© সংগ্রাম দত্ত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট ব্লকের নিকটে ক্ষীরগ্রাম নামক গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির।
যোগাদ্যা বাংলার এক লৌকিক দেবতা ও ৫১ পীঠের এক পীঠের দেবী। এছাড়া হুগলীর প্রধান গ্রামদেবতা ষণ্ডেশ্বর জীউ-এর মন্দির চত্বরের মূল মন্দিরের উত্তর দিকে ও একটি যোগাদ্যা দুর্গামন্দির রয়েছে।
প্রাচীন কাল থেকেই মঙ্গলকোটের এই ক্ষীরগ্রাম বিখ্যাত এক জনপদ। এক সময় এই জনপদের দেবী যোগাদ্যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে। আজও জেলার অন্তত ৫০টি গ্রামে দেবী পুজোর প্রচলন থাকলেও ক্ষীরগ্রামই দেবীর উদ্ভবস্থলের মর্যাদা পেয়েছে।
কথিত আছে, ক্ষীরগ্রাম দেবীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। কিন্তু প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনও ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। এবং সম্ভবত তাঁরই আদেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটি অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। কেবল ৩১ বৈশাখ তা জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত। এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে গেল অলৌকিক এক কাণ্ড। অন্তত গ্রামের মানুষ এই ঘটনাকে অলৌকিক বলেই দাবি করেছেন।
তিন বছর আগে, ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে এল ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে গ্রামের মানুষ গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল ফিরে পাওয়া দেবী-মূর্তি। ফলে বহিরাগতরা এখন গ্রামে গেলেই দর্শন পান দেবীর। তবে সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।
ক্ষীরগ্রামে পুরনো যোগাদ্যা মন্দিরে তোরণদ্বারের স্থাপত্য দর্শকদের বিশেষ নজর টানে। জানা গিয়েছে, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। মিলেছে বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী জানিয়েছেন, এই জনপদে অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি মিলেছে। তবে তাঁর মতে, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র। কবির লিখিত কাহিনিটি ছিল এ রকম, মহীরাবণ রাম-লক্ষ্মণকে বেঁধে পতালে নিয়ে গিয়েছেন। সেখানে দেবীর সামনে তাঁদের বলির ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু হনুমান মাছির রূপ ধরে রাম-লক্ষ্মণের পরিচয় জানিয়ে দেন দেবীকে। দেবী তখন হনুমানকে বুদ্ধি দেন, রামকে বলি দেওয়ার আগে মহীরাবণ যখন দেবীকে প্রণাম করতে বলবেন, রাম যেন তখন তাঁকে বলেন, তিনি প্রণাম করতে জানেন না। মহীরাবণ হেঁট হয়ে দেবীকে প্রণাম করতে গেলেই খাঁড়া দিয়ে তাঁর মাথা কেটে ফেলতে হবে। এমনটাই করেছিলেন রামচন্দ্র।
এমন অনেক অলৌকিক কাহিনি, দেবীর নানা রূপ ধরে ভক্তদের আশীর্বাদ করার গল্প ছড়িয়ে রয়েছে ক্ষীরগ্রামের আকাশে-বাতাসে। জাগ্রত এই দেবীর আশীর্বাদ পেতে আজও তাই বৈশাখ সংক্রান্তিতে ভক্ত সমাগমের বিরাম নেই। তবে আসল উৎসব শুরু হয় ২৭ বৈশাখ থেকেই। সেদিন থেকেই শুরু হয় দেবীর সামনে রামায়ণ গান। দেবীর বন্দনা গান হবে সমাপ্তি অনুষ্ঠানে। মন্দির প্রাঙ্গণে বিক্রি হয় ‘যোগাদ্যা বন্দনা’ পুঁথি। বহু দূর থেকেও দেবীর টানে মানুষ ভিড় করেন ক্ষীরগ্রামে। তাঁদের সুবিধায় মন্দির চত্বরে যাত্রী নিবাসের ব্যবস্থাও করেছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ছবি ও তথ্য -উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সেন্ট্রাল গভমেন্টের প্রতিষ্ঠান সি এফ এস এল-এর সহকারি পরিচালক সোমা রায়।)