হিন্দু সদা শক্তির উপাসক



Updated: 20 December, 2023 9:49 am IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

‘বিজিগীষু’ বা যুদ্ধজয়ে ইচ্ছুক রাজা যুদ্ধযাত্রা কালে অনুষ্ঠেয় অশ্বাদির শান্তিকৰ্ম বিশেষকে শাস্ত্রীয় পরিভাষায় ‘নীরাজন’ বলে। মহাকবি কালিদাসের জগদ্বিখ্যাত রঘুবংশ কাব্যেও নীরাজনের উল্লেখ রয়েছে:

তস্মৈ সম্যগ্ হুতো বহ্নির্বাজিনীরাজনাবিধৌ । প্রদক্ষিণার্চিব্যাজেন হস্তেনেব জয়ং দদৌ ॥

স গুপ্তমূলপ্রত্যন্তঃ শুদ্ধপার্ঞ্চিরয়ান্বিতঃ ।

ষড়বিধং বলমাদায় প্রতস্থে দিগ্ জিগীষয়া ॥

 (রঘুবংশ: ৪.২৫-২৬)

“যুদ্ধযাত্রাকালে অশ্ব, হস্তি প্রভৃতি যুদ্ধাঙ্গের নীরাজন উৎসব করতে হয়। মহারাজ রঘুর অভিযান সময়ে  সেই নীরাজনোৎসবে হোমকুণ্ডের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা প্রদক্ষিণভাবে আহুতি গ্রহণপূর্বক তাঁকে যেন হাত উত্তোলন করে বিজয়ের আশীর্বাদ প্রদান করলো।

তিনি ছয় প্রকার বল ও সৈন্যসামন্তসমূহ সংগ্রহ করে উপযুক্ত অমাত্যগণের হাতে রাজ্যের এবং প্রান্তবর্তী দুর্গরক্ষার ভার অর্পণ করলেন। যুদ্ধের উপযোগী সুসজ্জিত দ্রব্যসামগ্রীসমূহ  নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ এবং আড়ম্বরের সাথে দিগ্বিজয়ে বাসনা নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলেন।”

শাস্ত্রে শরৎকালে শুক্লপক্ষের বিজয়াদশমী এবং কার্তিক অমাবস্যার তিথিতে, অর্থাৎ কালীপূজার দিনে নীরাজনের বিধি রয়েছে। এতে বিবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্যে অশ্ব, হাতিকে যুদ্ধক্ষেত্রে আরও তেজস্বীরা কামনা করা হয়।পুরোহিত, সকুশ উদুম্বরশাখা ও আমের শাখা মঙ্গলঘটের জলে ডুবিয়ে বৈদিক শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করে রাজা, অশ্ব, গজ, সৈনিক, রথ— চতুরঙ্গ স্পর্শ করেন। সাথে যুদ্ধে বা যুদ্ধযাত্রায় ব্যবহৃত সকল অস্ত্রকে পরিস্কার এবং পূজা করা হয়। অর্থাৎ যুদ্ধযাত্রার পূর্বে অস্ত্রশস্ত্রাদি পরিষ্কারকরণ তথ অর্চনাকরণ প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত। স্বস্তিবাচন, শান্তিমন্ত্র, অস্ত্রপূজা পরবর্তীতে পুরোহিত দূর্ব্বাযবাঙ্কুরাদি দ্বারা সকলকে আশীর্বাদ করেন। এ নীরাজন বিষয়টি আমরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে দেবীপুরাণেও পাই। সেখানে বলা হয়েছে, কার্তিক অমাবস্যার তিথিতে দীপমালা, দীপচক্র ও দীপবৃক্ষাদি নির্মাণ করে আদ্যাশক্তি মহাদেবীর উদ্দেশ্যে পশুবলি,পূজা, এবং হোম করা কর্তব্য। সে সময়টি যেহেতু দক্ষিণায়ন, তাই পূজার মাধ্যমে দেবতাদের জাগরিত করে দৈবশক্তির অভ্যুত্থান করতে হবে।দৈবশক্তির আশীর্বাদ নিয়ে মনুষ্য, অশ্ব, হস্তি প্রভৃতির নীরাজন করতে হবে। তবেই বিজয় সুনিশ্চিত। 

তুলাস্থে দীপদানেন পূজা কার্য্যা মহাত্মনা ।

দীপবৃক্ষাঃ প্রকর্তব্যা দীপচক্রাস্তথাপরা ।।

দীপযাত্রা প্রকর্তব্যা চতুর্দ্দশ্যাং কুহূষ চ ।

সিনীবালীস্তথা বৎস তদা কার্য্যং মহাফলম্‌ ।

সর্বশেষে প্রকর্তব্যা বলিপূজাহোমোৎসবম্‌ ।

নৈরাজনং প্রকর্তব্য নৃনাগতুরগাদিষু।

কার্তিক্যাং কারয়েৎ পূজা যাগং দেবীপ্রিয়ং সদা।।

( দেবীপুরাণ: ৫৯.২৩-২৬)

“কার্ত্তিক মাসে দীপমালা দান করে পূজা করবে। ঐ মাসের চতুর্দশী এবং অমাবস্যার দিন দীপমালা, দীপচক্র ও দীপবৃক্ষাদি নির্মাণ করিবে। ঐ দিবস বলি- পূজা- হোম করা কর্তব্য। দেবতাদের অভ্যুত্থান ও মনুষ্য, অশ্ব, হস্তি প্রভৃতির নীরাজন করবে (যুদ্ধযাত্রার পূর্বে অস্ত্রশস্ত্রাদি পরিষ্কারকরণ তথ অর্চনাকরণ)। কার্তিক মাসে দেবীর পূজা এবং দেবীর উদ্দেশ্য যজ্ঞ করবে। যজ্ঞ দেবীর অত্যন্ত প্রিয়।”

হিন্দু আজন্মকাল থেকেই শক্তির উপাসক। তাদের দেবদেবীদের মূর্তি পরিকল্পনাই এর সাক্ষ্য দেয়। সকল দেবদেবীর হাতের অসুর বিনাশে অস্ত্রসস্ত্রসজ্জিত। যিনি প্রেমের দেবতা তাঁরও হাতে বাণ। শ্রীচণ্ডীর উত্তরচরিত্রে অষ্টভুজা যে দেবী সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্র বর্ণনা করা হয়েছে, সেই ধ্যানমন্ত্রেও দেবী অস্ত্রসস্ত্রসজ্জিতা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতের সুমধুর মোহনবাশীর সাথে সাথে সুদর্শন চক্রও রয়েছে। এ চক্রটি ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং তাঁর অবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। তাই আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ প্রত্যেকটি বৈষ্ণব মন্দিরের চূড়ায় সুদর্শন চক্রকে স্থাপিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের একটি তেজদীপ্ত বাণী রয়েছে। তিনি বর্তমানের ভীত আত্মকেন্দ্রিক হিন্দু সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, হিন্দু একমাত্র শক্তির পূজক এবং শক্তির উপাসক। নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ না চেনার কারণেই আমরা আজ আমাদের পুরনো হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে পারছি না। মহাশক্তির সাধনা করে কোন মানুষ কখনো দুর্বল হতে পারে না।

“হিন্দু! তুমি কি জান না-তুমি শক্তির পূজক, শক্তির উপাসক ? তােমার সেই শক্তির সাধনা কোথায় ? শিবের হাতে ত্রিশূল, তাহা দেখিয়া তুমি কী চিন্তা করিবে? শ্রীকৃষ্ণের হাতে সুদর্শন, তাহা দেখিয়া তুমি কী ভাবনা ভাবিবে ? কালীর হাতে রক্তাক্ত খড়গ, দুর্গার হাতে দশপ্রহরণ, তাহা দেখিয়া তুমি কি শিক্ষা লাভ করিবে ? এই মহাশক্তির সাধনা করিয়া মানুষ দুর্বল হইতে পারে কি ? একবার ধীর স্থির হইয়া চিন্তা কর।”

স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের মত একই প্রকারের কথা কাজী নজরুল ইসলামের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি তার ‘রাঙা জবা’ নামক শ্যামাসংগীতের জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থে (সংগীত: ৯৯) আমাদের দ্বিভুজে পরব্রক্ষ্মময়ী আদ্যাশক্তির শক্তি কামনা করেছেন। শক্তির উপাসনাতেই শক্তি লাভ হয়। তাই শক্তি পূজা করে শুধুই ভক্তি নয়, বিশ্বজয়ী হওয়া প্রয়োজন। যদি শক্তিপূজা করেও শক্তি লাভ না হয়, বিশ্বজয়ী হওয়া না যায়; তবে সেই শক্তিপূজা নিছক বিলাসতা মাত্র। সে পূজায় কোন লাভ হয় না, শুধুই কালক্ষেপণ।

” মা গো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়!

মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রীদুর্গা,

তাই দুর্গতি কাটিল না, হায়!

যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন,

অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ 

মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী-

সেই দুর্গারে দেশ চায়।।

আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি

দে পরব্রক্ষ্মময়ী!

শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু,

হব না কি বিশ্বজয়ী?

এ পূজা-বিলাস সংহার করো

যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়।”

যে আপদকালে নিজে জেগে আগে জাতিকে জাগাতে হবে, ঠিক সে সময়েই আমরা পরে আছি ভক্ষ-অভক্ষ বা উদ্ভিজ্জ আমিষ (নিরামিষ) বা প্রাণীজ আমিষ (আমিষ) ভোজন নিয়ে বিতর্কে। একজন ধর্মযোদ্ধার কাছে ধর্মরক্ষাই মুখ্য। কে নিরামিষ আহার করে বা কে আমিষ করে এ বিষয়টি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ধর্মরক্ষা বলতে অবশ্য ব্যবহারিক ধর্মকে বোঝানো হয়েছে। কারণ শাশ্বত ধর্ম ঈশ্বর প্রণীত, কোন মানুষ এই শাশ্বত ধর্মকে রক্ষা করতে পারে না। মানুষ শুধু পারে নিজে ধর্মীয় বিধানগুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করে, তার পরিসীমার মধ্যের মানুষকে সেই আচরিত দৃশ্যমান ব্যবহারিক ধর্মে উদ্ভুদ্ধ করতে। শাশ্বত ধর্ম একটি বিমূর্ত অবিনশ্বর সত্ত্বা, কিন্তু ব্যবহারিক ধর্ম দৃশ্যমান। এ ব্যবহারিক ধর্মকেই সাধ্যমত রক্ষা করতে হয়। তা না হলে পারিপার্শ্বিক অধর্ম এ ব্যবহারিক ধর্মকে গ্রাস করতে অগ্রসর হয়। এ ব্যবহারিক ধর্ম রক্ষার্থে মানসিক, শারীরিক শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিহীন জাতি ধর্মকে রক্ষা করতে তো পারেই না, এমনকি ঈশ্বরকেও লাভ করতে পারে না। আপদকালীন সময়ে ধর্মের স্বরূপ পরিবর্তিত হয়। সে সময়ে জাতি, ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং জীবন রক্ষার্থে ধর্মের বিধানাবলি পরিবর্তিত হয়। তাই সেই আপদকালীন ধর্মসঙ্কটের সময়ে খাদ্যাখাদ্য মুখ্য অগ্রাধিকার না দিয়ে যে খাদ্যে শরীরে দ্রুত বল লাভ হয়, পৌরুষ জাগরিত হয়; সে সকল খাদ্যই একজন ধর্মযোদ্ধার গ্রহণ করা উচিত। কারণ একজন ধর্মযোদ্ধার কাছে ধর্মরক্ষাই মুখ্য, অন্য সমস্তই গৌণ। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত রয়েছে:

“ফলকথা, চিরকালই মাংসাশী জাতিরাই যুদ্ধবীর, চিন্তাশীল ইত্যাদি। মাংসাশী জাতেরা বলছেন যে, যখন যজ্ঞের ধুম দেশময় উঠত, তখনই হিঁদুর মধ্যে ভাল ভাল মাথা বেরিয়েছে, এ বাবাজীডৌল হয়ে পর্যন্ত একটাও মানুষ জন্মাল না। এ বিধায় মাংসাশীরা ভয়ে মাংসাহার ছাড়তে চায় না। আমাদের দেশে আর্যসমাজী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিবাদ উপস্থিত। এক পক্ষ বলছেন যে, মাংস খাওয়া একান্ত আবশ্যক; আর পক্ষ বলছেন, একান্ত অন্যায়। এই তো বাদ-বিবাদ চলছে ।

সকল পক্ষ দেখে শুনে আমার তো বিশ্বাস দাঁড়াচ্ছে যে, হিঁদুরাই ঠিক, অর্থাৎ হিঁদুদের ঐ যে ব্যবস্থা যে জন্ম-কর্ম-ভেদ আহারাদি সমস্তই পথক, এইটিই সিদ্ধান্ত। মাংস খাওয়া অবশ্য অসভ্যতা, নিরামিষ ভোজন অবশ্যই পবিত্রতর। যার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ধর্মজীবন, তাঁর পক্ষে নিরামিষ; আর যাকে খেটেখটে এই সংসারের দিবারাত্রি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জীবনতরী চালাতে হবে, তাকে মাংস খেতে হবে বইকি। যতদিন মনুষ্য-সমাজে এই ভাব থাকবে—’বলবানের জয়’, ততদিন মাংস খেতে হবে বা অন্য কোনও রকম মাংসের ন্যায় উপযোগী আহার আবিষ্কার করতে হবে। নইলে বলবানের পদতলে দুর্বল পেষা যাবেন। রাম কি শ্যাম নিরামিষ খেয়ে ভাল আছেন বললে চলে না—জাতি জাতির তুলনা করে দেখ।

আবার নিরামিষাশীদের মধ্যেও হচ্ছে কোঁদল এক পক্ষ বলছেন যে ভাত, আলু, গম, যব, জনার প্রভৃতি শর্করাপ্রধান খাদ্যও কিছুই নয়, ও-সব মানুষে বানিয়েছে, ঐ সব খেয়েই যত রোগ। শর্করা-উৎপাদক (starchy) খাবার রোগের ঘর। ঘোড়া গরুকে পর্যন্ত ঘরে বসে চাল গম খাওয়ালে রোগী হয়ে যায়, আবার মাঠে ছেড়ে দিলে কচি ঘাস খেয়ে তাদের রোগ সেরে যায়। ঘাস শাক পাতা প্রভৃতি হরিৎ সবজিতে শর্করা-উৎপাদক পদার্থ বড্ড কম।”

(স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ২০১৫: ১৩৭)

শত্রু যদি আসুরিক ভাবাপন্ন পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়, তবে সেই শত্রুকে জয় করা ধর্মেরও একটি অঙ্গ। তাই শ্রীচণ্ডীর শুরুতে অর্গলাস্তোত্রেই দেবীর কাছে শত্রুজয়ের প্রার্থনা করা হয়েছে। 

মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃ বরদে নমঃ । 

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ॥ মহিষাসুরনির্ণাশি ভক্তানাং সুখদে নমঃ ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ॥ 

ধূম্রনেত্রবধে দেবি ধর্মকামার্থদায়িনি ।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ॥ 

( শ্রীচণ্ডী:অর্গলাস্তোত্র, ৩-৫)

“হে মধুকৈটভবিনাশিনি, হে ব্রহ্মাবরদায়িনি তোমাকে নমস্কার। আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও এবং আমার শত্রু নাশ করো। 

হে মহিষাসুরনাশিনি ও ভক্তগণের সুখদায়িনি, তোমাকে নমস্কার। আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমার শত্রু বিনাশ করো। 

হে ধূম্ৰলোচনবিনাশিনি, হে ধর্ম অর্থ ও কামদায়িনি দেবি, আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও, আমার শত্রু নাশ করো।”

তথ্য সহায়তা:

১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (ষষ্ঠ খণ্ড), উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: সেপ্টেম্বর ২০১৫

লেখক পরিচিতি:

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী,

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়