গুরু গোবিন্দ সিং ও তাঁর চার পুত্রের বলিদান



Updated: 26 December, 2023 8:10 am IST

© পৃথ্বীশ সেন

গুরু গোবিন্দ সিং।

পিতা- গুরু তেঘ বাহাদুর
মাতা- গুজরি মাই

জন্মস্থান: পাটনা

সময়কাল: 1621-1675

গুরু গোবিন্দ সিং-এর চার পুত্র।
(যারা ধর্মরক্ষায় পুরো পরিবারসমেত নিজেদের বলি চড়িয়ে দিয়েছেন)

Chidiyan te mein Baaz tudaun,
Giddran toh mein sher banaun,
Sawa lakh se ek ladaun,
Tabe Gobind Singh Naam kahaun.

It is when I make sparrow fight hawks,
it is when I make lions out of wolves,
it is when I make one fight with one lakh
that I am called Gobind Singh.

উপরের কথাটি ভালো করে বুঝলে পরে অবাক লাগে। অবিশ্বাস্য লাগে। কিন্তু এটাই তার কথা। কথা শুধু নয়। কাজে করেও দেখিয়েছেন তিনি। মাত্র চল্লিশ জন হয়ে মোকাবিলা করেছেন লক্ষের উপরে সেনার সাথে। ভাবতেও পারা যায় না। কি আত্মবিশ্বাস।

এই জন্যই বলে-
সিংহের বাহিনীর নেতৃত্ব যদি এক নেকড়ে দেয় তবে সেই বাহিনীর আচরণ হয় নেকড়ের মত।
আর যদি নেকড়ে বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় এক সিংহ তাহলে সেই বাহিনীর আচরণ হয় সিংহের মত।।।

কে ইনি???
যিনি চল্লিশ হয়ে লড়াই করেন লাখের সাথে
কি করে ভাবতে পেরেছিলেন তিনি????
যেখানে শোনামাত্র আমাদের হাত পা অবশ হয়ে যায়…

পরিচিতি:

তিনি যে সে নন। তিনি গুরু গোবিন্দ সিং।
1666 সালের 22 সে ডিসেম্বর তিনি বর্তমান পাটনা শহরে জন্মগ্রহন করেন।
পিতা নবম #গুরুতেঘবাহাদুর আর মাতা গুজরি।

তখন তার পিতা তেঘ বাহাদুর সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাংলা আসামের বিভিন্ন জায়গায়। তখনই জন্ম হয় তার। যেখানে জন্ম নেন তিনি সেটি বর্তমানে এক বিশাল সৌধে পরিনত হয়েছে নাম তখত শ্রী পাটনা হরিমন্দর সাহিব। এইখানে তার জীবনের প্রথম চারটি বছর অতিবাহিত হয়।
এরপরে তিনি তার পিতামাতার সাথে ফিরে আসেন পাঞ্জাব।
ছয় বছর বয়স হলে তিনি হিমালয়ের কোলে অপরূপ পরিবেশে অবস্থিত এক স্কুলে তিনি পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন।

তৎকালীন ভারতের পরিস্থিতি:

সেই সময় মুঘলদের অত্যাচার চরম সীমায় ছিল কারন ভারতের আকাশে অভিশাপের মত ছায়া বিস্তার করে রয়েছে ধর্মান্ধআওরঙ্গজেব। কাউকেই সে রেহাই দেয় নি। নিজের পিতাকেবন্দী করে ভাইদেরহত্যা করে সিংহাসনে বসেছে।
দারাশুক ছিলেন তার ভাই কিন্তু ছিলেন পরধর্ম সহনশীল। এই ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। তাই তাকে বন্দীকরেহত্যা করা হল। মাথাপাঠানো হল পিতা শাহজাহানের কাছে আর শরীরহাতির পিঠে চাপিয়ে সারা দিল্লী ঘুরান হল।

এহেন ধর্মান্ধআওরঙ্গজেব এখন দিল্লির মসনদে। মন দিয়ে পড়েন শান্তিরবইয়ের প্রতিটি অনুচ্ছেদ। মন দিয়ে পড়েন প্রফেটের জীবনী। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ তার চলুক প্রফেটের পদাঙ্ক অনুসরণে, এই তার ইচ্ছে।
শান্তিরবইয়ের বিবরণ অনুযায়ী থাকবে এই পৃথিবীতে একটাই ধর্ম। শান্তিরধর্ম।
বাকিসবকাফির। যাবেজাহান্নামে।
পুড়ে যাক তারা সেই নাপাকআগুনে।
এই পাপিষ্ঠদেরএইপৃথিবী থেকে নামনিশানমিটিয়ে দাও।

সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্য বিভিন্ন কৌশল বিভিন্ন নিয়ম তৈরি করা হল।
“জিজিয়া কর” স্থাপন করা হল। অর্থাৎ হিন্দুধর্ম পালন করতে গেলে কর দিতে হবে।
চালু হল “তীর্থ কর”। অর্থাৎ তীর্থস্থান ভ্রমন করতে গেলে কর দিতে হবে।
চালু হলে “ভদ্দর কর”। অর্থাৎ আত্মীয় মৃত্যুর পরে মাথা কামাতে গেলে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে গেলে দিতে হবে কর।
আরো বিভিন্ন কর স্থাপন করা হল।
মোটকথা উঠতে বসতে দাও কর।
তবে নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে।

সমস্ত পদ থেকে অমুসলিমদের সরিয়ে দিয়ে বসানো হল ধর্মান্ধমুসলিমদের। যাতে তারা ঔরঙ্গজেবের প্রতিটি নির্দেশ নির্দ্বিধায় তারা পালন করে যেতে পারে।

আনন্দপুরের দুর্গে:

আজ বেশ কয়েকদিন হল তারা কার্যত নিজেদের বন্দী করে রেখেছেন আনন্দপুর সাহিবের দূর্গে। কয়েকদিন পেরিয়েছে যুদ্ধের সবেমাত্র। আনন্দপুরের এটা প্রথম যুদ্ধ। দুইজন মুঘল সেনাপতি সৈয়দ খাঁ আর রমজান খাঁ দের পাঠায় আওরঙ্গজেব। কিন্তু দুজনেই ভয়ঙ্কর ভাবে আহত হয়ে পালিয়েছে। কোনক্রমে মুঘলদের পিঠ বেঁচেছে। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে খুব। লোকবলের, সম্পদের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়।

এদিকে ক্রমাগত লড়াই করে ক্লান্ত খালসা বাহিনী। সাহায্য চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সাহায্য এসে গিয়েছে। শিখ বাহিনী অদূরে এসে বসে রয়েছে। গুরু যেহেতু বন্দী, তাই তারা আগ বাড়িয়ে আক্রমন করতে চাইছে না।

এইরকম অবস্থায় রয়েছেন গুরু গোবিন্দ সিং। দুর্গের উপরের একটি উঁচু স্থানে তিনি আসীন। উজ্জ্বল নীল তার বস্ত্র। মাথায় পাগড়ী। তরোয়াল এখন পাশে রাখা। কোমরে কৃপান। নজর তার নীচে। সেখানে
রয়েছে মুঘল বাহিনী। শকুনের মত অপেক্ষা করছে। লক্ষ্য তাদের গুরু…

আওরঙ্গজেব ঘোষণা করেছে- যে এনে দিতে পারবে গুরু গোবিন্দ সিংকে জীবিত অথবা মৃত, সে পাবে অমূল্য পুরস্কার। সোনায় মুড়ে দেওয়া হবে তাকে। আগামী জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করে দেবে বাদশা নিজের হাতে। ধীরে ধীরে শিয়ালের দল এসে জমা হচ্ছে পুরস্কারের লোভে…

এদিকে গুরুর ভাবনায় আসছে কত কথা।
সারাটা জীবন তার কাটল যুদ্ধ করেই।
কম বয়সে হারিয়েছেন পিতাকে। সেই স্মৃতি যত মধুর ততটাই কষ্টের। মনে পড়লেই উদাস হয়ে যায় মন। কতটুকু সময় আর তিনি পেলেন তার পিতাকে। এরম যুগাবতার তার সামনে এসেও অধরা রয়ে গেলেন যে…

তখন তিনি খুবই ছোট। বাবার পাশে বসে রয়েছেন। অনেকেই আসছে দরবারে দেখা করতে। গুরু তখন বাবা তেঘ বাহাদুর। বাবা চিরকাল গরীবদের সাহায্য করেন। যেখানে যা অধর্ম হয়, অন্যায় হয় তিনি সেখানে সাহায্য পাঠান।

কাশ্মীরী হিন্দুদের উপর অত্যাচার:

তখন কাশ্মীর ছিল শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্যের চরম শিখরে। কাশ্মীরি হিন্দুদের বেশিরভাগ ছিলেন সেই সময়ের এক একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তারা ধরে রেখেছিলেন সমগ্র উত্তর ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা। সনাতনী বিদ্যার মূল পাঠাগার ছিল সেই সময়ের কাশ্মীর।
আওরঙ্গজেবের নজর পড়ল এই কাশ্মীরে। আঘাত করতে হবে এই শিক্ষার মূলে। তাই পাঠানো হল আরেক ধর্মান্ধকে প্রধান করে কাশ্মীরে। অত্যাচার শুরু হল সারা উপত্যকায়। জোর করে করে চালানো হল ধর্ম পরিবর্তন। সেই উদ্দেশ্যে কর তো ছিলই, এখন চালু হল মারধর। সারারাত উল্টো করে টাঙিয়ে রাখা। ঠান্ডা জলে চুবিয়ে রাখা। এছাড়া খুনধর্ষণতো রয়েছেই। শিশুরাও বাদ গেল নাধর্ষণ থেকে।

পিতা-পুত্র:

এরম অসহনীয় অবস্থায় একদিন কাশ্মীর ব্রাহ্মনের কয়েকজনের একটি দল এসে পৌঁছল গুরু তেঘ বাহাদুরের কাছে। দরকার সাহায্য। তখন গুরুর পাশে বসে রয়েছেন শিশু গোবিন্দ রায়। বয়স আট। বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিল। যদিও বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে আওরঙ্গজেবের অত্যাচার এর বিভিন্ন খবর নিয়ে। এসে পৌঁছলেন তারা। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পরে শুরু হল আসল সমস্যার সমাধানের খোঁজ।

তখন গুরু বললেন- এই হিন্দু জাতি মাত্র কয়েকলাখ মুঘল বাহিনীর অত্যাচার সহ্য করছে চুপচাপ। অথচ যদি এরা সম্মিলিতভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে এরা পালাতে পথ পায় না। এই ঘুমিয়ে থাকা জাতি জাগবে কবে ?
মনে হচ্ছে এই ঘুমিয়ে থাকা জাতিকে জাগাবার জন্য আরেকজন মহান মানুষের আত্মবলিদান খুবই আবশ্যক। বলি না দিলে জাগবে না এদের মন…
তখন পাশে থাকা শিশু গোবিন্দ রায় বললেন- বাবা, আপনার চেয়ে বড়, আপনার চেয়ে মহান, কে আর রয়েছে এখন এই পৃথিবীতে…?
শিশুমুখে বলা এই কথা মনে ছুঁয়ে গেল গুরুর। তিনি বললেন- ঠিক আছে। যাও তোমরা ঔরঙ্গজেবের কাছে। গিয়ে বল আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকের ধর্ম বদলানোর দরকার নেই। যদি গুরু তেঘ বাহাদুরের ধর্ম বদলাতে পারো তবে সারা শিখধর্মের লোকজন সমেত সারা কাশ্মীরের হিন্দুধর্মের লোকজন ধর্মপরিবর্তন করে নেবে। আলমগীরের কাজ সহজ হবে।

এই সংবাদ গেল দিল্লীর বাদশার কাছে। ঔরঙ্গজেব এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। মাত্র একজনকে বদলে দিতে পারলেই সারা শিখ সমাজ হাতের মুঠোয়! সাথে কাশ্মীর! এ তো দারুন সুযোগ! হাতের মুঠোয় কবে আসবে গুরু? তর সয়না আর।
তারপর হয় তরোয়াল, নয় ধর্ম।
জিন্দা পীর উপাধি প্রাপ্তি।
নেকি হাসিল করে জন্নতের পথ সুগম।
অতএব গুরুকে ডেকে পাঠান হল দিল্লি।

দিল্লীর পথে:

যাত্রা শুরু করলেন গুরু। সাথে তিনজন শিষ্য। সবাই চলেছেন দিল্লীর দিকে। দিল্লী তো নয় আওরঙ্গজেবের হাতের মুঠোয়। সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে।
আওরঙ্গজেবের কাছে খবর পৌঁছেছে। শুনে সে অবাক। এইভাবে কেউ মরনের দিকে হাসতে হাসতে আসতে পারে তা তার অজানা…

তার প্রিয় শান্তিরবই শিখিয়েছে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় তার জীবন। এই জীবন রক্ষার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। তাই জীবনেরভয়দেখাও। পরিবর্তে যা চাইবে তাই পাবে। কিন্তু শান্তিরবইয়ের এরম ব্যর্থতা চাক্ষুষ করে রাগে জ্বলে উঠছে ঔরঙ্গজেব। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে পথেই বন্দী করে সবাইকে।

প্রাণ দেব ধর্ম নয়:

ভরা সভায় সবার সামনে রাখা হল এই প্রস্তাব- হয় ধর্ম পরিবর্তন কর, নয় মর।
শিখ গুরু বললেন- ধর্ম রক্ষায় যদি জীবন যায় সেও ভালো।

চাপ সৃষ্টির জন্য একে একে গুরুর সাথীদেরকে অত্যাচার করা শুরু হল গুরুর চোখের সামনেই।
-গুরু মতিদাসকে দুই হাত দুই পা বেঁধে করাত দিয়ে কাটা হল। অল্প অল্প করে খুব ধীরে ধীরে। যাতে যন্ত্রনা দেওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মতিদাসের মুখ থেকে হাসি যাচ্ছে না। অবশেষে হাসতে হাসতেই মরনের কোলে ঢলে পড়লেন।
-এরপরে আরেক গুরুভাইকে জলভর্তি হাঁড়ির মধ্যে বসিয়ে খুব জল গরম করা হল। সেই জল গরম হলে ধীরে ধীরে সেদ্ধ হয়ে মারা গেলেন তিনি।
-আরেক গুরুভাইকে কাপড়ে জড়িয়ে আগুন দেওয়া হল। তিনিও হাসতে হাসতে মৃত্যু বরন করলেন।

আবার জিজ্ঞেস করা হল গুরু তেঘ বাহাদুরকে। গুরুর একই কথা- শির দেব, ধর্ম নয়। অবশেষে পরেরদিন (11 নভেম্বর, 1675) চাঁদনী চকে সবার সামনে গুরুকে বেঁধে রাখা হল। চলতে থাকল বিভিন্ন অত্যাচার। অবশেষে (23 নভেম্বর, 1675) মাথাকেটেফেলা হল গুরুর।
তারপর গুরুর মাথাহীন দেহ ঝুলিয়ে রাখা হল সেখানে।

এতসব করেও গুরুর ধর্মপরিবর্তন করতে পারল না আওরঙ্গজেব। হতাশা তাকে ঘিরে ধরছে। মানুষের জীবনের চেয়ে কোনকিছু তার কাছে প্রিয় হতে পারে?- বিশ্বাস করতে পারছে না আওরঙ্গজেব। কিভাবে ভুল হতে পারে শান্তিরবই? মাথায় ঢুকছে না।

পিতা নবম গুরু তেঘ বাহাদুর তার নিজেরজীবনদিয়ে রক্ষা করে গেছেন কাশ্মীর পন্ডিতদের জীবন এবং ধর্ম।
যদিও গোবিন্দ সিংহ জানেন সবই সাময়িক। এদের নতুন ছল কপটতা নতুন করে আসতে চলেছে সামনে।

পরবর্তী জীবন:


পিতার মৃত্যুর পর তিনি যখন বসেন গুরুর আসনে তখন বয়স মাত্র নয়।
29 মার্চ, 1676 সালে তিনি দশম শিখগুরু পদে আসীন হন।

দশ বছর বয়সে করেন প্রথম বিবাহ। স্ত্রী মাতা জিতো।
দ্বিতীয় বিবাহ করেন সতের বছর বয়সে। স্ত্রী মাতা সুন্দরী।
তৃতীয় বিবাহ করেন তেত্রিশ বছর বয়সে। স্ত্রী মাতা সাহিব কৌর।

তার চার সন্তান।
মাতা জিতোর তিন পুত্র যুঝর সিং, জোরাবর সিং এর ফতেহ সিং।
অজিত সিং ছিলেন মাতা সুন্দরীর পুত্র।
মাতা সাহিব কৌর এর কোন সন্তান ছিল না। তিনি ছিলেন সমগ্র খালসা বাহিনীর মাতা।।

গুরু ছিলেন খুবই শিক্ষিত। সংস্কৃত, পার্সি, আরবি এইসব ভাষা শিখেছেন। নিজের ভাষা পাঞ্জাবি ভাষায় লিখেছেন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ। বিভিন্ন উপদেশ। তার উপদেশ সমগ্র নিয়ে বই আজ বিখ্যাত হয়েছে দশম গ্রন্থ নামে। যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন দশম গুরু।

তিনি গুরু গ্রন্থসাহেব এর সংকলন পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করেন। সাথে খালসা বাহিনীর নীতি এবং অভিমুখ নিয়ে সুনির্দিস্ট নির্দেশাবলী লিখে দিয়ে যান।
এছাড়াও বিভিন্ন শাস্ত্র তিনি রচনা করেছেন।

তিনি নিজে ধর্মযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন খালসা বাহিনী। যে বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল শুধুই পীড়িতের পালন আর অন্যায়ের দমন।

খালসা বাহিনীর প্রতিষ্ঠা:

দিনটা ছিল 14 এপ্রিল সাল 1699।
বৈশাখী অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন।

আনন্দপুর সাহিবে তিনি রয়েছেন সেইদিন।
সবার সাথে বসেছিলেন ধ্যানযোগে।
ধ্যান ভাঙলে পরে তিনি বলেন এই মুহুর্তে কয়েকজনকে দরকার যারা তার গুরুর জন্য বলি দিতে চায় নিজেকে। উৎসর্গ করতে হবে নিজেদের…

হুট করে এরম প্রস্তাব শুনে উপস্থিত সবাই হতভম্ভ হয়ে যায়। শেষে অপ্রস্তুততা কাটিয়ে এগিয়ে আসেন একজন। তিনি ভাই দয়া সিং। তাকে নিয়ে গুরু ঢুকে যান তাঁবুর ভেতরে। যখন বেরিয়ে আসেন তখন তার তরোয়াল থেকে ঝরছিল তাজা রক্ত।

আবার এসে জিজ্ঞেস করেন একই কথা।
কে দিতে চায় গুরুর জন্য আত্মোৎসর্গ।
আসেন আরেকজন এগিয়ে। তিনি ভাই ধর্ম সিং। তাকে নিয়ে ঢুকে যান তাঁবুর ভেতরে।
বেরিয়ে আসেন যখন তরোয়াল রক্তে রাঙা।

আবার প্রশ্ন করেন
এইভাবে এগিয়ে আসে একের পর এক।
আরও তিনজন। তারা হলেন ভাই হিম্মত সিং, ভাই মোকাম সিং, ভাই সাহিব সিং। পাঁচজন সর্বমোট।
শেষ হয় আত্মোৎসর্গ পর্ব।

অতঃপর একটি লোহার বাটিতে জল চিনি গুলে দেন তরোয়ালের ডগা দিয়ে। অল্প করে খাইয়ে দেন পাঁচজনকে। একে একে তারা জীবন ফিরে পান।
এরপরে এই পাচঁ জনকে নিয়ে তৈরি করে ‘পঞ্চপ্যায়ারা’ অর্থাৎ প্রিয় পাঁচজন।
এই পাঁচজনই হচ্ছেন খালসা বাহিনীর প্রথম পাঁচজন।

এরপরে সবার হাত থেকে তিনি নিজে গ্রহন করেন এই অমৃত। এরপরে তিনি নিজের নবজন্ম ঘোষণা করেন নতুন নাম নেন গুরু গোবিন্দ সিং। এইভাবে গুরু গোবিন্দ রায় পরিবর্তিত হন গুরু গোবিন্দ সিং এ।
তিনি নিজে হলেন খালসা বাহিনীর ষষ্ঠ জন।

ধীরে ধীরে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক এরম শিখ যুবকদের নিয়ে তৈরি করলেন বিশাল খালসা বাহিনী। তবে শুধু যুবক নয়, যুবতীরাও পারতেন এই বাহিনীতে যোগদান করতে।

বাহিনীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:

এই বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল শিখ ধর্মের রক্ষা।
যে কোন ধরনের ঝুঁকি এরা নেবে ধর্ম রক্ষায়। তবে এই বাহিনীর পোশাকের রঙ ছিল গেরুয়া এবং নীল। তরোয়াল ছিল দুইধারী।
-সাথে সবরকম নেশা ছাড়তে হবে। মদ তো খাবেই না, এমনকি তামাক খাওয়া থাকবে নিষেধ।
-হালাল মাংস অর্থাৎ আধাগলাকেটে কষ্টকরমৃত্যু দিয়ে হত্যাকরা পশুর মাংস তারা খাবে না।
-ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়েছে এমন কারুর সাথে তারা কোনরকম সম্পর্ক রাখবে না।
-ব্যভিচার থেকে তারা থাকবে সম্পূর্ণ রূপে দূরে।
-সাথে অবশ্যই ধারণ করতে হবে পাঁচ নিশান- কেশ, কংগা, কড়া, কৃপান, কচেরা।

শুরুতে এই খালসা বাহিনীর জীবনধারার সাথে সংঘাত শুরু হয় গুরু নানক পন্থী জীবনধারার। তখন গুরু বলেন তিনি চালু করেছেন খালসা অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষায় যার মানে হচ্ছে শিষ্য। সবাই, এমনকি তিনি নিজেও গুরু নানকের শিষ্য। তাই কোনরকম ভেদাভেদের প্রশ্নই ওঠে না।

অবশেষে সমস্ত শঙ্কা সমস্ত সন্দেহ দূরে সরিয়ে সামনে আসে খালসা বাহিনী। যারা শুধু সস্ত্রে কৌশলী নয়, শাস্ত্র এবং চরিত্রের দিক দিয়ে এক উন্নত বাহিনী।

যোদ্ধাজীবন:

সারাজীবন তিনি লড়াই করেন তেরটি।
যার বেশিরভাগটাই ছিল মুঘলদের বিরুদ্ধে আর কিছু ছিল শিবালিক পর্বতের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
তার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হল
1688 সালে ভাঙ্গনানির যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়
1691 তে নদাউ এর যুদ্ধ।
1696 তে গুলের যুদ্ধ।
1700 তে আনন্দপুর এর যুদ্ধ।
1702 তে নিমগার এর যুদ্ধ
1702 তে বাসুলির যুদ্ধ
1702 তে চমকর এর প্রথম যুদ্ধ
1704 এর আনন্দপুর এর যুদ্ধ

তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল আনন্দপুর আর চমকর এর যুদ্ধ। ইতিহাস প্রসিদ্ধ battle of ananadpur and battle of chamkar। এই দুই যুদ্ধ মুঘলদের বিনাশ ডেকে এনেছিল।

আনন্দপুর এর প্রথম যুদ্ধে পরাজয় ঘটেছে মুঘলদের।

কয়েকদিন বিরতির পর আবার শুরু হয় যুদ্ধ।

আনন্দপুর-এর দ্বিতীয় যুদ্ধ:


এবারে আসে আওরঙ্গজেবের পাঠানো আরো দুই প্রধান বজির খাঁ আর জবরদস্ত খাঁ। তবে এরা আর সরাসরি যুদ্ধে যায় না।
আনন্দপুর দুর্গের নীচে তারা ঘেরাও করে বসে থাকে। দুর্গবন্দী করে দেয় গুরু গোবিন্দ সিং এবং তার শিষ্যদের পুরো পরিবারদের। দুর্গে জল ওষুধ খাবার এবং অন্যান্য জরুরি পরিষেবা পৌঁছান বন্ধ করে দেয়। এদিকে সাহায্যে আসা শিখরা ঘিরে বসে থাকে মুঘলদের ঘিরে দুর্গের অদূরে।
যেহেতু গুরু দুর্গে আটক হয়ে তাই তারা এগুতে পারছে না। দীর্ঘদিন চলে এরম অবস্থা।

দুর্গে বন্দী গুরু। ঘিরে রয়েছে সেই দুর্গ প্রায় এক লক্ষের মত শত্রু সেনা। দুর্গে তখন চলছে পরিকল্পনা কি করে এখান থেকে বেরুন যায়। ওদিক থেকে এসেছে প্রস্তাব নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। কিন্তু না। আত্মসমর্পণ এর প্রশ্নই আসেনা দরকারে সবাই দেবে প্রাণ। সম্মুখ সমরে। বীরের মৃত্যু।

সমবেত হয়েছেন আটকে থাকা সবাই।
রয়েছেন আটক হয়ে চার সন্তানের পিতা।
তার মধ্যে দুইটি বাচ্ছার বয়স ছয় আর নয়।
খুবই অল্প বয়স। রয়েছে তাদের দুই দাদা।
তাদের বয়স ওই ষোল এবং আঠের।
সবার প্রিয় ছোট বাচ্ছা দুইটি।
শেষে এক সেনানায়ক বললেন বাচ্ছার পিতাকে- আপনি আপনার চার সন্তান নিয়ে বরঞ্চ চলে যান গোপনে দুর্গ ছেড়ে। আমরা থাকছি পঁয়ত্রিশ জন। যুদ্ধটা লড়ে নেব আমরা। তার কথা শুনে সেই গুরু বললেন- শুধু এই দুটি আমার সন্তান নয়। এখানে উপস্থিত সবাই আমার সন্তান। বলি যখন হতেই হবে একসাথে হবে সবাই। সাথে হব আমিও। তবে জেনে রাখ এই যুদ্ধ হবে ন্যায় আর পাপের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ন্যায়ের জয় হবেই। তাই বলি প্রদত্ত আমরা। শেষ রক্তবিন্দু অব্দি লড়ব আমরা। জয় হবেই আমাদের…

সবাই কোমরের তরোয়াল বের করে একযোগে উচ্চারণ করল উদাত্ত কন্ঠে সেই অমোঘ পবিত্র নাম…
“বাহেগুরু জী কা খালসা
বাহেগুরু কি ফতেহ”

সম্মিলিত সেই কন্ঠের ধ্বনি পৌঁছে গেল দুর্গের বাইরে নিচে অবস্থানরত লক্ষাধিক বাহিনীর কানে। তারা তখন বসেছিল সন্ধ্যের প্রার্থনায় সেই কন্ঠের আওয়াজ এসে যখন পৌঁছল তাদের কানে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তারা বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না তাদের কান। সংখ্যায় লক্ষাধিক তারা। তাদের সম্মুখে এই কয়েকজন কিভাবে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারছে…
তবে এদের নেই বিশ্বাস, এদের এক একজন কয়েকশ জনকে দেখতে পারে। এদের রব এদের কোন ধাতুতে বানিয়েছেন রবই জানেন। এদের হাতে তরোয়াল মানে সাক্ষাৎ রব নেমেছেন ইবলিশের বিনাশে।

ওদিকে গুরু বলে চললেন- জয় হবেই। আমরাই জিতব। সংখ্যা দিয়ে যুদ্ধে জেতা যায়না। যুদ্ধে জিত হয় নিজের উপর বিশ্বাস, ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস আর তরোয়াল এর জোরে। আমাদের সব আছে। জিতব আমরাই।
সবার সাথে গলা মিলিয়ে ছোট দুটি বাচ্ছা কচি গলায় মেলাল আওয়াজ। সবার সাথে তুলে ধরল তাদের তরোয়াল। বাচ্ছা ওরা কিন্তু তরোয়াল তুলে ধরেছে অবলীলায়।
গুরু দেখলেন সবার চোখে মুখে। পড়লেন আত্মপ্রত্যয়ের ভাষা। এই জিত হবেই

আবার সকলে মিলে দিলেন হুঙ্কার-
“বাহেগুরু জী কা খালসা
বাহেগুরু কি ফতেহ”

খবর চলে গেল আওরঙ্গজেবের কাছে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন গুরু গোবিন্দ সিং…

ঔরঙ্গজেবের ছলনা:

আওরঙ্গজেব তখন নিল চালাকির সাহায্য।
বলে পাঠাল- গুরু যেন ছেড়ে চলে যান এই আনন্দপুর সাহিব নামক স্থান। এর ফলে যুদ্ধ করে অযথা সম্পদ হানি হবেনা।

এদিকে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে খালসা বাহিনী ক্লান্ত। গুরুও চাইছিলেন একটা সমঝোতা।
কিন্তু তার এতটুকু বিশ্বাস ছিলনা এদের উপর। তিনি জানতেন ধোঁকা এদের জন্মগত স্বভাব। তার পরিবারের উপর আক্রমণ করে তাকে বন্দী বানানোর চেষ্টা করবেই মুঘলরা। তখন আওরঙ্গজেব কুরানেরশপথ নিয়ে বলে তারা কোনরকম আক্রমন করবে না। গুরু এবং তার সমস্ত শিখ সহযোদ্ধারা তাদের পরিবার সমেত নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।

দিনটা ছিল ডিসেম্বর এর পাঁচ তারিখ। সালটা 1704। তখন গুরু আনন্দপুর সাহিব ছেড়ে যাবার নির্ণয় নেন। কিন্তু একটু যাবার পরেই মুঘলরা নেয় পিছু। তারা আক্রমন শুরু করে পেছন থেকে শিখদের পরিবারের উপরে পথে পড়ে সেরসা নদী।
এই নদীর ধারে হয় ভয়ানক যুদ্ধ।

দুই কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু:

এই যুদ্ধে গুরুমাতা #গুজরী এবং গুরুর দুই পুত্র সাহিবজাদা জোরাবর সিং এবং ফতেহ সিং আলাদা হয়ে পড়েন তাদের পিতা গুরু গোবিন্দ সিংয়ের থেকে। দুই ছোট শিশু ছিলেন তার ঠাকুমার সাথে। তারা ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করেন। সাপ এবং অন্যান্য হিংস্র পশুদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলে আসেন জঙ্গল পেরিয়ে। সেখানে এক লোকালয়ে যখন পৌঁছান তখন সন্ধ্যা হয়ে যায়। একটা ছোট ঝুপড়িতে তারা আশ্রয় নেন।

এই খবর শুনে গুরুজীর লংগরের এক সেবক, নাম গঙ্গু, সে চলে আসে গুরুমাতার কাছে। তাদের নিয়ে আসে নিজের ঘরে।
রাতে যখন গুরুমাতা ঘুমিয়ে ছিলেন তখন সেবা করার অছিলায় তার মোহরের থলিটি চুরি করে নেয় গঙ্গু। যদিও গুরুমাতা সব দেখেছেন, তবুও নাতিদের সুরক্ষার জন্য কিছু বলেন নি। তবে গঙ্গুর বিশ্বাসঘাতকতা এখানেই শেষ নয়। সে চলে যায় নগরের কোতয়ালের কাছে। খবর দিয়ে দেয় গুরুমাতা তার ঘরে অবস্থান করছেন।কোতয়াল সেনা পাঠিয়ে দুই শিশু আর তাদের ঠাকুমাকে করে বন্দী।

পরেরদিন নিয়ে যায় গরুর গাড়ি করে তাদের সবাইকে। ঠাকুমা বুঝতে পারছিলেন শেষ সময় আসন্ন। তিনি বাচ্চাদের তৈরি করতে শুরু করলেন। তাদের শুনিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের দাদু তেঘ বাহাদুরের ধর্ম রক্ষায় জীবনদানের কাহিনী। শোনালেন গুরু নানকের জীবনী ও উদ্দেশ্য।

সেদিন রাতে তাদের রাখা হল সিরহিন্দের খোলা দুর্গে। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় তাদের জন্য বরাদ্দ হল দুর্গের উপরের খোলা জায়গা। সারারাতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস সেদিন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তাদের শরীর, কিন্তু মনের জোর তারা হারান নি।

পরেরদিন তাদের নিয়ে যাওয়া হল বজির খাঁ এর দরবারে। সেখানে পৌঁছে দুই শিশু ঘোষণা করল-
বাহেগুরু জী কা খালসা
বাহেগুরু কি ফতে।
এই ঘোষনা শুনে চুপচাপ রইল বজির খাঁ। শেষে মিষ্টি স্বরে বলল- ইসলাম কবুল করে নাও। তোমরা যা চাও তাই পাবে।
প্রত্যুত্তর পেল- আমার ধর্ম আমার কাছে।

শুনে কাজী আর নবাব দুজনেই খুব ক্ষেপে গেল।

তখন দেওয়ান বলল- তোমাদের মুক্ত করলে তোমরা এখন যাবে কোথায়?
বাচ্ছারা বলল- যাব ফিরে, তবে আসব আবার। অন্যান্য শিখদের সাথে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে। তখন লড়াই হবে মুখোমুখি। দেখব, তখন কে জেতে…

শুনে রাগে চিৎকার করে উঠল নবাব- এরা বাগীর সন্তান। এদের জন্য মৃত্যুই একমাত্র শাস্তি। (বাগী অর্থাৎ বিদ্রোহী)।
কাজী তখন এক ফতোয়া জারি করল- এদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল।

এরপরে বাচ্চাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল ঠাকুমার কাছে। সেখানে তারা তাদের ঠাকুমাকে শোনাল তাদের মৃত্যুদণ্ড আদেশের কথা।

পরেরদিন তাদের নিয়ে আসা হল দরবারে।
আবার জিজ্ঞেস করা হল। কি তাদের ইচ্ছে?
একই উত্তর এল- ধর্ম প্রিয়। বদলানোর প্রশ্ন উঠছেই না।

জীবন্ত কবর:


দিল্লী থেকে এসে পৌঁছেছে দুই জল্লাদ।
তারা দুই শিশুর চারপাশে তৈরি করতে শুরু করল দেওয়াল। দুই জল্লাদ মিলে শিশুদের বোঝাতে শুরু করল- ধর্ম পরিবর্তন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এতে কোন ক্ষতি কেন, কিছু হবেনা। তারা দ্রুত তাদের ঠাকুমা, তাদের পিতার কাছে ফিরে যেতে পারবে।

কিন্তু শিশুদের উত্তর- যা করছো কর তাড়াতাড়ি। যত দ্রুত করবে তত দ্রুত মুঘলদের পাপের ঘড়া পূরণ হবে।
এরপরে তারা পাঠ করতে শুরু করতে গুরু গ্রন্থসাহেব।
ওদিকে দেওয়াল উঠছে তাদের চোখের সামনে একটু একটু করে। দেওয়াল তাদের কোমর অব্দি উঠলে পরে কাজী আর নবাব জিজ্ঞেস করল আবার- ধর্ম পরিবর্তন করতে চায় কিনা…
তখন শিশুদের উত্তর এল- আমাদের দাদু মাথা দিয়েছেন কিন্তু ধর্ম দেননি। তাই আমরাও প্রান দেব, ধর্ম নয়। এখন আনন্দিত আমরা। আমরাও যাচ্ছি যে তার কাছেই।

ধীরে ধীরে তাদের মাথা অব্দি দেওয়াল উঠে গেল। তখন বেহুঁশ হয়ে পড়ল দুই ভাই।
শেষে দেওয়াল ভেঙে দুই শিশুর বেহুঁশ দেহ বের করে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হল।

হত্যার খবর গেল তাদের ঠাকুমার কাছে। ভয়ানক সেই শোকের খবর আর ধরে রাখতে পারল না ঠাকুমার শরীর। ছেড়ে দিল প্রাণপাখি। মারা গেলেন গুরুমাতা #গুজরী।

চমকর-এর দ্বিতীয় যুদ্ধ:

যুদ্ধ লড়তে লড়তে নদী পেরিয়ে গুরু পৌঁছন চমকর। সেদিন ছিল 20 ডিসেম্বর। ভাই বুধী চাঁদ দেখা করতে আসেন তার গুরুর সাথে। তারপর নিজের হাভেলিদুর্গতে জানান নিমন্ত্রণ। গুরু তার চল্লিশ শিষ্য নিয়ে প্রবেশ করেন তার হাভেলিদুর্গে।

তখন আওরঙ্গজেবের নির্দেশ দেয় এলাকার নবাব বজির খাঁ’কে, গুরু গোবিন্দ সিংকে বন্দী করার। বজির খাঁ লাখ সৈন্য নিয়ে হাভেলি দুর্গ ঘিরে ধরে। এরপরে দূত পাঠায় হাভেলিতে। ঘোষণা করে- গুরু গোবিন্দ সিং, যদি তোমরা সবাই আত্মসমর্পণ কর তাহলে আমি তোমাদের প্রাণভিক্ষা দেব।
এই জবাবের উত্তরে গুরু গোছা গোছা তির ছুঁড়ে দেন নীচে শত্রু সেনার দিকে। এটাই ছিল তার অসম্মতি জানানোর রীতি। তারপর দূতকে তাড়িয়ে দেন।

জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু:


ভোরের সূর্য্যের প্রকাশ আসতে শুরু করেছে পূব আকাশে। গুরু গোবিন্দ সিং এর বড় ছেলে অজিত সিং এগিয়ে এলেন। বললেন তিনি যুদ্ধ শুরু করতে চান। গুরু তাকে দেন একটি তরোয়াল। খুব কাছ থেকে তার মুখ তুলে দেখলেন। ভোরের আলো তখন ফুটছে সবেমাত্র। লালচে আলোয় তাকিয়ে দেখলেন তার পুত্রের মায়াময় মুখমণ্ডল। এখনো গোঁফ দাঁড়ির প্রকাশ আসেনি। মুখে শুধু বললেন- তুমিই যা চাইছো তাই হোক।

আলো ফুটছে। বজির খাঁ এর বাহিনী চমকর দুর্গের দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে। ঘিরে ধরছে তারা সমগ্র দুর্গ। আর দেরি করলেন না গুরু। তৈরি করে নিলেন নিজের ছেলেকে। সাথে রয়েছেন আরো সাত জন খালসা। এবং পঞ্জপেয়ারের পাঁচ জনের একজন ভাই মনকাম সিং জী।
মনকাম সিং জী এবং বাবা অজিত সিং এর নেতৃত্বে ভয়ানক লড়াই চলল। মুঘলদের কয়েক হাজার ছিল সেদিকে। কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের সংখ্যা হয়ে গেল অর্ধেক। লড়াই করতে করতে তরোয়াল পড়ে যেতে হাতে নিচ্ছে কৃপান। কখনো ছোরা। কখনো বর্শা। সবে মিলে তারা অপ্রতিরোধ্য। উপর থেকে বর্শা তির ছুঁড়ে সাহায্য করে যাচ্ছেন বাকীরা। প্রায় কয়েক হাজার মুঘল মরল। এরপরে এল আরো সেনা। তারা ঘিরে ধরল বাবা অজিত সিংকে। সামনে থেকে যুদ্ধে না পেরে শেষে পেছন থেকে তারা কয়েকজন মিলে আক্রমণ করে খুন করল তারা অজিত সিংকে। প্রাসাদের উপর থেকে দেখছেন সব গুরু। পুত্রের মৃত্যুর মুহুর্তে তার গলা চিরে বেরিয়ে এল- সৎ শ্রী অকাল।

দ্বিতীয় পুত্রের মৃত্যু:


এরপরে এগিয়ে এলেন তার অপর পুত্র বাবা যুঝর সিং জী। সাথে এলেন আরো দুইজন পঞ্জপেয়ারে। ভাই হিম্মত সিং জী, ভাই সাহিব সিং জী। আশীর্বাদ দিলেন তাদের গুরু। একযোগে তারা নামলেন যুদ্ধে। মুঘলরা দেখে অবাক হল। অজিত সিং কি করে ফিরে এল। দেখতে হুবহু একই। একই তরোয়াল চালানো।
এক হাতে তরোয়াল এক হাতে কৃপান নিয়ে শুরু করলেন এক অসম্ভব যুদ্ধ। তারাও সম্মিলিতভাবে শেষ করলেন বেশ কয়েক হাজার মুঘল। উপর থেকে সহায়তা করে যাচ্ছেন বাকী বাহিনী। অবশেষে মারা গেলেন একে একে তারা সবাই।
সবশেষে মারা গেলেন যুঝর সিং। পিতা সব দেখলেন। পুত্র মারা যেতে নিলেন সেই একই নাম- সৎ শ্রী অকাল।

অধরা গুরু:

এরপরে আর দেরি করলেন না গুরু গোবিন্দ সিং। তিনি সেখান থেকে পেছনের দরজা দিয়ে দুগ ছেড়ে চলে গেলেন বাকি সেনাদের সাথে।
চারদিকে বিছানো রয়েছে মুঘলদের লাশ। লক্ষাধিক বাহিনীর বেশিরভাগ এখন মৃত। লাশের পর লাশ পেরিয়ে পেরিয়ে মুঘলরা সবশেষে যখন দখল নিল দুর্গ হাভেলির তখন তারাও প্রায় শেষ। যে কয়জন পৌঁছল তাদের বেশিরভাগ আহত। প্রচুর অর্থ খরচ করেছে আওরঙ্গজেব। লাখো লাখো লোকবল ক্ষয় হয়েছে। প্রচুর লোকজনের সাথে শত্রুতা হয়ে গেছে। তবুও সব গেল বৃথা। ধরা পড়লেন না গুরু।

এই হত্যার খবর ছড়িয়ে গেল সারা দেশে বিদেশে। জাগিয়ে তুলল সমস্ত বিদ্রোহী হিন্দু রাজাদের। সবাই মুঘলদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে গেল।
এদিকে প্রতিশোধের জ্বালায় জ্বালিয়ে দিতে লাগলো শিখদের। বান্দা বাহাদুর শপথ নিলেন- বজির খাঁ এর প্রাণ তার চাই ই চাই…

জাফরনামা:


মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেবের কুরানেরশপথ নিয়ে করা অঙ্গীকার, উপাস্য আল্লারনামে করা অঙ্গীকার সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে আক্রমনকরেছে গুরুর পরিবারের উপর। অসহায় অবস্থায় খুন করেছে দুই শিশুকে। এইসব কিছু মনে করিয়ে গুরু এক চিঠি লিখে পাঠান বাদশার কাছে। সেটি হল জাফরনামা।
যার মূল বিষয় ছিল এরকম-
কথার খেলাপ করলে। ধোঁকা দিয়ে পরিবারকে খুন করলে। একলক্ষ লোক পাঠিয়ে দিলে চল্লিশ জনকে ধরার উদ্দেশ্যে। এটা কি আদৌ কোন যুদ্ধ ছিল?
কিন্তু তাও দেখ আমায় কই ধরতে পারলে…
আমি সেই অধরা রয়ে গেলাম। ঈশ্বরের প্রিয় আমি। তাই দেখ সব তোমার সব আজ ধংসের মুখে। তোমার অহংকার তোমার ধর্ম আজ শেষেরদিন গুনছে।

শেষ যুদ্ধ:

এরপরে 1705 সালে হয় যুদ্ধ মুক্তেসরের।
এটাই গুরুর জীবনের শেষ যুদ্ধ।

বজির খাঁ এর খোঁজ চলে দীর্ঘদিন।
অবশেষে শুরু যুদ্ধের পরিস্থিতি।
এই যুদ্ধের ঠিক আগের ঘটনা। ভাই মহা সিং তার চল্লিশজন সাথী নিয়ে গুরুসঙ্গ ত্যাগ করে চলে যান। পথে ঝবল নামে এক গ্রাম পড়ে, সেখানে তারা বিশ্রাম নেন।
মাই ভাগো নামে এক শিখ মহিলা তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে অনুপ্রাণিত করেন।
তারা সবাই ফিরে আসেন যুদ্ধে। যুদ্ধের শেষে একরকম পালিয়ে বাঁচে মুঘলরা।
তখন গুরু আসেন মহা সিং এর খোঁজে।
দেখেন খুব আহত অবস্থায়, মৃতপ্রায় তখন সে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন গুরু।

মাই ভাগো যুদ্ধে লড়াই করেও বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি বাকী জীবন থাকেন গুরুর অন্যতম একজন দেহরক্ষী হয়ে।

শেষের কয়েকদিন:

1707 সালে মারা গেল আওরঙ্গজেব।
তখন তার ছেলেদের মধ্যে সিংহাসনের দাবী নিয়ে লড়াই হয় শুরু। বাহাদুর শাহ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় গুরুর দিকে।

এদিকে বজির খাঁ এর জীবন নরকপ্রায়।
মৃত্যুভয় তাড়া করছে তাকে।
সমস্ত শিখ বাহিনী তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
পালিয়ে পালিয়ে হতাশ হয়ে নিয়োগ করে দুইজন ভাড়াটে খুনী। জামসেদ খাঁ আর ওয়াসিল বেগ। তারা ধোঁকা দিয়ে খুন করার চেষ্টা করে গুরুকে। কিন্তু গুরু নিহত না হয়ে আহত হন। আহত অবস্থায় একজনকে হত্যা করেন গুরু নিজের হাতে, আরেকজন খুন হয় তার দেহরক্ষীদের হাতে।

এই ঘটনার সাতদিন পরে মারা যান গুরু গোবিন্দ সিং। দিনটা 1708 সালের 7 অক্টোবর। মাত্র 41বছর বয়সে তার দেহান্ত হয়।

তার মৃত্যু নতুন করে ইন্ধন যোগাল মুঘলদের সাথে শিখদের শত্রুতার। চলল দীর্ঘদিন। যতদিন না পুরোপুরি শেষ হল মুঘলরা।

তিনিই ছিলেন শেষ গুরু। এরপরে শিখদের গুরু হলেন গুরু গ্রন্থসাহেব। এই বইয়ের লিখিত বাণী অনুযায়ী এখনও চলে শিখদের জীবনযাত্রা।

…………………………
এই ছিল গুরু গোবিন্দ সিং এবং তার চার পুত্র তথা চার সাহিবজাদার কাহিনী।
কাহিনী বলাটা কি ঠিক হল??
ঘটনাটা তো বাস্তব সত্য। দিনের আলোর মত।
একদিন তারাও ছিলেন। এই পৃথিবীর মাটিতেই ছিলেন। এই পুণ্য ভারত ভূমিতে তারাও বিচরণ করেছেন। কিন্তু তারা বেচেঁছিলেন শিরদাঁড়া সোজা করে। মাথা উঁচু করে।

গুরু ধর্মরক্ষা করেছেন নিজের সাথে সবার। এমনকি কোন মুসলিম সাহায্য চাইলে তাও তিনি করেছেন। তাই তো মুঘলদের বিরুদ্ধে এত যুদ্ধ করেও কখনো কোন মুসলিম মহিলার সম্মানহানি করেননি। না করতে দিয়েছেন।
কখনো মুসলিমদের কোন পুণ্যস্থান ভাঙেন নি। না ভাঙতে দিয়েছেন।

কিন্তু নিজের অধিকার রক্ষার বেপারে ছিলেন সচেতন। ধর্মরক্ষা কিভাবে করতে হয় তিনি জানতেন। তাই তিনি বানিয়েছেন খালসার মত এক শক্তিশালী দল যারা ছিল চরিত্রের দিক দিয়ে উন্নত। ধর্ম রক্ষায় নিবেদিত প্রান এক সাহসী যোদ্ধাদল।
এক শিক্ষিত সংস্কারি গুরু তিনি।
সারাটা জীবন ধরে তিনি প্রমান দিয়ে গেছেন এক আদর্শ গুরুর জীবন ঠিক কিরকম হওয়া উচিৎ।

তথ্য সংগ্রহ:
ইন্টারনেট