© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ ছিলেন অখণ্ড হিন্দুত্বের প্রচারে এক সিংহহৃদয়পুরুষ। তিনি শুধু একজন সন্ন্যাসীই ছিলেন না, যুগপৎ একজন তেজদীপ্ত বীর সন্ন্যাসীও ছিলেন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল, সকল হিন্দু জাতি,বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে আবার পূর্বের মত জাগ্রত হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হবে। এ ঐক্যবদ্ধতার আকাঙ্ক্ষায় তিনি বলেন:
“হিন্দুর বিদ্যা বুদ্ধি, অর্থ ও সামর্থ্য আছে, কিন্তু নেই সংহতি শক্তি। এই সংহতি চেতনা জাগিয়ে দিলে হিন্দু আবার জাগ্রত হবে।”
এ হিরন্ময় বাক্যটি বলেছেন শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ।তিনি ১৮৯৬ সালের ২৯ জানুয়ারি বুধবার মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বিষ্ণুচরণ ভূঞা এবং মাতার নাম সারদাদেবী। বাল্যকালে তাঁর নাম ছিল বিনোদ। নাথ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা গোরক্ষপুরের মহাযোগী বাবা গম্ভীরনাথজীর নিকট ১৯১৩ সালে ১৭ বৎসর বয়সে তিনি দীক্ষালাভ করেন এবং ১৯১৬ সালে মাত্র ২০ বৎসর বয়সে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ১৯২৪ সালে প্রয়াগে অর্দ্ধকুম্ভমেলায় স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরির নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করে স্বামী প্রণবানন্দ নামে পরিচিত হন। ১৯৪১ সালের ৮ জানুয়ারি মাত্র ৪৫ বৎসর বয়সে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তাঁর পবিত্র দেহকে মাদারীপুরের বাজিতপুরে তাঁর জন্মস্থলে বিরাজিত সাধনক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।
আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯১৭ সালে মাদারীপুরে সনাতন ধর্মের প্রচার এবং প্রসারে সন্ন্যাসী সংঘ গঠন করেন, যে প্রতিষ্ঠান আজ ভারত সেবাশ্রম সংঘ নামে পৃথিবী খ্যাত। আর্ত-পীড়িত গরিব মানুষের জন্যে জীবন রক্ষায় ত্রাণের ব্যবস্থা, সমাজ-সংস্কার, তীর্থস্থান সংস্কার, ধর্মচক্র, কর্মচক্রের প্রবর্তন এবং হিন্দু মিলন মন্দির সহ অসংখ্য অনন্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি উদ্ভাসিত হয়ে আছেন আমাদের হৃদয়ালোকে। মৃত্যুর আগে হিন্দু মিলন মন্দিরের এক সভায় অবহেলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষার ভার দিয়ে গিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাতে।জীবনব্যাপী সাধনার অভিজ্ঞতাকে সূত্রবদ্ধ করে এক জ্যোতির্ময় পথের সন্ধান দিয়েছেন প্রণবানন্দজী মহারাজ । তিনি আত্মবিস্মৃতিকে মৃত্যু বলে অভিহিত করেছেন। আত্মবিস্মৃত জাতি হিসেবে বর্তমান কালের হিন্দুকে ধিক্কার দিয়ে আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতার মহাসম্বলকে অবলম্বন করে জেগে মহামুক্তি, আত্মতত্ত্বোপলব্ধির লক্ষ্যে অগ্রসর হতে বলেছেন।
“লক্ষ্য কি?- মহামুক্তি, আত্মতত্ত্বোপলব্ধি।
ধর্ম কি ?- ত্যাগ, সংযম, সত্য, ব্রহ্মচর্য।
মহামৃত্যু কি ?- আত্মবিস্মৃতি।
প্রকৃত জীবন কি?- আত্মবোধ, আত্মস্মৃতি, আত্মানুভূতি। মহাপূণ্য কি ?- বীরত্ব, পুরুষত্ব, মনুষ্যত্ব, মুমুক্ষত্ব (মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা)।
মহাপাপ কি ?- দুর্বলতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা।
মহাশক্তি কি ?- ধৈর্য, স্থৈর্য, সহিষ্ণুতা।
মহাসম্বল কি ?- আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা, আত্মমর্যদা। মহাশত্রু কি?- আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা, রিপু ও ইন্দ্রিয়গণ।
পরম মিত্র কি ?- উদ্যম, উৎসাহ, অধ্যবসায়”
হিন্দু ধর্মান্তকরণ রোধে স্বামী প্রণবানন্দ তাঁর শিষ্য অদ্বৈতানন্দ সহ অনেককেই প্রেরণ করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। বাঙালি হিন্দু সাধুদের মধ্যে বিবেকানন্দ পরবর্তীতে তিনিই প্রধানতম হিন্দুত্ববাদী সন্ন্যাসী। সিংহের মত ছিলো তাঁর দেহের তেজদীপ্ততা এবং পরাক্রম। স্বামী প্রণবানন্দজীর আদর্শ এবং শিক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। তিনিই প্রথম বলেছেন হিন্দু নাম নিয়ে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই, বরং তা অত্যন্ত গর্বের। হিন্দুকে হিন্দু নামেই ডাক দিতে হবে, তবেই সে জাগবে।
“যে যা, তাকে তাই বলে ডাকলে সে সাড়া দেয়।মুসলমানকে মুসলমান বলে ডাক দেওয়া হচ্ছে, তাই সে সাড়া দিচ্ছে। খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টান বলে ডাক দেবার লোক আছে, তাই সে ডাকে সাড়া দিচ্ছে, নিজেদের অস্তিত্বও সেভাবে অনুভব করছে।কিন্তু হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার লোক নেই। গত একশ বছর ধরে কেউ ডাক দিয়েছে-‘ব্রাহ্ম’ বলে, কেউ ডেকেছে ‘আর্য্য’ বলে, কেউ ডেকেছে ‘ভারতীয় জাতি’ বলে, কোন পক্ষ তাকে আখ্যা দিয়ে রেখেছে অমুসলমান। বিরাট ভারতীয় জাতটা অসাড়, অবশ হয়ে আত্মভোলা হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।আজ সময় এসেছে হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার।”
হিন্দু জাগরণের লক্ষ্যে স্বামী প্রণবানন্দ তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসংখ্য প্রয়াস গ্রহণ করেছেন এর মধ্যে হিন্দু মিলন মন্দির অন্যতম। এ হিন্দু মিলন মন্দির তৈরি প্রসঙ্গে স্বামী প্রণবানন্দ বললেন: “আমার মন্দির, কোনও ইট পাথরের মন্দির নয়। ইট পাথর গেঁথে গেঁথে লোকে মন্দির করে,আমি হিন্দুসমাজের খণ্ডবিখণ্ড অঙ্গগুলো, ছিন্নবিছিন্ন অংশগুলিকে গেঁথে বিরাট হিন্দুমিলন মন্দির তৈরি করব। আমার মিলন মন্দির হচ্ছে-হিন্দুর সার্বজনীন মিলনক্ষেত্র।”
পূর্ব এবং উত্তর বাংলা সহ বাংলার গ্রামে গ্রামে হিন্দুদের সামাজিক মিলন ক্ষেত্র হিন্দু মিলন মন্দির তৈরি করেন।সাথে সাথে হিন্দুদের রক্ষার্থে গঠন করেন এক প্রশিক্ষিত রক্ষীদল । প্রাচীন গুরুকুলের শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শে স্থাপন করেন বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গরিব, পিছিয়ে পরা এবং অনুন্নত সমাজের উন্নয়নে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার দূরীকরণ সহ মহামারী দুর্ভিক্ষ,ভূমিকম্প বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উত্তরণের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। মিশনারী এবং জেহাদিদের পাল্লায় পরে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে তাদের রক্ষার্থে তিনি তাদের আবার সনাতন ধর্মে নিয়ে আসতে শুরু করেন শুদ্ধি যজ্ঞ আন্দোলন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ধরা হয় তীর্থসংস্কারকে, প্রত্যেকটি হিন্দু যাতে নির্বিঘ্নে তীর্থ করতে পারে এরজন্যে তিনি অসংখ্য কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে উপলব্ধি করেছিলেন একমাত্র হিন্দু ছাড়া , অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীরাই ঐক্যবদ্ধ ও সুরক্ষিত। সকলেরই একটি বৈশ্বিক ধর্মীয় জাতিচেতনা আছে। কিন্তু পক্ষান্তরে হিন্দুরা অরক্ষিত, বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত, ছিন্নভিন্ন, আত্মকলহপ্রিয় , হতচ্ছাড়া এবং পরিশেষে দুর্বল। তাই ঘুমন্ত নিমজ্জমান হিন্দুদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিতে স্বামী প্রণবানন্দ বলিষ্ঠ কন্ঠে আহ্বান করেছিলেন। আমাদের প্রত্যেক হিন্দু পরিবার যেন শাস্ত্র, সদাচার ও হিন্দু ধর্মের অনুশাসন মেনে প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও সমবেত ভাবে ভগবানের উপাসনা করে হিন্দুত্বের আদর্শে জীবন যাপন করে প্রত্যেককেই মনে প্রাণে, আচরণে ব্যবহারে, আহারে বিহারে,পোশাকে পরিচ্ছদে,বাক্যলাপে ও চিন্তা ভাবনা প্রভৃতিতে খাঁটি হিন্দু হতে পারি এবং সর্বোপরি হিন্দুত্বকে রক্ষার জন্যে কঠোরপ্রতিজ্ঞ হতে পারি।তবেই এ জাতি জাগবে। সকল প্রকারের অস্পৃশ্যতা বিদূরিত করে হিন্দু সম্প্রদায়কে একত্রিত এবং শক্তিশালী করতে জাতিসংগঠক স্বামী প্রণবানন্দ বলেন:
“হিন্দু কখনো হিন্দুর নিকট অস্পৃশ্য হইতে পারে না। হিন্দুতে হিন্দুতে মিলন ও ঐক্যের মধ্য দিয়াই হিন্দু জাতি অসীম শক্তির অধিকারী হইবে। হিন্দুর বিদ্যা আছে বুদ্ধি আছে, প্রতিপত্তি আছে, নেই শুধু মিলন ও ঐক্য। হিন্দুতে হিন্দুতে মিলন যত দ্রুত সম্ভব, হিন্দু মুসলমান বা হিন্দু খ্রীষ্টানে মিলন তত দ্রুত সম্ভব নয়। আমি প্রতিটি হিন্দুকে ‘আমি হিন্দু আমি হিন্দু’ বলিয়া জপ করাই। আর তার জন্যই প্রয়োজন এক ক্ষেত্র। মিলন মন্দিরের জাল ফেলিয়া সকল শ্রেণীর হিন্দু নরনারীকে একত্রিত করিতে হইবে। তবেই হিন্দু জাতি আবার শক্তিশালী হইতে পারিবে।“
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে স্থান থেকে সংগঠনটি স্থাপিত হয়ে সারা পৃথিবীতে আজ তার শতশত শাখা।সেই বাংলাদেশে বা মাদারীপুরেই সংগঠনটি আর প্রণবানন্দ মহারাজ প্রবর্তিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ নামে থাকতে পারেনি। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গায়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, কানাডা, ফিজি সহ সারা পৃথিবীব্যাপী ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ নামে থাকলেও বাংলাদেশে সংগঠনটি হয়ে যায় প্রণব মঠ।
আমরা প্রাচীন বৃহত্তর ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হলেও; ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা করলেও; চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্যে ভারতে গেলেও; একথা অনেকটাই সত্যি যে ভারতের নাম শুনলে এখনও অনেকের গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতসম্পন্ন যোগীপুরুষ প্রণবানন্দজী মহারাজ, অথচ তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরে তাঁর নামে সামান্যতম কিছুই নেই। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ দূরে থাক, তাঁর নামে নূন্যতম একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় অন্তত হতে পারতো। কিন্তু এখানেও রাজনৈতিক কবিরা নিরব!
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়