিদান



Updated: 17 July, 2023 3:16 am IST

© শ্রী সূর্য শেখর হালদার

খালিস্তানি জঙ্গী হোক বা ইসলামিক মৌলবাদী: নকশাল কিম্বা শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি কোন গোয়েন্দা সংস্থা – সবাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবে। কারণ হল যখনই দেশের মধ্যে কোন দেশ বিরোধী শক্তি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই সংঘের স্বয়ংসেবকরা মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসে। নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে, এমনকি বলিদান দিয়েও তারা দেশ বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করে যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখে থেকে।

বস্তুত, প্রায় দেড় দশক ধরে যখন পাঞ্জাব খালিস্তানি জঙ্গিদের নাশকতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর সংঘর্ষের আগুনে দগ্ধ হচ্ছিল, তখন সংঘের নিঃস্বার্থ স্বয়ংসেবকরা নিজেদের বিপদ অগ্রাহ্য করে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষের রক্ষার্থে এগিয়ে এসেছিল। সেই সময় প্রতিটা স্বয়ংসেবক সাধারন হিন্দু ও শিখ জনগণের অস্তিত্ব রক্ষা করবার জন্য বীরত্বের সঙ্গে জঙ্গিদের প্রত্যাঘাত করে। তার ফলে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট খালিস্তানি জঙ্গিরা খুব দ্রুত সংঘের স্বয়ংসেবক দের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং আক্রমণ করে। 1989 সালের মোগা হত্যাকান্ড এই রকমই এক জঙ্গি আক্রমণ এবং স্বয়ংসেবকদের বলিদানের নিদর্শন যার প্রতিক্রিয়া সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

দিনটা ছিল 25 জুন 1989 – আজ থেকে 32 বছর আগে। স্মৃতির সরণি বেয়ে এগিয়ে গেলে আমরা দেখব ঐদিন ঘটেছিল এক রক্তাক্ত জঙ্গিহানা যার নেপথ্যে ছিল খালিস্তানি জঙ্গির দল। ঐদিন খালিস্তানি জঙ্গীরা জনসমক্ষে গুলি চালিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের স্বয়ংসেবকদের গুলি করে হত্যা করে। স্বয়ংসেবকরা তখন পাঞ্জাবের মোগা জেলার জওহরলাল নেহেরু পার্কে নিত্য শাখার কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিলেন। এই গুলি চালনায় 25 জন স্বয়ংসেবক নিহত এবং 35 জন আহত হন। এর কিছুক্ষণ পরেই ওই পার্কে একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ হয় যাতে এক দম্পতি এবং দুইজন পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়। অনুমান করা যায় যে খালিস্তানি জঙ্গিরাই ওই বোমা ওই স্থানে পুঁতে রেখেছিল।

এলোপাথাড়িভাবে অবিরাম গুলি চালানোর পর খালিস্তানি জঙ্গিরা যখন পলায়নের চেষ্টা করে তখন এক সাহসী দম্পতি ( ওম প্রকাশ ও চিন্দর কৌর ) তাদের বাধাদান করেন। ওই দম্পতি ছিলেন নিরস্ত্র কিন্তু বীরত্বের সঙ্গে তারা জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করেন এবং শেষে জঙ্গিদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ডিম্পল নামে একটি দেড় বছরের বাচ্চা সেই সময় নেহেরু পার্কের কাছে খেলছিল। জঙ্গিরা এতটাই অমানবিক ছিল যে তাকেও গুলি করে হত্যা করে।

সেই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন যে সেদিন নেহেরু পার্কে সংঘের নিত্য শাখার কার্যক্রম চলাকালীন জঙ্গিরা পার্কে প্রবেশ করে। শাখার সূচনাতে সংঘের পরম পবিত্র গৈরিক ধ্বজ উত্তোলিত করা হয়েছিল। জঙ্গিরা সেই পবিত্র গৈরিক ধ্বজকে নামাতে নির্দেশ দেয়। সংঘের স্বয়ংসেবকরা ধ্বজ নামাতে অস্বীকার করলে ক্ষুব্ধ জঙ্গীরা স্বয়ংসেবকদের লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় এবং 25 জনকে হত্যা করে।

নীতিন জৈন নামে এক ব্যক্তি স্মরণ করেন কিভাবে স্বয়ংসেবকরা তাঁদের নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে জঙ্গিদের পিছনে ছুটতে থাকেন। প্রত্যক্ষদর্শী নীতিন জৈনের সেই সময় বয়স ছিল দশ। জৈন স্মৃতিচারণা করে বলেন তিনি সেই সময় এটিকে একটি মজার খেলা বলে মনে করে খালিস্তানি জঙ্গিদের পিছনে ছুটতে থাকেন। সৌভাগ্যবশত কেউ একজন নীতিনকে ধরে নেন এবং বাড়ি পাঠিয়ে তাকে বিপদমুক্ত করেন।

যেসব স্বয়ংসেবকরা সেই দিন বলিদান দিয়েছিলেন অথবা আহত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন – শ্রী লেখরাজ ধাওয়ান , বাবুরাম, ভগবান দাস, শিব দয়াল মদন গোয়াল, মদন মোহন, ভগবান সিং, গজানন্দ , আমন কুমার, ওম প্রকাশ সতীশ কুমার, কেসোরাম, প্রভোজ্যত সিং, নীরজ , মনীশ চৌহান, জগদীশ ভগত, বেদপ্রকাশ পুরি, ওম প্রকাশ এবং চিন্দর কৌর ( স্বামী-স্ত্রী), ডিম্পল ,পন্ডিত দুর্গা দত্ত, প্রহ্লাদ রাই, জগতার রাই সিং, কুলবন্ত সিং, প্রেম ভূষণ, রামলাল আহুজা, রাম প্রকাশ কানসাল, বলবীর কোহলি, রাজকুমার, সঞ্জীব সিংলে, দীননাথ হংসরাজ , গুরুবক্স রাই গোয়েল, ডক্টর বিজয় সিংলে, অমৃত লাল বনসাল, কৃষ্ণদেব আগরওয়াল, অজয় গুপ্তা, বিনোদ ধামিজা, ভজন সিং, বিদ্যাভূষণ নাগেশ্বর রাও, পবন গর্গ, গগন বেরি ,
রাম প্রকাশ, সৎপাল সিং কালদা, কর্মচাঁদ । এই ভয়ানক প্রাণঘাতী আক্রমণের পরেও স্বয়ং সেবক পরিবারগুলি কিন্তু মানসিক স্থিতি হারিয়ে অশান্ত হয়ে ওঠেননি। সে সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সর
কার্যবহ এইচ. ভি শেষাদ্রি যেকোন মূল্যেই শান্তি বজায় রাখতে নির্দেশ দেন।

ভয়ঙ্কর এই ঘটনা সারা দেশকে চমকে দেয়। দেশের জনগণের কাছে এটি একটি চরম মানসিক আঘাত ছিল। তবে সংঘের স্বয়ংসেবকদের মনোবল এবং সংকল্প এই ঘটনার পরেও অটুট ছিল। এই হত্যালীলার পরদিনই সংঘের স্বয়ংসেবকরা ওই হত্যাকাণ্ডের স্থানেই শাখার আয়োজন করেন। সেই দিন প্রায় 100 জন স্বয়ংসেবক শাখাতে উপস্থিত হন। তাঁরা সেদিন হিন্দু -শিখ মৈত্রীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমবেত সংগীত গাইতে থাকেন। পাঞ্জাবি ভাষায় এই গানের অর্থ ছিল এই রূপ – ‘কে বলে হিন্দু আর শিখ পৃথক? তারা হলো ভারত মায়ের দুটি আঁখি’।

এর থেকে জঙ্গিদের পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয় যে তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন হিন্দু- শিখ ঐক্য বিনষ্ট হবে না । শিখ ধর্মের নামে পাঞ্জাবে হিন্দু – শিখ ঐক্য ধ্বংসকারী কোনরূপ সন্ত্রাস চালানো যাবে না।

এই ঘটনা ছিল ভাগ্যের এক চরম পরিহাস। 1947 সালে দু-দুবার মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলিম জনতা শিখ সম্প্রদায়ের পবিত্র মন্দির দরবার সহিব অবরোধ করে। তখন সংঘের স্বয়ংসেবকরা অমৃতসরের দরবার সহিব রক্ষা করেন। 1984 সালের শিখবিরোধী দাঙ্গার সময়ও সংঘ শিখদের রক্ষাতে এগিয়ে এসেছিল। এরপরও 1989 সালের 25 শে জুন সংঘের স্বয়ংসেবকরা পাঞ্জাবের হামলা রুখতে প্রাণ দেন।

পরে এই ঘটনা স্মরণ করে নেহেরু পার্ক এর নাম হয় শহীদি পার্ক। 1989 সালের 26 জুন যখন সেই নেহেরু পার্কে শাখা অনুষ্ঠিত হয়, তখনই সংঘের স্বয়ংসেবকরা সংকল্প করেন যে আত্মবলিদানকারীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সৌধ বানানো হবে। এই সৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ওই বছরের 9 জুলাই। বিখ্যাত সংঘ প্রচারক ভাউরাও দেওরস ( মুরলীধর দত্তাত্রেয় দেওরস ) এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সৌধের উদ্বোধন হয় 24 জুন 1990 । রাজ্জু ভাইয়া এই সৌধ উদ্বোধন করেন। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের সাহায্য এবং স্মৃতিসৌধ দেখাশোনার জন্য একটি স্মৃতি কমিটি তৈরি হয়। প্রত্যেক বছর এই কমিটি 25 জুনের পরবর্তী রবিবার ক্ষতিগ্রস্থদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এই স্বয়ংসেবক হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিখ্যাত ভারতীয় লেখক শ্রী খুশবন্ত সিং বলেন যে 1984 সালের শিখ বিরোধী দাঙ্গার সময় শিখদের রক্ষা করেছিল সংঘ। এতদসত্ত্বেও খালিস্তানি জঙ্গিরা নৃশংসভাবে স্বয়ংসেবক দের হত্যা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সংঘ এবং শিখদের মধ্যে এক ঐতিহাসিক সংযোগ আছে। 1947 সালের দেশভাগের সময় সংঘ বহু শিখের প্রাণ রক্ষা করে মুসলিম লীগের আক্রমণ থেকে পাঞ্জাবের মানুষকে বাঁচায় এবং তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়। মোগা জেলার এই অমানবিক হত্যালীলার পরেও হত্যা কান্ডের স্থানেই শাখা আয়োজন করে হিন্দু – শিখ ঐক্যের সুন্দর বার্তা দেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। এই ঐক্যের বার্তা খালিস্তানি দের কাছে এক চরম আঘাত বলে পরিগণিত হয়। বর্তমানে প্রত্যেক বছর 25 জুন বহু সাধারণ মানুষ শহীদি পার্কে গিয়ে মৃত স্বয়ংসেবকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন।