© প্রিয়াংকা বিশ্বাস
এই লিপিটি আছে হংসেশ্বরী মন্দিরে।
লিপিতে লেখা আছে : মহীব্যোমাঙ্গশীতাংশু গণিতেশকবৎসরে
শ্রীরামেশ্বরদত্তেন নির্ম্মমেবিষ্ণুমন্দিরং
লেখার এই ফণ্ট সেই যুগের বাংলা। ব্রাহ্মী বা সিদ্ধিমাতৃকা লিপির অনেক অনেক পরের হরফ। তাই বর্তমান বাংলা হরফ এবং দেবনাগরীর সঙ্গে অনেক মিল আছে। যেমন চন্দ্রবিন্দুটা দেবনাগরীর মতো উপর দিকে একটা ফুটকি হয়ে বসেছে। আবার ‘র’ বর্ণটা পেট কাটা ব ….. অসমীয়া ভাষায় এখনও এভাবেই র লেখা হয় । ঙ্গ, শ্র …. এগুলোর সঙ্গে দেবনাগরীর মিল আছে । ‘শ’ বর্ণটা বাংলা ‘ন’ এর মতো লাগবে, ওটা শ অক্ষরটার বিবর্তনের জার্নি বলা যেতে পারে।
এবার আসি দুটো লাইনের ব্যাখ্যাতে । মনে করিয়ে দিই, সেই বৈদিক যুগ থেকে রূপকের আড়ালে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিদ্যা, শাস্ত্র, শস্ত্র চর্চা হয়েছে । এগুলো হতো যাতে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তিই সে সব বুঝতে পারে। এখানেও সেই রূপকের আড়ালে লুকিয়ে আছে সংখ্যা :
মহীব্যোমাঙ্গশীতাংশু গণিতেশকবৎসরে
শ্রীরামেশ্বরদত্তেন নির্ম্মমেবিষ্ণুমন্দিরং
…. একটু ভেঙে ভেঙে লিখি বোঝার সুবিধার্থে।
মহী ব্যোম অঙ্গ শীতাংশু গণিতে শক বৎসরে
শ্রী রামেশ্বর দত্তেন নির্ম্মমে বিষ্ণু মন্দিরং
মহী : যা মহান …. তা সব সময়ই এক। মহান ব্যক্তি বা বস্তু …. সব সময় একটাই বোঝায়। তাই মহী = ১
এখানে চন্দ্র বা চাঁদের কোনও প্রতিশব্দও লেখা থাকতে পারতো ১ সংখ্যাটিকে বোঝানোর জন্য।
ব্যোম : শূন্য = ০
অঙ্গ : ছ’টা অঙ্গ থাকে মানবদেহে। দুটো হাত, দুটো পা, মাথা এবং কটিদেশ বা ধড়। অর্থাৎ অঙ্গ = ৬
মনে রাখতে হবে, এখানে ব্যোমাঙ্গ না লিখে ‘ব্যোম ঋতু’ লিখতেই পারতো । সেক্ষেত্রেও অর্থটা সেই ছয় বোঝাতো। তাহলে এখান থেকে পাওয়া গেলো অঙ্গ = ৬
শীতাংশু : চাঁদ। একে চন্দ্র মনে আছে তো ? তাই চন্দ্র = ১
এরপর লেখা ‘গণিতে শক বৎসরে’। কী কী সংখ্যা পেয়েছি ? ১০৬১ … গণিতে এটার নিয়মে বামাগতি নিয়মটা প্রযোজ্য হবে । অর্থাৎ উল্টো দিক থেকে হবে ১৬০১ শকাব্দ।
শকাব্দ জানলে, সেখান থেকে খ্রীষ্টাব্দ বার করে নেওয়া খুবই সহজ। যেহেতু ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে শকাব্দ গণনা শুরু হয়, তাই শকাব্দের সঙ্গে ৭৮ যোগ করলেই খ্রীষ্টাব্দ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ( ১৬০১ + ৭৮ ) = ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দ । অর্থাৎ এই মন্দিরটা ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত। শ্রী রামেশ্বর দত্ত এটা নির্মাণ করেন। এটি একটি বিষ্ণু মন্দির।
অনেকের প্রশ্ন আসতে পারে, সোজাসুজি না লিখে এমন রূপকের আশ্রয় নেওয়া কেন? আগেই বলেছি, ভারতবর্ষে সভ্যতার আদিকাল থেকে বিদ্যা অর্জন করতে হতো। হ্যাঁ, নিজগুণে “অর্জন” করতে হতো। আজকের মতো টাকা দিয়ে প্রাইভেট কলেজে ডিগ্রি পাওয়া অথবা মন্ত্রীদের হুকুমে ঢালাও মাধ্যমিক পাশ করা অক্ষরজ্ঞানহীন ছেলেমেয়েদেরকে পক্ষে এই ‘অর্জন’ করার গুরুত্বটা বোঝা একটু কঠিন।
গুরু সবাইকে সব জ্ঞান দিতেন না। বিদ্যা দান করার আধারটা যেমন বুঝে নিতেন, তেমনই অন্যান্য উপযুক্ততা যাচাই করে নেওয়া হতো। অধীত বিদ্যা বা জ্ঞানের অপপ্রয়োগ করবে না, এমন শিষ্যকেই বিশেষ বিশেষ বিদ্যা দান করা হতো। খুব ভালো ধনুর্বীর হলেই তাকে ব্রহ্মাস্ত্র দেওয়া হতো না। আবার মহাভারতে গীতার মতো এক মহাজ্ঞান অর্জুনকে দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, কারণ অর্জুন এই জ্ঞান বা এই বিদ্যা গ্রহণ করার যোগ্য আধার ছিলেন। এই জ্ঞান কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে দেওয়া হয়নি।
প্রাচীন ভারতবর্ষে এটাই মেনে চলা হতো : যোগ্যতা থাকলে বুঝে নাও, নইলে ফুটে যাও। হাফ জেনে, হাফ বুঝে খিল্লি করা পাবলিককে ঠেকিয়ে রাখার অমোঘ উপায় ছিল এটা।
ঠিক যেমন আজকের যুগে বহু রকম ওষুধ অ্যাপ্লাই করার বিদ্যা দেওয়া হয় যোগ্য ডাক্তারকে। ডাক্তার খুব ভালো জানেন, ঐ ওষুধের অপব্যবহার কী ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে, হয়তো মানুষ খুন করা যায় সেটা দিয়ে । কিন্তু যোগ্য ব্যক্তির হাতে থাকার কারণে ওষুধের অনেক গুণাগুণ গোপন থাকে ডাক্তারের কাছে।
ঋকবেদের বহু শ্লোক, অথর্ববেদের চিকিৎসা পদ্ধতি বা এমন বহু কিছুই থাকতো রূপকের আড়ালে। আর্যভট্টের গণিতেও রূপকের ব্যবহার পাওয়া যায়। যোগ্য ব্যক্তিরা বুঝে নিতেন। সেই যুগে সত্যবানের মতো পিতৃপরিচয়হীন, বংশ পরিচয়হীন মানুষও বিদ্যা অর্জনের সুযোগ পেতেন নিজের যোগ্যতায়। যোগ্যতা … ইয়েস। সেটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল।
কিন্তু আজ বিদ্যা অবাধ। ঋকবেদ থেকে ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরাণ সব কিছুরই পিডিএফ অ্যাভেলেবল। অর্ধেক বুঝে, না বুঝে অপব্যাখ্যা, বিদ্রূপ চলছে । এই মন্দির নির্মাণের যুগ অর্থাৎ মাত্র চারশো বছর আগেও ‘যোগ্য ব্যক্তি বুঝবে’ …. এটা ভেবে নির্মাণকাল লেখা হতো। সেই কারণেই এই রূপকের আড়াল।
আর একটা কারণ ছিল হয়তো। এটা আমার আন্দাজ। পাঠান, মুঘল ইত্যাদি বহিরাগত উৎপাতে জর্জরিত ভারতবর্ষ তখন নিজেদের বিদ্যা, ধর্মস্থান যতোটা সম্ভব গোপনে রাখার চেষ্টা করতো। মন্দিরগুলো ছিল বিদ্যাচর্চার স্থান, তাই বিদ্যা দান আটকানোর জন্যও মন্দির আক্রমণ করা হতো। মন্দির যতো পুরনো হয়, ততোই তার গুরুত্ব বাড়ে। সেই মন্দিরের নিজস্ব ধনসম্পদও বাড়ে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। এগুলো জানাজানি হলে, তার ওপর শত্রুর নজর পড়ে। এই থিওরি ভেবেও হয়তো নির্মাণকাল সংক্রান্ত তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করা হতো । ফার্সী জানা কোনও রহমতুল্লাহ খান যাতে এটা পড়ে মর্মোদ্ধার না করতে পারে, তাই এই রূপকের আড়াল। যদিও তখনকার শাসক এরপরেও ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করতো । ( এইটুকু অংশ আমার আন্দাজ )।
আসছি শেষ পর্যায়ে। এখনকার বাঙালি এই লিপি পড়তে পারে না কেন? বহু বছর ধরে এ রাজ্যে সরকারি পঠনপাঠনে বাংলা ভাষাটা সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে আরও বেশি অবহেলিত।
আমাদের সকলের মাষ্টারমশাই বিদ্যাসাগর যখন বর্ণপরিচয় লিখেছিলেন, তখন অনেক ভেবেচিন্তেই ঋ, ৯, দুটো ব …. এগুলো বর্ণমালায় রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে যাতে উচ্চ শিক্ষার সময় বিভিন্ন শব্দের উৎপত্তি, সংস্কৃত শব্দ বা তৎসম শব্দের সঙ্গে লিঙ্ক, সমাস, কারক, বিভক্তি, ধাতুরূপ বুঝতে সমস্যা না হয় …. তার বহু রসদ লুকিয়ে রয়েছে বাংলা বর্ণমালাতেই।
ধরা যাক, আজকাল আনন্দবাজারি দাবি অনুযায়ী ‘য’ বর্ণটাকে তুলে দিয়ে সব জায়গায় ‘জ’ লেখা হতে লাগলো। বাঙালদের উচ্চারণের সুবিধে ভেবেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু ‘য’ শব্দটি সম্পর্কে ধারণা না থাকলে, য-ফলা বুঝবে কী করে আগামী দিনের ছাত্ররা? যদি, যদা, যথা শব্দগুলো ‘জ’ দিয়ে লিখলে, ধাতুরূপ শিখবে কী করে ?
ড়, ঢ় তুলে দেওয়ার কথাবার্তাও চলছে।
নিজের ভাষা, সংস্কৃতিকে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য খুব প্ল্যান করেই সংস্কৃত তুলে দেওয়া হয়েছিলো। সমগ্র ভারতবর্ষের ভাষার মা এই সংস্কৃত ভাষা ভালো করে জানলে, যে কোনও ভারতীয় ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয় না তেমন। এসব লিপির মূলেও সেই সংস্কৃত, দেবনাগরী।
আমার বয়স চল্লিশ। আমার আমলেই বহু মন্দিরের নির্মাণকাল মুছে ফেলতে দেখেছি এই রাজ্যের সরকারকে। মন্দির সংস্কারের অজুহাতে টেরাকোটার মন্দিরকে সিমেণ্টের প্লাস্টারে মুড়ে ঢাকা দেওয়া হয়েছে ইতিহাস। জেলায় জেলায় এসব রয়েছে। বহু মন্দির স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। সেন যুগের ছোট বড় স্থাপত্য অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায়। আজ বলা হয়, এই রাজ্যে বিষ্ণু বা রাম বহিরাগত। এই লিপিটা হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ার বিষ্ণু মন্দিরের প্রমাণ। এখান থেকে সামান্য দূরে ত্রিবেণীতে সেই বিখ্যাত বিষ্ণুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়েছে ‘জাফর খাঁ গাজির দরগা’ নামে।
এতো কিছু লেখার পেছনে কারণ একটাই : প্লিজ সংস্কৃত শিখুন। সন্তানকে শেখান। সাঁতার শেখার মতোই পরিচয় করান হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে। আপনার ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ব সব কিছুর আধার এই দেশের ভাষা, মিউজিক, স্থাপত্য, ভাষ্কর্য। বছরে একদিন অষ্টমীর অঞ্জলী দিয়েই আপনার কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। ভাষা আমাদের মা। সেই বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃতকে ভালোবাসুন, চর্চা করুন। আর হ্যাঁ, প্রাচীন মন্দিরগুলোর নামের ফলক ঢাকা দিয়ে প্লাস্টার করতে দেখলে প্রতিবাদ করুন।