© অমিত মালী
মহীশুরের তথাকথিত শাসক তথা টিপু সুলতান ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। আজও অনেকেই তাঁর বীরত্ব গাঁথা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেন। তাদের সেই প্রচারের গুঁতোয় টিপু সুলতান সাধারণের চোখে হয়ে উঠেছেন অজেয়, পরাক্রমী। কিন্তু এই টিপু সুলতান ও তাঁর বাহিনীকে কর্ণাটকের একটি যোদ্ধা সম্প্রদায় এক-দুইবার নয়, ৩১ বার যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের সেক্যুলার এবং চাটুকার ঐতিহাসিকরা টিপু সুলতানকে নিয়ে অনেক বই লিখলেও কোড়ভা যোদ্ধাদের জন্য একটি পৃষ্ঠাও খরচ করেননি। আসুন জেনে নিই সেই গৌরবময় ইতিহাস, যা এতদিন উপেক্ষিত রয়েছে।
কোড়ভা সম্প্রদায় বসবাস করতেন কর্ণাটকের কোডাগু(বর্তমান কুর্গ) জেলায়। এই কোড়ভা সম্প্রদায় পরম্পরাগতভাবে যোদ্ধাজাতি এবং ক্ষত্রিয়। এরা কর্ণাটকের মুলনিবাসী এবং এরা কোড়বত্তক ভাষায় কথা বলেন। এরা প্রকৃতির উপাসক হলেও অস্ত্র চালনা এবং যুদ্ধ কৌশল অনুশীলন এদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর এই কারণে কোড়ভা(Kodava) এমন একটি সম্প্রদায়, যাদেরকে বিনা লাইসেন্সে বন্দুক রাখার অনুমতি রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই বীর সেনা প্রধান থিমাইয়া এবং কারিয়াপ্পা এই কোড়ভা সম্প্রদায়ের মানুষ এমন যোদ্ধা জাতি কোড়ভা সৈন্যরা টিপু সুলতানের বিশাল বাহিনীকে ৩১ বার পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস ইসলামিক আক্রমণকারীর বংশধর টিপু সুলতানকে গৌরবান্বিত করলেও উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে বীর কোড়ভা যোদ্ধাদের গৌরবময় ইতিহাস।
টিপু সুলতানের পিতা হায়দার আলীর শাসনের সময়কাল থেকেই সুলতানি সেনাদের সঙ্গে একাধিক লড়াই হয়েছে কোড়ভা যোদ্ধাদের। কিন্তু বারবার সুলতানি সেনাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছেন কোড়ভা যোদ্ধারা।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালোর দখলের উদ্দেশ্যে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওয়ানা দেন হায়দার আলী। কিন্তু ম্যাঙ্গালোরের পূর্বে কোড়ভা যোদ্ধাদের মুখোমুখি হয় হায়দার আলীর বাহিনী। মাত্র কয়েক হাজার কোড়ভা যোদ্ধা টিপু সুলতানের বাহিনীকে জঙ্গলের মধ্যে পরাজিত করেন। বিশেষত, জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ, অতর্কিতে আক্রমণে হায়দার আলীর বাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হয়। ম্যাঙ্গালোর না জয় করেই ফিরে আসতে হয় হায়দার আলীকে।
এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে লিঙ্গরাজ নামে একজন বীর যোদ্ধা হায়দার আলীর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। তিনি দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কোডাগু রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে লিঙ্গরাজের মৃত্যু হয়। এর ফলে কোডাগু রাজ্য নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। লিঙ্গরাজের নাবালক পুত্রের পক্ষে রাজ্যের শাসনভার সামলানো সম্ভব ছিল না। এই সুযোগে হায়দার আলী কোডাগু রাজ্য দখল করে নেন। কিন্তু সেই দখল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
কয়েকমাসের মধ্যেই স্বাধীনচেতা কোড়ভা যোদ্ধারা মহীশুরের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোডাগুতে থাকা হায়দার আলীর কয়েক হাজার সেনাকে পরাজিত করেন কোড়ভা যোদ্ধারা। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে কোডাগু রাজ্য নিজেদেরকে স্বাধীন ঘোষণা করে।
ওই বছরের অর্থাৎ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু সুলতান মহীশুরের শাসক হন। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই একমাত্র স্বাধীন রাজ্য কোডাগু বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন টিপু সুলতান। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিশাল বাহিনী নিয়ে কোডাগুতে অভিযান করেন টিপু সুলতান। কিন্তু বীর কোড়ভা যোদ্ধারা টিপু সুলতানের বাহিনীকে পরাজিত করেন। শুধু তাই নয়, কোড়ভা যোদ্ধারা রাজ্যের সীমানা থেকে টিপু সুলতানের বাহিনীকে তাড়িয়ে দেন।
কয়েকমাস পর ফের কোডাগু অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন টিপু সুলতান। অশ্বারোহী বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্য মিলিয়ে প্রায় ১৫, ০০০ সেনা কোডাগুতে হামলা চালায়। টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় ৪,০০০ কোড়ভা যোদ্ধা। উলালগুল্লির যুদ্ধে কোড়ভা যোদ্ধারা টিপু সুলতানের বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এর পরেও বেশ কয়েকবার সেনা অভিযান পরিচালনা করেন টিপু সুলতান। কিন্তু প্রত্যেকবার পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে হয় টিপু সুলতানের সেনাবাহিনীকে।
এর পরই প্রতারণার আশ্রয় নেন টিপু সুলতান। মহীশুরের তরফে শান্তি প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবে বিশ্বাস করে সম্মতি জানায় কোডাগু রাজ্যের রাজা। শান্তি প্রস্তাব বৈঠকের নামে মহীশুরে আসা কোডাগু রাজ্যের রাজাকে হত্যা করে টিপু সুলতানের বাহিনী। তারপরই কোডাগু রাজ্য আক্রমণ করে টিপু। মন্দির ধ্বংস করা, নৃশংস হত্যালীলা, মহিলাদের ধর্ষণ কিছুই বাদ রাখেনি টিপু সুলতানের সেনাবাহিনী। শস্য ভরা জমি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়ার পাশাপাশি মূল্যবান সম্পদ লুট করে টিপুর বাহিনী। বহু কোড়ভা মহিলাকে তাদের সন্তানসহ বন্দি বানিয়ে মহীশুরে নিয়ে আসে টিপু সুলতানের বাহিনী। তাদেরকে জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
এই ঘটনার পরেও দমেননি বীর কোড়ভা যোদ্ধারা। যারা পালিয়ে বেঁচেছিলেন, তাঁরা পাহাড় ও জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে পুনরায় লড়াইয়ের সংকল্প নেন। জঙ্গলে থেকেই কোড়ভা যোদ্ধারা টিপু সুলতানের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। এইভাবে কয়েক বছর লড়াইয়ের পর একসময় নিজেদের রাজ্যে ফিরে পান কোড়ভা যোদ্ধারা।
আজ বর্তমান সময়ে অনেক ঐতিহাসিক টিপু সুলতানকে মহান এবং পরাক্রমী শাসক হিসেবে বর্ণনা করলেও বেমালুম ভুলে যান কোড়ভা যোদ্ধাদের হাতে টিপুর পরাজিত হওয়ার কথা। ভুলে যান বিধর্মী প্রজাদের প্রতি টিপু সুলতানের নিষ্ঠুরতার কথা। তবে আজও টিপু সুলতানের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক মন্দির। সেই সব মন্দিরে টিপু সুলতানের বর্বরতার চিহ্ন বিদ্যমান।
তারপরেও ভারতের ইতিহাস সেক্যুলার হতে গিয়ে ভুলে গিয়েছে বীর কোড়ভা যোদ্ধাদের। অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে বীর কোড়ভা যোদ্ধাদের গৌরবময় লড়াইয়ের কথা। আসুন, সেই সব বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করি শ্রদ্ধায়।
( Credits: The information in the above article is based on the above YouTube video. Please watch the video for more reference. )