© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
বঙ্গাব্দের উৎপত্তি নিয়ে বর্তমানে একাধিক মতবাদ প্রচলিত। এ একাধিক মতের মধ্যে চারজন সুবিখ্যাত রাজাকে কেন্দ্র করে চারটি মত রয়েছে। এ চারটি মত হল:
প্রথম: সম্রাট আকবর
দ্বিতীয়: সুলতান হুসেন শাহ
তৃতীয়:তিব্বতীয় শাসক স্রং-সন-গাম্পো
চতুর্থ: গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক
এ চারটি মতের মধ্যে সম্রাট আকবরকে নিয়ে প্রথম মতটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মাঝে বেশ জনপ্রিয়।পাকিস্থান আমল থেকে বিশেষ রাজনৈতিক কারণে সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছে এ মতটিকে প্রচার করা হয়। অথচ সাধারণ হিসেবেই বোঝা যায় বঙ্গাব্দ চলছে চৌদ্ধশত বছর ধরে এবং সম্রাট আকবর হলেন ষোড়শ শতাব্দীর। বঙ্গাব্দের সূচনাকাল থেকে সম্রাট আকবরের সময়কালের মধ্যে আটশত বছরের ব্যবধান। সম্রাট আকবর কি করে তার সময়কালের আটশত বছর পূর্বে চলে গিয়ে বঙ্গব্দের প্রবর্তন করে আসলেন। বিষয়টি যথাযথ বোধগম্য না হলেও বর্তমানে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হয়। বিষয়টির ব্যাপক প্রচারণার কারণে অধিকাংশই কথা বলেন। কারণ মিথ্যা বারবার বলতে সত্যের মত শোনায়। জানিনা সম্রাট আকবরের কাছে কোন টাইমমেশিন ছিলো কিনা, যে টাইমমেশিনে চড়ে তিনি আটশত বছর পূর্বের বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করে এসেছেন। বিষয়টি বর্তমানে ভাবা প্রয়োজন এবং গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সম্রাট আকবরের বঙ্গাব্দ প্রবর্তন প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, হিজরী ৯৬৩ সালটি ছিলো সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর; সেই বছরটি স্মরণীয় করে রাখতে তাকে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর হিসেবে গণ্য করে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করা হয়। সম্রাট আকবরের নির্দেশনায় এ কঠিন কাজটি সম্পাদন করেন আমীর ফতই উল্লাহ সিরাজি। তার প্রচেষ্টাতেই আরবি হিজরি সন এবং স্থানীয় ফসলি সনকে সমন্বয় করে বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হয়। কিন্তু এ তথ্যগুলো প্রচলিত হলেও যৌক্তিক নয়।এ যুক্তি অনুসারে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগে কোন বঙ্গাব্দ ছিল না। কিন্তু বিষয়টি সত্য নয়। সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বহু স্থানেই বঙ্গব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ডিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন মাটির টেরাকোটা খচিত দুটি পুরাতাত্ত্বিক শিব মন্দিরে সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে। বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড রচিত “চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস” গ্রন্থেও সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী বঙ্গাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়।এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। যারা পাণ্ডুলিপি বা পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন তারা দেখেছেন বা দেখে থাকবেন যে ; সম্রাট আকবরের সময়ের বা ১৬ শতাব্দীপূর্ব পাণ্ডুলিপিগুলিতে অনেক স্থানেই বঙ্গাব্দের নিদর্শন রয়েছে। বাংলা অঞ্চলে পাওয়া পাণ্ডুলিপিতে অধিকাংশ স্থানেই শকাব্দ এবং কিছুকিছু স্থানে শুধুমাত্রই তারিখ দেয়া আছে, সেই তারিখগুলি সুস্পষ্টরূপে বঙ্গাব্দের। যারা সম্রাট আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলেন এবং বলেন ৯৬৩ হিজরী সালকে বঙ্গাব্দে প্রতিস্থাপন করেই বঙ্গাব্দ যাত্রা শুরু করেছে, বিষয়টি হাস্যকর এবং বালখিল্য। যদি সম্রাট আকবর পূর্ববর্তী পাণ্ডুলিপি, অভিলেখ বা পুরাতাত্ত্বিক কোন একটি স্থানেও বঙ্গাব্দের উল্লেখ করা থাকে, তবেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবর তত্ত্ব নস্যাৎ হয়ে যায়। যে বিষয়টি সাধারণ দৃষ্টিতেই বোঝা যায় একটি শিশুও বিষয়টি বুঝতে পারে ; অথচ দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য – এ তত্ত্বটি ভাঙা রেকর্ডের মত প্রতিনিয়ত বাজিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। বাস্তব ভিত্তি অনেক নড়বড়ে হলেও শুধুমাত্র গায়ের জোড়ে তত্ত্বটি প্রচার করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন:
“আকবর কর্তৃক হিজরি সনের অবলুপ্তি, ‘তারিখ- ই-ইলাহী’ অব্দ প্রবর্তন প্রভৃতির কথা থাকলেও বঙ্গাব্দ বা বাঙলা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ নেই। আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমলের ‘আসল- ই-জমা তুমার’ গ্রন্থেও আকবর কর্তৃক উল্লিখিত অব্দ বা সন প্রবর্তনের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে বর্তমান কালের কিছু বইপত্র, প্রাচীন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক প্রভৃতিতে আকবর তথা হুসেন শাহের পূর্বে বঙ্গদেশে ‘বঙ্গাব্দ’-এর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ও উত্তরজীবনে খ্যাতিমান প্রশাসক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বাঁকুড়ার মন্দির’ গ্রন্থে ‘১০২ বঙ্গাব্দ’-এর উল্লেখ ; ১৩২০ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ও বৃন্দাবনচন্দ্র পুততুণ্ড-রচিত ‘চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস’ গ্রন্থে ‘বঙ্গাব্দ ৬০৬ সাল’ বলে বর্ণনা উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা থেকে প্রকাশিত ও স্বামী সারদেশানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যদেব’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের জন্মসাল হিসাবে বাঙলা ৮৯১ সনের উল্লেখ; কলকাতার বৌবাজার স্ট্রীটে (বর্তমানে বি.বি. গাঙ্গুলী স্ট্রীট) অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী কালী (ফিরিঙ্গি কালী নামেও পরিচিত) মন্দিরের বর্তমান প্রতিষ্ঠাফলকে ‘স্থাপিত ৯০৫ সাল’ বলে উল্লেখ; ১৩২৪ বঙ্গাব্দে শিলচর থেকে প্রকাশিত ও অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি-রচিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ (উত্তরাংশ: তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগ) গ্রন্থে ‘সন ৯০৬ বঙ্গাব্দ’-র উল্লেখ; ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্বলিত ও প্রবোধচন্দ্র বসু (প্রবুদ্ধ) রচিত ‘ভগবানপুর থানার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বাঙলা ৯৭৩ সালের উল্লেখ; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ থেকে প্রকাশিত ‘হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ’ (দ্বিতীয় খণ্ড) পুস্তকে প্রকাশিত বাঙলা ৯৮৫ সালে হাতে লেখা কাশীদাসের আদিপর্বের একখানি পুঁথির ফটো কপি প্রভৃতি বঙ্গাব্দ বা বাঙলা সনের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে ও আকবর তথা হুসেন শাহ কর্তৃক এই অব্দ বা সন প্রবর্তনের কাহিনীকে ভিত্তিহীন করে দেয়।”
(বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ :২৩৩-২৩৪)
বঙ্গাব্দের উৎপত্তি নিয়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মতবাদটির পক্ষে বিশেষ যুক্তি নেই। তাই এ নিয়ে বিশেষ আলোচনায় যাচ্ছি না।আমরা চতুর্থ এবং অত্যন্ত জোরালো মতটি নিয়ে আলোচনা করে এর পক্ষে যুক্তিসমূহ দেখার চেষ্টা করবো।পঞ্জিকার বর্ষগণনা অনেক জটিল। আমরা তাই কোন জটিল এবং কুটিল পথে না যেয়ে সহজভাবে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করবো। এখন ইংরেজি চলছে ২০২১ সাল এবং বাংলার চলছে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। ইংরেজি কত খ্রিস্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছে এটা জন্যে আমাদের ২০২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে বিয়োগ করলে আমরা ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ পাই। অর্থাৎ ইংরেজি ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দেই বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হয়। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সময়টি আমরা পেলাম, এখন আমরা বঙ্গাব্দ কে প্রবর্তন করেছেন সে বিষয়টি জানার চেষ্টা করবো। সারা ভারববর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, এ সনগুলো সাধারণত রাজাকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয়। রাজার সিংহাসন আরোহন অথবা বিশেষ কোন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সনগুলো প্রবর্তিত হয়। যদি বঙ্গাব্দ ইংরেজি ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দেই প্রবর্তিত হয়, তবে সেই সময় বাংলার শাসক কে ছিলেন? আমরা ইতিহাসের মাধ্যমে জানতে পারি, সে সময়ে বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত বাংলার শাসক ছিলেন, গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক। তিনি বিভিন্ন জনপদগুলোকে এক করে গৌড় নামক অত্যন্ত শক্তিশালী সাম্রাজ্যের প্রবর্তন করেন।৫৯৪ খ্রিস্টাব্দটি ছিলো সম্ভবত গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের বছর। তাই রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি বঙ্গব্দের প্রবর্তন করেন।রাজা শশাঙ্ক ভগবান শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। ইতিহাস পাঠকমাত্রই বিষয়টি জানেন। শৈব রাজা অবশ্যই শৈবদের পবিত্র সোমবার দিনটিকেই যে রাজ্যাভিষেক,অব্দ প্রবর্তন সহ সকল কাজেই অগ্রাধিকার দিবেন, এটাই স্বাভাবিক।লোডস্টার, প্ল্যানেটরিয়াম সহ বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ দিনটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে দিনটি ছিলো ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল। বিশেষভাবে উল্লেখ যে, বারটি ছিলো শৈব সম্প্রদায়ের প্রিয় সোমবার। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ‘বাংলাপিডিয়া’য় পি.কে. ভট্টাচার্য মহারাজ শশাঙ্ক সম্পর্কে বলেন:
“শশাঙ্ক প্রাচীন বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি। নরপতি হিসেবে শশাঙ্ক অত্র অঞ্চলের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। শশাঙ্ক ৬০০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন বলে ধারণা করা হয়। মেদিনীপুর থেকে তাঁর ৮ম ও ১০ম রাজ্যাংকে উৎকীর্ণ দুটি লিপি এবং তারিখবিহীন অপর একটি লিপি খড়গপুরের নিকট এগ্রা হতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া শশাঙ্কের অধীনস্থ গঞ্জামের (উড়িষ্যা) রাজা মাধববর্মার তাম্রশাসন (৬১৯ খ্রিস্টাব্দের), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মনের নিধানপুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। শশাঙ্কের উৎকীর্ণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে। গুপ্তদের পতন ও শশাঙ্কের উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায় বেশ কিছু স্বাধীন শাসকের উদ্ভব ঘটে। এঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায় অল্প কিছু লিপি এবং স্বর্ণ মুদ্রার ভিত্তিতে। রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহাসামন্ত শশাঙ্ক’, বাণভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং এর বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।”
মহারাজ শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের সময় হিসেবে আমরা বলছি, দিনটি হলো- ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল। কিন্তু আমরা বাংলাপিডিয়ায় দেখতে পাই, মহারাজ শশাঙ্কের রাজত্বকাল শুরু ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। দুটি তথ্যের মধ্যে ছয় বছরের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পুরাতন ঐতিহাসিক তথ্য পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে বলা অত্যন্ত দুষ্কর। মহারাজ শশাঙ্কের ইতিহাস নিয়ে আমরা কাজ করতে আমরা লক্ষ্য করেছি, অধিকাংশ পণ্ডিত তাঁর শাসনকালকে আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ সরলভাবে গ্রহণ করেছেন। তবে মহারাজ শশাঙ্কের সময়টি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ছয় বছর পূর্বে হলে যৌক্তিক হয়। তবে এরপরেও যদি আমরা তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, সম্রাট শশাঙ্ক ৬০০ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসন আরোহন করেছেন, তবে তবেও বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে সমস্যা নেই। হতে পারে তিনি আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাগ্রহণের পূর্বেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছেন। অথবা রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তাঁর জীবনের কোন বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করতে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছেন।পণ্ডিতদের গবেষণায় ভিন্নমত হবে এটাই স্বাভাবিক।তবে সেই ভিন্নমত সত্ত্বেও একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, গৌড় বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম মহারাজ শশাঙ্ক হলেন বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। তবে কিছু গবেষক দাবি করেন যে, মহারাজ শশাঙ্কর কালে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তাঁর পক্ষে বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করা সম্ভব নয়। এ প্রশ্নের একটি অত্যন্ত যৌক্তিক উত্তর রয়েছে। মহারাজ শষাঙ্কের সময়ে হয়ত বাংলা ভাষা বর্তমানকালের মত সম্পূর্ণ বিকশিত হয়নি। কিন্তু বঙ্গ জনপদ সুপ্রাচীনকাল থেকেই গর্বের সাথে ছিল। একারণেই ঋগ্বেদের অরণ্যকে বঙ্গের নাম পাওয়া যায়।রামায়ণের আদিকাণ্ডেও বঙ্গের নাম পাওয়া যায়। মহাভারতসহ বিবিধ সংস্কৃত গ্রন্থেও বঙ্গের নাম পাওয়া যায়।
সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ইলাহী বর্ষপঞ্জির মাস বা নববর্ষের দিনের সাথে বঙ্গাব্দের মাস বা পয়লা বৈশাখের কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বঙ্গাব্দের মতো এপ্রিলের ১৩, ১৪ বা ১৫ তারিখে নববর্ষ পালিত হয় আকবরের সাম্রাজ্যের বহির্ভূত অনেক অঞ্চলেই। যে সকল অঞ্চল আকবরের সাম্রাজ্যের সরাসরি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। তাই সম্রাট আকবরের নির্দেশনা মানার তাদের কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। কিন্তু সে সকল অনঞ্চলেও নববর্ষ পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। সে সকল হল: পূর্বভারতের বহু জনজাতি অধ্যুষিত আসাম প্রদেশে ‘বিহু। হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত নেপালের নতুন বছরের নাম ‘নববর্ষ’। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে ‘উগাড়ি’ এবং তামিলনাড়ু তে ‘পুথাণ্ডু’। বর্তমান ভারতবর্ষের বাইরেও অনেক দেশে পয়লা বৈশাখের সময়ে নববর্ষ প্রচলিত। সে সকল দেশে কখনই সম্রাট আকবরের কোন প্রভাব ছিলো না। দেশগুলো হলো: ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় পয়লা বৈশাখে নববর্ষের নাম ‘আলুথ আওরুদ্ধ’। মায়ানমারে বৈশাখে নববর্ষের নাম ‘থিংগিয়ান’। থাইল্যাণ্ডে চৈত্য সংক্রান্তির নামে ‘সংক্রান’। কম্বোডিয়ায় নববর্ষের নাম ‘চাউল চনাম ঠমে’ এবং লাওসে ‘পী মাই’। এ সকল দেশে মুগল শাসন তো দূরে থাক, মুঘল শাসক বিশেষ করে সম্রাট আকবরের ছায়া পর্যন্ত কখনও পড়েনি। এরপরেও এ সকল দেশের নববর্ষ কেন এপ্রিলের মাঝামাঝি বা পয়লা বৈশাখ থেকে? এ যৌক্তিক প্রশ্নটির উত্তর জানি, অধিকাংশের কাছেই নেই। আর যাদের কাছে, তারাও নিরুত্তর। তাই আমরা সন্দেহ বিহীনভাবে বলতে পারি যে, বঙ্গাব্দ বা বৃহত্তর ভারতবর্ষের বর্ষপঞ্জি হল প্রাক-ইসলামী বা প্রাক-মুগল যুগের। বর্ষপঞ্জিটি ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পূর্ব থেকেই দক্ষিণ ভারত এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার হিন্দু রাজশক্তি দ্বারা অনুসৃত।
তথ্য সহায়তা:
১.সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,’বঙ্গাব্দ প্রসঙ্গ’, উদ্বোধন : শতাব্দীজয়ন্তী নির্বাচিত সঙ্কলন,কলিকাতা, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৯
২.পি.কে. ভট্টাচার্য, ‘শশাঙ্ক’, বাংলাপিডিয়া, ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৪
৩.দেবব্রত, বাঙ্গালীত্বই আমাদের হিন্দুত্ব, পশ্চিমবঙ্গের জন্য, কলকাতা: প্রথম প্রকাশ, জুন ২০২২
লেখক পরিচিতি:
শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়