মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮২৪ সালে ভারতের গুজরাটের টঙ্কারায় জন্মগ্রহণ করেন । একদিকে যখন অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কারে নিবদ্ধ ছিলো ভারত, অন্যদিকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ ছিলো এ রাষ্ট্র ও সামগ্রিক মানুষের চিন্তা ৷ কিশোর অবস্থাতেই সত্যের স্বরূপ অন্বেষণে গৃহত্যাগ করে সমগ্র ভারতে ঘুরেছেন মহর্ষি ৷ নিজ চোখে দেখেছেন,ধর্মের নামে দলিত,শুদ্রের উপর বর্ণবাদ,জাতিবাদের দোহাই দিয়ে নির্যাতন। নিজ চোখে দেখেছেন তিক্ত ভারতবর্ষের দলিতদের দলে দলে ধর্মান্তরিত এবং জাতিগত বিভাজন। বাল্যবিবাহ,সতীদাহ,যৌতুকপ্রথা,অস্পৃশ্যতা,নরবলি,গুরুদাসী,সেবাদাসী ইত্যাদির মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডকে বৈদিক সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেওয়া বামমার্গী, পাখন্ডীদের হাত থেকে “বৈদিক সাম্যবাদ” কে পুনঃজাগরিত করে নবজীবন প্রদান করেছেন তিনি। দিয়েছেন ভারতবাসীকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার প্রথম নির্দেশ,”স্বরাজ আন্দোলন” এর ডাক। তার কর্মকাণ্ডকে বিশেষায়িত করেছে বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ। যেমন:
“আধুনিক ভারতের মহান পথপ্রদর্শক স্বামী দয়ানন্দের প্রতি আমার প্রজন্ম হতে শ্রদ্ধা জানাই, যিনি ধর্ম ও প্রথার বিভ্রান্তিকর জটিলতার মধ্য থেকে আমাদের দেশের অধঃপতিত দিনগুলোকে আলোকিত করেছিলেন যা একটি সরল পথের দিকে নিয়ে যাওয়ায় তার উদ্দেশ্যে ছিল।”-(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,শান্তিনিকেতন)
“তিনি ভারতের আধুনিক ঋষি, সংস্কারক ও মহাপুরুষদের মধ্যে অন্যতম। তাহার ব্রহ্মচর্য, উদার স্বতন্ত্র, বিশ্বপ্রেম, কর্ম কুশলতা ইত্যাদি গুণ লোককে মুগ্ধ করিত।”-(মহাত্মা গান্ধী, ‘দয়ানন্দ স্মৃতি’-১৯২৬)
“দয়ানন্দজী অস্পৃশ্য জাতির নিকট প্রীতি ও প্রেমের হস্ত বাড়াইয়াছে এবং তাহাদিগকে সমাজের অন্তর্ভুক্ত করিয়া আলিঙ্গন করিতেছে। আর্য সমাজের নেতাদের কর্মে অনুরাগ আছে এবং এ জন্য তাহারা যথেষ্ট আত্মত্যাগও করিয়াছেন। আর্যসমাজ তাহার কর্ম তালিকার মধ্যে স্ত্রী-শিক্ষাকে এক মহত্বপূর্ণ স্থান দান করিয়াছে। আর্য সমাজ আমাদের মাতৃভূমির উদ্ধারের জন্য বহু কিছুই করিয়াছে, এ জন্য ইহা আমাদের নিকট চিরকৃতজ্ঞতার পাত্র।”-(আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়)
“স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নিঃসন্দেহে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি আধুনিক ভারতে নৈতিক মূল্যবোধের , ধর্মীয় সাম্যবাদের পুনর্জাগরণের পথিকৃৎ। সমাজ সংষ্কার, গঠনে তার আর্যসমাজ নিঃসন্দেহে একটি মাধ্যম।” -(নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,VEDIC Magazine 1922)
“মহর্ষি দয়ানন্দ ছিলেন ধর্মযোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্র নির্মাতা ও নির্ভীক সন্ন্যাসী। তাহার মতো আর্য অনুসরণকারীর মধ্যেও মহর্ষির গুণ আদর্শ ব্যাপকরূপে দৃষ্ট হয়। (জহরলাল নেহেরু,কলিকাতা আর্য সমাজের মন্দিরে বক্তৃতার অংশ,১৯২৯)
🌀তার অগাধ বৈদিক পান্ডিত্য, বিভিন্ন দার্শনিক মতখন্ডন সম্পর্কে বিশিষ্টজনের সাধুবাদ রয়েছে। যেমন:
“বেদভাষ্য সম্বন্ধে আমার পূর্ণ বিশ্বাস- যে ভাষ্যই প্রামাণিক বলিয়া স্থিরীকৃত হউক না কেন, স্বামী দয়ানন্দ সর্বাগ্রে পূজা পাইবেন, কারণ বেদ ভাষ্যের প্রকৃত রহস্য তিনিই আবিষ্কার করিয়াছেন। বিশৃঙ্খল, অবিদ্যা, অন্ধকার ও বহু শতাব্দীর ভ্রমজালে জনতা আবদ্ধ ছিল। তাহার দৃষ্টিই এসব ভেদ করিয়া সত্যকে গ্রহণ করিয়াছিল। রাজা রামমোহন রায় উপনিষদ পর্যন্ত পৌছিয়াই নিবৃত্ত হইয়াছিলেন, আরও অগ্রসর হইয়া অনুভব করিয়াছিলেন যে বেদই মানব জ্ঞানের মূল প্রসবণ।” (“Dayananda and the Vedas” by শ্রী অরবিন্দ)
“স্বামী দয়ানন্দজী অগাধ জ্ঞানের সাথে বেদের উপর যুক্তিবাদী টীকা লিখেছেন। নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে তিনি সর্বশেষ হিন্দু পুনরুজ্জীবনের একমাত্র অগ্রগামী পথপ্রদর্শক।”-(পন্ডিত ভগবানদাস,বেনারস)
“স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বর্তমান যুগের অন্যতম বিশাল শক্তিকেন্দ্র।বর্তমানে ভারতে কিছুর প্রয়োজনীয়তা থাকে তবে তা হলো আত্মিক জ্ঞানের পুনরুদ্ধার। স্বামী দয়ানন্দজীর দূরদর্শিতায় তা সম্ভব। “-(শ্রীমতি সরোজিনী রাইডু,১৯২২)
“সত্যার্থ প্রকাশে দয়ানন্দজীর জ্ঞানের পরিচয় রয়েছে, ভারতীয় সর্বজনীন দার্শনিক ধারায় এ জ্ঞানের মূল্য অমূল্য”-(শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল)
“ঋষি দয়ানন্দ হিন্দুসমাজের পুনরুত্থান কার্যে এত অধিক কার্য করিয়াছেন যে তাহাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দু বলা যাইতে পারে।”-(তারকনাথ দাস)
♦রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সমাজ সংষ্কারে তার অবদানও কোন অংশে কম ছিলনা।
“স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আমার গুরু।তিনিই আমাকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা, কথা বলা ও কর্তব্য পালন করা শিখাইয়াছে। আমার শরীরের সকল রক্তবিন্দু ও মনের প্রতিটি শুভচিন্তা তাহার আদর্শে প্রভাবিত”-(পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপত রায়)
“স্বামীজী ভারতের জাতীয়তা, সামাজিক এবং ধর্মীয়ভাবে একীভূত করার আদর্শ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভারতীয়দেরকে এক জাতি হিসাবে গড়ে তুলতে তিনি বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন।”-(রামানন্দ চ্যাটার্জী)
“যখন ভারতের উত্থানের ইতিহাস লিখিত হইবে, তখন সন্ন্যাসী দয়ানন্দকে সর্বোচ্চ আসন দিতে হইবে।”-(স্যার যদুনাথ সরকার)
তার বাগ্মিতা,পাণ্ডিত্য শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মানুষের কাছে প্রিয় ছিলোনা,ছিলো সকল মানুষ,সকলধর্মের, সকল দেশের মানুষের কাছে।
“আমি জানি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মহৎ উদ্দেশ্যেই কর্ম করিয়াছেন। স্বামী দয়ানন্দ যে কাজ করিয়া গিয়াছেন তাহাতেই তাহার শিষ্যগণের তৃপ্ত থাকা উচিৎ নয় বরং যে কার্য তিনি অসম্পূর্ণ রাখিয়া গিয়াছে তাহা সমাপ্ত করা উচিৎ। আর্য সমাজের যদি কিছু সেবা করিতে পারি তবে নিজেকে ধন্য মনে করিব।”-(পাশ্চাত্য দার্শনিক ম্যাক্সমুলার)
“আমি সর্বদা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম কারণ তিনি এমন একজন দুর্দান্ত এবং বিদ্বান মানুষ ছিলেন যে সমস্ত ধর্মের প্রিয় মানুষ তাকে সম্মান করতেন। আমার কাছে তিনি এমন একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন যার সমতুল্য সমগ্র ভারতে নেই।”-(স্যার সৈয়দ আহমদ খান)
“আমি দেখি কোন ব্যক্তি যখন দয়ানন্দজীর আর্য আদর্শ ভুক্ত হয়, তখন তাহার মধ্যে সুগুণ সৃষ্টি হয়, তাহার মধ্যে উৎসাহ দেশভক্তি, কর্মশীলতা ও অপূর্ব তেজস্বিতাকর্মশীল হইয়া উঠে।”-(মাওলানা হসরত মুহানী)
“সনাতন বৈদিকধর্মকে প্রকৃত অবস্থায় ফিরাইয়া আনিতে যে অগ্নি এতদিন অগ্নিকুন্ডে লুকায়িত ছিল,সেই অগ্নি ভারতের এক পরম যোগী দয়ানন্দ সরস্বতীর হৃদয়ে জ্বলিতেছিল। এ অগ্নি জগতের সমস্ত রাজ্য,সাম্রাজ্য শাসনব্যবস্থার দুর্নীতিকে ভস্মীভূত করিবে”-(A. David Jackson, USA)
“দয়ানন্দের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র সম্বন্ধে আমি বিস্মিত হইয়া যাই। তিনি জিতেন্দ্রিয়, ব্রহ্মচারী, স্বীয় সিদ্ধান্তানুকুল আচরণে দৃঢ়, হৃষ্ট-পুষ্ট, শূর-বীর ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি বড়ই ধৈর্যের সহিত কয়েক বর্ষ ধরিয়া একইভাবে ভারতের বিদ্বানদের প্রতযোগিতা করিয়াছে। তাহার স্বদেশবাসী প্রথমতঃ তাহার মস্তকে নাস্তিকতা আরোপ করিয়াছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যের উপর অচল, অটল ও দৃঢ়। স্বামী দয়ানন্দ যে সত্যের জন্য নিজেকে বলিদান দিয়াছিলেন আমি তাহা স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষরূপে বুঝিতে পারিতেছি। বাল্যকাল হইতে মরণকাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তপস্বী। আমি ভূখন্ডের সর্বত্রই আর্য সমাজকে মানবহিতকর কার্য করিতে দেখিয়াছি।-(C.F. Andrew এর “দিগ্বিজয়ী দয়ানন্দ” ১৯২৬ হইতে)
“স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী উচ্চতম ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ভাবনা ও জনজাগরণকে কর্মে পরিণত করিতে তাহার মধ্যে প্রবল শক্তি ছিল। রাষ্ট্রের পুনঃনির্মাণ কার্যে ও রাষ্ট্রের সংগঠন কার্যে তিনি ছিলেন তেজস্বী দেবদূতের মতো।”-(রোঁমা রোলা)
♦মহান এই ব্যক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠিত অহিংস বৈদিক সাম্যবাদী আদর্শ সকলের হৃদয়কে আলোকিত করুক।
যেন কৰ্মাণ্যপসো মনীষিণো যজ্ঞে কৃণ্বন্তি বিদথেষু ধীরাঃ।
যদপূর্বং যক্ষমন্তঃ প্রজানাং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমন্ত্ৰ ।। ২১
বঙ্গানুবাদঃ- কর্মনিষ্ঠ বিদ্বান ও ত্যাগী পুরুষেরা শুভকর্মে এবং জীবন যুদ্ধে যাহার সাহায্যে সব কর্ম সম্পাদন করেন এবং যাহা মানবের মধ্যে অপূর্ব শক্তি, সেই আমার মন তথা আমরা যেন শুভ সঙ্কল্পযুক্ত হতে পারি। এই প্রার্থনায় করি তোমার নিকট🙏
ও৩ম্ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্ ৷৷