নোয়াখালীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী বারাহী



Updated: 08 March, 2023 2:16 pm IST

© শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী

বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ‘ভুলুয়া’। রাজ্যটি তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের একটি সামন্ত রাজ্য ছিল। এ ভুলুয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মিথিলা নিবাসী শূরবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বম্ভর শূর বা বিশ্বাম্বর শূর। মিথিলানিবাসী আদিশূরের নবম পুত্র হলেন রাজা বিশ্বম্ভর শূর। মতান্তরে কারো কারো মতে আদিশূরের অধস্তন নবম পুরুষ, কারও কারও মতে ১১শ কিংবা ১৫শ পুরুষ বিশ্বম্ভর শূর। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কুতুবুদ্দিনের সেনানী বখতিয়ার খিলজী মগধ ও গৌড়ের কিছু অঞ্চল জয় করেন। এর পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় ১৪শ শতকের মধ্যভাগে মুহাম্মদ তুঘলক মিথিলা আক্রমণ করে।

তখন বিশ্বম্ভর শূর সদলবলে এদিকে চলে আসেন এবং ‘ভুলুয়া’ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ভুলুয়া তখন ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনস্থ একটি সামন্ত রাজ্য। বিশ্বম্ভরের পরে ভুলুয়ার রাজা হন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গণপতি রায় । লক্ষ্মণমাণিক্য বিশ্বম্ভর শূরের অধস্তন অষ্টম পুরুষ। বিশ্বম্ভর শূর দু’শত জলযান, বহু পরিবার ও সৈন্যসামন্তসহ পূর্বাভিমুখে এসে চন্দ্রনাথ পর্বতে শিবদর্শনে উপস্থিত হন। চন্দ্রনাথ পর্বত বর্তমান চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত । চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শন শেষে প্রত্যাগমন কালে তাঁর সঙ্গীগণসহ ভুলুয়ার নিকটবর্তী মেঘনার বুকে নৌকায় বিশ্বম্ভর শূর রাত্রিযাপন করেন। রাত্রিকালে তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়ার অষ্ট মাতৃকার অন্যতম দেবী বারাহীর স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হন।সামন্ত রাজ্যটির প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্যারীমোহন সেন তাঁর নোয়াখালীর ইতিহাস গ্রন্থে বলেন-রাজা বিশ্বম্ভর শূর চট্টগ্রামের ‘চন্দ্রশেখর’ তীর্থ দর্শন শেষে প্রত্যাবর্তনকালে নাবিকদের দিকভ্রমে একটি চরে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি নিদ্রাকালে দেবী বারাহী কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হন। স্বপ্নে বিশ্বম্ভর শূরকে দেবী বলেন:

‘আমি বারাহী দেবী তোমার অর্ণবযানের দক্ষিণপার্শ্বে আছি, তুমি আমাকে উত্তোলন করিয়া পূজা কর। তুমি যে এখন বিস্তীর্ণ সমুদ্র দেখিতেছ, ক্রমে ইহা ভূমিখণ্ডরূপে পরিণত হইবে। ইহাতে তুমি ও তোমার বংশধরগণ সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত একাধিপত্যে রাজত্ব করিবে এবং অষ্টম পুরুষের রাজত্বকালে এই রাজ্যের সীমা সঙ্কুচিত হইবে; ১৫শ পুরুষ পর্যন্ত ইহার খণ্ডাংশে রাজত্ব করিলে, তোমার বংশধরগণ রাজ্যহীন হইবে।’
(প্যারীমোহন সেন, ১৯০৭: পৃ.১৫)

কিংবদন্তী অনুসারে ৬১০ বঙ্গাব্দের ১০ই মাঘ রাজা বিশ্বম্ভর শূরকে আদ্যাশক্তি মহামায়া বারাহী রূপে রাজাকে স্বপ্নাদেশ প্রদান করেন। সে স্বপ্নাদেশ অনুসারে রাজা দেবী বিগ্রহকে মাটি থেকে উত্তোলন করেন। পরে ছাগাদি পশুবলিসহ বিবিধ প্রকারের উপাচারে দেবীর পুজা করে দেবীবিগ্রহটিকে স্থাপন করেন। তবে সেদিন আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় তিনি দিকভুলে দেবীকে পূর্বমুখী করে স্থাপন করে পূজা করেন। কিন্তু এর পরবর্তীতে সূর্যের উদয়ে যখন দিকমণ্ডল আলোকিত হয়ে যায়, তখন বুঝতে পারেন যে দেবীকে ভুল দিকে স্থাপন করেছেন। সাধারণত দেবী বিগ্রহ উত্তর দিকে স্থাপন করতে হয়। দিনের আলোতে সকলেই যখন বুঝতে পারলো যে ভুল হয়েছে। তখন রাজাসহ সকলেই সমস্বরে বলে উঠলেন যে, ‘ভুল হুয়া’। সে থেকেই রাজা বিশ্বম্ভর শূরের নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নাম হয় ভুলুয়া।

ভুলুয়াতে বারাহী দেবীর প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীকৈলাশচন্দ্র সিংহের মাধ্যমে জানা যায় যে, রাজা বিশ্বম্ভর শূর ভুলুয়া আসার পূর্ব থেকেই বারাহী মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন।

‘আমরা পূর্বে বলিয়াছি যে, সূক্ষ্মদেশ বা প্রাচীন ত্রিপুরা অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ভুলুয়া তাহার অন্যতম। প্রবাদ অনুসারে গৌড়ের প্রাতঃস্মরণীয় নরপতি আদিশূরের বংশধর বিশ্বম্ভর শূর এই রাজ্যের স্থাপনকর্তা। মতান্তরে ‘আদিশূরের বংশধর বিশ্বম্ভর শূর মিথিলা প্রদেশ শাসন করিতেছিলেন। ৬১০ বঙ্গাব্দে রাজা বিশ্বম্ভর চন্দ্রনাথ দর্শন মানসে পোতারোহণে গমন করিতেছিলেন। ঘটনাক্রমে রাস্তারোহিগণের দিগভ্রম জন্মে, ক্ৰমে অষ্টাহ ইতস্তত নৌসঞ্চালনের পর তাঁহারা একটী ক্ষুদ্র দ্বীপ দর্শন করেন।

নৃপতি বারাহী মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন, দেবী তৎকালে আবির্ভূতা হইয়া তাহাকে বলিলেন— বৎস! এই দ্বীপে তুমি আমাকে স্থাপন কর । এই ক্ষুদ্র দ্বীপ একটি বৃহৎ রাজ্যে পরিণত হইবে এবং তুমি এই রাজ্যের অধিপতি হইবে। এই রাজ্য ভুলুয়া নামে খ্যাত হইবে। তোমা হইতে অধস্তন সাত পুরুষ ক্রমান্বয়ে এই রাজ্যে একাধিপত্য করিবেন। অষ্টম পুরুষে তোমার এই বিস্তৃতরাজ্যের সীমারেখা সঙ্কুচিত হইবে। পঞ্চদশ পুরুষে তোমার বংশধরগণ হৃত রাজ্য হইবেন।

দেবীর আদেশ অনুসারে বিশ্বম্ভর সেই স্থানে বারাহী দেবীর প্রস্তর মূর্ত্তি সংস্থাপন পূর্বক ৬১০ বঙ্গাবদের ১০ মাস ভুলুয়া রাজ্যের রাজদণ্ড ধারণ করেন। প্রচলিত ও লিখিত প্রবাদ বাক্য হইতে যে সময় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

তাহা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ কি না তৎপক্ষে আমাদের সন্দেহ আছে, কিন্তু বখতিয়ার খিলজী কিম্বা তাঁহার অনুচরগণ দ্বারা তাড়িত হইয়া যে শুর বংশীয় বিশ্বম্ভর ভুলুয়ার উপনীত হইয়াছিলেন এরূপ অনুমান অসঙ্গত নহে।’

(শ্রীকৈলাশচন্দ্র সিংহ, ২০০৯: পৃ. ২২৫)

রাজা বিশ্বম্ভর শূরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ লক্ষ্মণমাণিক্য। তিনি ১৬০৫ বা মতান্তরে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভুলুয়া রাজ্যের অধিশ্বর ছিলেন। তাঁর মন্ত্রী বা সভাকবি ছিলেন রঘুনাথ কবিতার্কিক। তাঁর লেখা একটি প্রহসন গ্রন্থ হলো ‘কৌতুকরত্নাকর’। গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। সে গ্রন্থেও বলা হয়েছে- রাজধানী ভুলুয়া নগর ন্যায়াদি ষড়দর্শনসহ বিবিধ শাস্ত্রাধ্যয়নে পারঙ্গম ব্রাহ্মণ বা পণ্ডিতদের দ্বারা বিভূষিত। ভুলুয়া নগরীর অধিবাসীরা সর্বদা দেবতা এবং দ্বিজে ভক্তিমান। নগরীর জনগণ অতিথিসৎকারে সমুৎসুক। নগরের সকল জনগণ সর্বদা জ্ঞানচর্চায় রত থাকায়, নগরীটিকে ‘সরস্বতীর রঙ্গশালা’ নামে অভিহিত করা হয়। এ শাস্ত্র এবং জ্ঞানচর্চার কারণে ভুলুয়া নগরীটি বঙ্গদেশের অলঙ্কারস্বরূপা। এ নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, অর্থাৎ পালনকারিণী দেবী হলেন স্বয়ং দেবী বারাহী।

যস্য হি—
ন্যায়াদিগ্রন্থবীথীবিচরণপটুভিভূষিতা ভূমিদেবৈ-
নিত্যং ভূদেবদেবার্চনরতমনুজা ভারতীরঙ্গশালা ।
বঙ্গালঙ্কারভূতাতিথিমিলনমহাসাদরাশেষলোকা
বারাহী যত্র দেবী স্বয়মবনকরী ভূলুয়া রাজধানী।।
অপিচ—
দানৌঘৈর্বহুভির্মখৈঃ সুকৃতিনামাশংস নীয়াস্থিতি স্বর্লোকাদপি সা সমুজ্জ্বলগুণা বিভ্ৰাজতে ভূলুয়া ।
যস্যাং শূরকুলাম্বুধেঃ সমুদিতাঃ কল্পদ্রুমা জঙ্গমাঃ ক্ষৌণীন্দ্রাঃ বিচরন্তি সন্তি বিবুধাচার্যা দ্বিজেন্দ্রাঃ শতম্ ॥

(কৌতুকরত্নাকর:৫-৬)

‘যাঁর—
রাজধানী ভুলুয়া ন্যায়াদি শাস্ত্রাধ্যয়নে পারঙ্গম ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের দ্বারা ভূষিত, অধিবাসীরা সর্বদা দেবদ্বিজে ভক্তিমান এবং অতিথিসৎকারে সকলেই সমুৎসুক; সরস্বতীর রঙ্গশালা এবং বঙ্গদেশের অলঙ্কারস্বরূপা এই নগরীর পালনকারিণী স্বয়ং দেবী বারাহী ।
আরও—
ভুলুয়া অজস্র দানধর্ম ও যাগযজ্ঞ দ্বারা পুণ্যবানদের প্রশংসনীয় আবাসস্থল, স্বর্গ থেকেও সমুজ্জ্বল গুণরাশি এখানে বিরাজমান; শূরবংশীয় রাজারা জঙ্গম কল্পতরুরূপে এখানে বিচরণ করছেন এবং শত শত বৃহস্পতিতুল্য শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ এখানে বিদ্যমান।’
(ড. দুলাল ভৌমিক অনূদিত)

লক্ষ্মণমাণিক্যের মন্ত্রী বা সভাকবি রঘুনাথ কবিতার্কিকের তাঁর গ্রন্থে যেমন বলেছেন,শাস্ত্র এবং জ্ঞানচর্চার কারণে ভুলুয়া নগরীটি বঙ্গদেশের অলঙ্কারস্বরূপা। এ নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, অর্থাৎ পালনকারিণী দেবী হলেন স্বয়ং দেবী বারাহী। এ একই কথা লক্ষ্মণমাণিক্যের কনিষ্ঠ পুত্র অমরমাণিক্য (মৃত্যু: ১৮ শতকের প্রথম দশক) তাঁর ‘বৈকুন্ঠবিজয়’ নামক নাটকের প্রথম অঙ্কে বলেছেন।

লক্ষ্মীরূপেণ নিত্যং ত্রিজগদঘভয়তো হি চিন্তান্তিকাস্তে বারাহী যত্র দেবী সুরগুরুসদৃশাঃ সন্তি কুন্তেঽপ্যসংখ্যাঃ। বীরাঃ সংগ্রামধীরা অহিতকুলমনঃ সংজ্বরস্থূললক্ষা বঙ্গালঙ্কারভূতা জগতি বিজয়তে ভোলুয়া রাজধানী ॥

তস্যা হি—

আসীদশেষধরণীরমণৈকমানা
মাণিক্যতামধিগতঃ প্রবলপ্রতাপঃ ।
নিঃশেষকৌশলযুতো গুরুকল্পবীরঃ
শ্রীলক্ষ্মণঃ ক্ষিতিপতির্জগদেকবীরঃ॥
(বৈকুন্ঠবিজয়:১.৬-৭)

‘ত্রিজগতের পাপ দূরকারিণী বারাহী দেবী যেখানে লক্ষ্মীরূপে নিত্য বিরাজমান, যেখানে দেবগুরুর ন্যায় অসংখ্য কুন্ত (?) রয়েছেন, যেখানে দুর্জনদের মনের ব্যাধিস্বরূপ যুদ্ধপারদর্শী বীররা রয়েছেন – বঙ্গের অলঙ্কারস্বরূপ সেই রাজধানী ভোলুয়া (ভুলুয়া) জগতে বিজয় লাভ করুক।

সেখানে ছিলেন-

অসংখ্য রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মাণিক্যতুল্য, প্রবল প্রতাপশালী, অশেষ গুণের আধার, দ্রোণাচার্যের ন্যায় অসাধারণ বীর, জগতের একমাত্র বীর লক্ষ্মণমাণিক্য।’
(ড. দুলাল ভৌমিক অনূদিত)

দেবীর অনন্ত মূর্তির মধ্যে অন্যতম হল অষ্টমাতৃকা মূর্তি। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডীর সাথে সাথে বরাহপুরাণেও দেবীর অষ্টমাতৃকার কথা পাওয়া যায়। অন্ধকাসুর নামক এক ভয়ংকর অসুরের বধে অষ্টমাতৃকা আবির্ভূতা হন। অন্ধকাসুর কৈলাস আক্রমণ করলে, ত্রিদেব ও দেবতাদের শরীর থেকে ভগবতী জগদম্বা অষ্টমাতৃকা রূপ প্রকটিত হয়।

তস্য ক্রোধেন মহতা মুখাজ্জ্বালা বিনির্যযৌ ।
তদ্রূপধারিণী দেবী যা তাং যোগেশ্বরীং বিদুঃ ।।
স্বরূপধারিণী চান্যা বিষ্ণুনাপি বিনির্ম্মিতা ।
ব্রহ্মণা কার্ত্তিকেয়েন ইন্দ্রেন চ যমেন চ ।।
বরাহেন চ দেবেন বিষ্ণুনা পরমেষ্ঠিনা ।
পাতালোদ্ধারণং রূপং তস্যা দেব্যা বিনির্ম্মিমে ।
মাহেশ্বরী চ মাহেন্দ্রী ইত্যেতা অষ্ট মাতরঃ ।।
( বরাহপুরাণ: ২৭.৩০-৩২ )

” রুদ্ররূপ শিবের কোপে তাঁর মুখ থেকে এক প্রভা বের হয়ে এক দিব্যরূপধারিণী দেবী আবির্ভূর্তা হলেন। সেই দেবীর নাম ‘যোগেশ্বরী’। এদিকে ভগবান বিষ্ণুর থেকেও তাঁর স্বরূপে এক দেবী প্রকটিতা হলেন, সে দেবীর নাম ‘কামিনী’। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মা, কার্তিকেয়, ইন্দ্র, যম, বরাহরূপী নারায়ণ থেকে এক এক দেবী প্রকটিতা হলেন। তাঁরাই মাহেশ্বরী ও মাহেন্দ্রী আদি অষ্টমাতৃকা।”

জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক সকল ত্রিগুণই আদ্যাশক্তি মহামায়া থেকে আগত। আবার তিনি নিজে ত্রিগুণাতিতা। জীবের দয়া, দান, কল্যাণাদি গুণ যেন আদ্যাশক্তি মহামায়া থেকে আগত, তেমনি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহাদি রিপুও মহাশক্তি থেকে আগত। অসুরদলনী রূপে আবির্ভূতা অষ্টমাতৃকাগণ সত্ত্বগুণধারী ঋষি,মুনি সহ ভক্তের কাছে কল্যাণময়ী বরদাত্রী মাতা। তেমনি পক্ষান্তরে অশুভ তামসিক আসুরিক শক্তির কাছে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য, পৈশুন্য ও অসূয়ার প্রতীক।

কামঃ ক্রোধস্তথা লোভো মদো মাহোঽব পঞ্চমঃ।
মাৎসর্য্যং ষষ্ঠমিত্যাহুঃ পৈশুন্যং সপ্তমং তথা।
অসূয়া চাষ্টমী জ্ঞেয়া ইত্যেতা অষ্ট মাতরঃ ॥
কামং যোগীশ্বরীং বিদ্ধি ক্রোধো মাহেশ্বরীং তথা। লোভস্তু বৈষ্ণবী প্রোক্তা ব্রহ্মাণী মদ এব চ ॥
মোহঃ স্বয়ম্ভুঃ কৌমারী মাৎসর্য্যঞ্চেন্দ্রজাং বিদুঃ।
যমদণ্ডধরা দেবী পৈশুন্যং স্বপ্নমেব চ ॥
অসূরা চ বরাহাখ্যা ইত্যেতাঃ পরিকীর্তিতাঃ।
কামাদিগণ এষোঽয়ং শরীরং পরিকীর্তিতম্।।
(বরাহপুরাণ: ২৭.৩৪-৩৭)

“কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্য, পৈশুন্য ও অসূয়ার প্রতীক এ অষ্টমাতৃকাগণ । এই অষ্টমাতৃকাগণের মধ্যে কাম হলেন যোগীশ্বরী, ক্রোধ হলেন মাহেশ্বরী, লোভ হলেন বৈষ্ণবী, মোহ হলেন কৌমারী, মদমত্ততা হলেন ব্রহ্মাণী, মাৎসর্য্য হলেন ঐন্দ্রী, পৈশুন্য হলেন যমদণ্ডধারিণী এবং অসূয়া হলেন বারাহী । এরাই শরীরধারী অষ্টমাতৃকাগণের এবং এরাই কামাদি অষ্টগণ।”

যজ্ঞ-বরাহমূর্তিধারণকারী বিষ্ণুর শক্তিরূপ বারাহীমূর্তি সম্পর্কে শ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে:

যজ্ঞবারাহমতুলং রূপং যা বিভ্রতো হরেঃ ।
শক্তিঃ সাপ্যাযযৌ তত্র বারাহীং বিভ্রতী তনুম্ ॥
(শ্রীচণ্ডী: ৮.১৯)

‘অনুপম যজ্ঞ-বরাহমূর্তিধারণকারী বিষ্ণুর শক্তি বারাহীমূর্তি ধারণ করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে আসলেন।’

খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মিথিলায় তুঘলক আক্রমণের সময় বিশ্বম্ভর শূর বর্তমান নোয়াখালী অঞ্চলে চলে আসেন এবং ভুলুয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বম্ভর শূরকে বলা হয় আদিশূরের বংশধর। শূরবংশীয় রাজাদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল অন্তহীন। ভুলুয়া অঞ্চলে এই রাজবংশ না থাকলেও এদের রক্তের সম্পর্কীয় বংশধারা অব্যাহত ছিল। বহুকাল অবধি।

প্রবাদ অনুসারে কল্যাণপুর ভুলুয়ার মাণিক্য বংশের আদি রাজধানী। কিন্তু যতদূর জানা যায় বর্তমান নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার আমিশাপাড়া গ্রামেই রাজা বিশ্বম্ভর শূর প্রথম রাজধানী এবং বাসস্থান নির্মাণ করেন। কারণ আমিশাপাড়া ইউনিয়নেই বারাহী দেবীর মন্দির ও কালো পাথরের প্রস্তরময়ী মূর্ত্তি আজও বর্তমান। আমিশাপাড়া ইউনিয়নেই যে মাণিক্য বংশের প্রাচীন রাজধানী ছিলো এর অন্যতম একটি বড় প্রমাণ সেখানে বারাহীনগর গ্রামে শ্রীবারাহী দেবীর মন্দির যেমন আছে, তেমনি বারাহীনগর গ্রামের পার্শ্ববর্তী মানিক্যনগর নামেও একটি গ্রাম রয়েছে। যা মাণিক্য রাজবংশের শাসনকেই নির্দেশ করে।

তথ্য সহায়তা:

১.শ্রীকৈলাশচন্দ্র সিংহ,রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা: জানুয়ারি ২০০৯
২.প্যারীমোহন সেন, নোয়াখালীর ইতিহাস
৩. দুলাল ভৌমিক, রঘুনাথ কবিতার্কিক বিরচিত কৌতুকরত্নাকর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা: ১৯৯৭
৪.কল্পনা ভৌমিক, ভুলুয়ারাজ চন্দ্রমাণিক্যের অপদেশশতক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা: ১৯৯৩
৫. ড. দুলাল কান্তি ভৌমিক ও ড. সঞ্চিতা গূহ, বৈকুন্ঠবিজয় ও সারস্বত-বৃত্তি-পঞ্জিকা ( প্রভাবতী) স্ত্রী -প্রত্যয়-বিবেচন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা:২০২১

লেখক পরিচিতি:

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়