© শ্রী সূর্য শেখর হালদার
শ্রীগণেশ বিঘ্নেশ্বর নামে জনপ্রিয়। তিনি হলেন বিঘ্নের দেবতা। তিনি একদিকে বিঘ্ন স্বরূপ বা বিঘ্নের সৃষ্টিকর্তা, অন্যদিকে তিনি বিঘ্ন মোচনকারী । লিঙ্গ পুরাণে বিঘ্ন সৃষ্টি ও মোচন দুটো কার্যেই তাঁর দক্ষতার কথা বর্ণিত হয়েছে একটি কাহিনীর মাধ্যমে । এই কাহিনী অনুযায়ী বিভিন্ন রাক্ষস ও অসুরগণ তপস্যা ও আহুতির মাধ্যমে দেবাদিদেব মহাদেবের থেকে অনেক বর লাভ করেন। এই বরের দ্বারা অর্জিত ক্ষমতাতে ভর করে তাঁরা দেবতাদের আক্রমণ ও পরাভূত করেন। অসুরদের কাছে বারংবার হার মেনে নেবার পর দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে দেবগণ ভগবান শিবের কাছে নিবেদন জানান। তাঁরা শিবকে অনুরোধ করেন এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যিনি অসুর এবং রাক্ষসদের তপস্যা ও সাধনার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবেন যাতে করে তাঁরা আর বর প্রার্থনার পর্যায়ে পৌঁছতে না পারেন। দেবাদিদেব রাজি হলেন এবং তাঁর শক্তির একাংশ দিয়ে বিঘ্নেশ্বরকে তৈরি করলেন। বিঘ্নেশ্বরের প্রতি দেবাদিদেবের নির্দেশ হলো যে অসুর রাক্ষস এবং অন্যান্য অন্যায়কারী জীবের তপস্যা ও আহুতির কাজে বাধাবিঘ্ন তৈরি করা। বিঘ্নেশ্বরকে শিব এই নির্দেশও দিলেন যে তিনি যেন দেবগণ ও ধার্মিক জীবের পবিত্র কার্য সম্পন্ন করার জন্য সমস্ত বাধা বিঘ্নের নিরসন করেন।
শিব পুরাণ, মৎস্য পুরাণ এবং স্কন্দপুরাণে আবার শ্রীগণেশের সৃষ্টি শুধুমাত্র পার্বতীর থেকেই হয়েছে বলে বর্ণিত হয়েছে। এই বর্ণনা অনুযায়ী তিনি স্নানের সময় তৈল , প্রলেপ এবং শরীর থেকে নির্গত অপবিত্র পদার্থ দিয়ে একটি মানব মূর্তি তৈরি করেন। তারপর পবিত্র গঙ্গা জলের স্পর্শে তিনি সেই মানব মূর্তিকে জীবন দান করেন।
আমরা যদি বিভিন্ন পুরাণ ও আগমাদি পাঠ করি , তাহলে শ্রীগণেশের সৃষ্টির বিভিন্ন কাহিনী আমরা পাব। কোথাও আমরা দেখি তিনি শিব হতে সৃষ্ট : কোথাও শুধু পার্বতী হতে সৃষ্ট :আবার কোথাও তিনি শিব ও পার্বতী উভয়ের দ্বারা সৃষ্ট :আবার কোথাও তিনি স্বয়ম্ভু অর্থাৎ নিজেই সৃষ্ট। সে কারণেই তিনি স্বয়ম্ভু- সূর্য বিনায়ক নামে নেপালি কথায় খ্যাত হয়েছেন।
আমরা জানি যে মহাভারত রচনাকালে শ্রী বেদব্যাস শ্রীগণেশকে তাঁর রচনার লিপিকার রূপে পেয়েছিলেন। শ্রীবেদব্যাস শ্লোক বলতেন, আর শ্রী গণেশ তাঁর গজদন্ত দ্বারা অবিরাম লিখে চলতেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী শ্রী গণেশ হলেন মানব রূপে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। বর্তমান পৃথিবীতে শ্রী গণেশকে দেবতারূপে আহ্বান করা হয়, যখন অন্য দেব-দেবীর পূজা করা হয় :যেকোনো যজ্ঞের আহুতি দানের সময়: কঠিন কোনো কিছু রচনা করবার সময় এবং দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের সময়। বিঘ্নেশ্বর শ্রী গণেশের অন্যান্য কয়েকটি নাম হল- একদন্ত, গণপতি, হেরম্ব, লম্বোদর, গজানন ,শুর্পকর্ণ ও গুহকরাজা ।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শ্রী ওয়াই কৃষ্ণান এর মতে, ” গণেশ বর্তমানে স্বর্গের দেবতাদের স্বামী: প্রাজ্ঞদের মধ্যে প্রাজ্ঞতম: কোষ এবং কোষাগারের স্বামী :সবার প্রিয়: সমস্ত জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং রাজাদের মধ্যে রাজা রূপে বিবেচিত হন। গণেশপুরাণে, ঋগ্বেদের বিভিন্ন পুরুষ সূক্ত ব্যবহৃত হয়েছে শ্রী গণেশ কে আহ্বান করবার জন্য। নবম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত গণেশের স্তুতিতে রচিত গণেশগীতা প্রায় পুরোপুরি ভাগবৎ গীতা থেকে নেওয়া যেখানে শ্রীকৃষ্ণের স্থানে সর্বশক্তিমান এবং করুনাধার রূপে রয়েছেন শ্রী গণেশ। পরবর্তীকালে গণেশ বৈদিক দেব রূপে চিহ্নিত হন। তাঁর মূর্তি এবং চিত্র অঙ্কিত হয়। অঙ্কুশ, বজ্র এবং পদ্মফুল হাতে তিনি হয়ে ওঠেন ইন্দ্রের সমকক্ষ :ব্যাঘ্র চর্ম, অর্ধচন্দ্র আর সাপ তাঁকে রুদ্র বা শিবের সমতুল্য করে তোলে: পাসা তাঁকে দেয় বরুণের সম্মান: আর কুঠার করে তোলে ব্রাহ্মণস্পতির সমতুল্য।” ( রচনাকাল 1981-82)
শ্রী গণেশের টেরাকোটায় তৈরি মূর্তি প্রথম পাওয়া যায় যে স্থানগুলিতে সেগুলি হল পাল (মহারাষ্ট্র), চন্দ্রকেতুগড় (পশ্চিমবঙ্গ), বীরপুরম্ (তামিলনাড়ু) এবং তার (মহারাষ্ট্র)। এই সমস্ত মূর্তিই খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নির্মিত। সবচেয়ে প্রাচীন গণেশ মূর্তি পাথরের তৈরি। এটি তৈরি হয়েছিল কুষাণ যুগে (দ্বিতীয়- তৃতীয় শতাব্দি) এবং এটি পাওয়া যায় মথুরা থেকে।
বিভিন্ন পুস্তক, গবেষণাপত্র এবং মূর্তি দেখে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে দণ্ডায়মান কিংবা বসা- উভয় ভঙ্গিমার সবচেয়ে প্রাচীন মূর্তিতে শ্রীগনেশ এর দুইটি হাত ছিল। আর দুই হাতে ছিল পরশু (কুঠার) আর মুলাকা (গাজর) কলসির ন্যায় পেট আর একটা গজদন্ত । গণেশের এই বৈশিষ্ট্যগুলি আজও বর্তমান। মন্দিরের মূর্তি শিল্পের উপর একটি বই ত্যাগ রাও গণপতির একটি সাধারণ আকৃতি দেখিয়েছেন যেটি বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখালিখি থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই সাধারণ আকৃতিতে দেখা যাচ্ছে যে তিনি হলেন চতুর্ভুজ, যদিও বৃহৎসংহিতার শ্লোকে তাঁকে দুই হাত সম্পন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই শ্লোক অনুযায়ী তাঁর দুই হাতে রয়েছে কুঠার বা পরশু আর গাজর। তাঁর পেট কলসির ন্যায় আর দন্ত একটি:
“প্রমথাধীপ গজমুখ
প্রলম্বজতর কুঠারধারী স্যাৎ।
একারিসন বিভ্রান
মূলকাকন্দন…”
আকর্ষণীয় ব্যাপার হল এইযে আজকের দিনে শ্রীগণপতি আর মিষ্টির হাঁড়ি সমার্থক হয়ে উঠেছে, কিন্তু বৃহৎ সংহিতা, যাতে এই দেবতার প্রথম উল্লেখ করা হয় সেখানে কিন্তু মিষ্টির হাঁড়ির কোন উল্লেখ নেই। যাই হোক খ্রিস্টীয় এক শতাব্দীতে নির্মিত যে গণেশ মূর্তি আমরা মহারাষ্ট্রের পালে পাই (পাল টেরাকোটা গণেশ ) সেখানে আমরা মিষ্টির হাঁড়ি দেখতে পাই। পরবর্তীকালে
সুপ্রভেদগাম, বিষ্ণুধর্মত্তরা, রুপমন্দনা ইত্যাদি গ্রন্থে আমরা গণেশের চারটি হাতের (যেটা সময় সময় ৬,৮,১০ এমনকি ১৬ টা পর্যন্ত হয়েছে) উল্লেখ রয়েছে। তাঁর যেসব বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলি হল তাঁর দন্ত (স্বদন্ত), মোদক (মিষ্টি), অঙ্কুশ (হাতি শাসনের দণ্ড) পাসা, নাগ , বজ্র ,জপমালা ,পদ্ম ফুল, শ্রীফল ইত্যাদি । পরবর্তী কালের এইসব গ্রন্থগুলিতে আমরা শ্রীগণেশের বাহনরূপে ইঁদুরকে দেখতে পাই । তাঁর সঙ্গিনীর রূপে বিঘ্নেশ্বরী – বুদ্ধি, শ্রী ,ভারতী ( সারদা) ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি কে দেখতে পাই।
পরবর্তীকালের এই গ্রন্থ গুলিতে আমরা আজকের গণেশ মূর্তির বৈশিষ্ট্যগুলি দেখতে পাই, যেমন ত্রিনয়ন, অভঙ্গ বা সমভঙ্গ ভঙ্গিমা,ব্যাঘ্র চর্মের তৈরি পোশাক,
উপবীতের ন্যায় দেহে জড়ানো সর্প। এই গ্রন্থ গুলি গণেশ মূর্তির আরো কতকগুলি রূপের বর্ণনা দেয়, যেমন বালক গণপতি, বীজ গণপতি, মহাগণেশ, শক্তি গণেশ, তরুণ গণপতি, নৃত্য গণপতি, হরিদ্রা গণেশ, হেরম্ব গণেশ ইত্যাদি । একসময় ভারতে গণপতি ভক্তেরা ছয়টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। গণপতি ভক্তগন ছটি রূপে গণপতি পূজা করতেন – মহা, হরিদ্রা, স্বর্ণ, সনাতন, নবনীত এবং উন্মত্ত উচ্ছিষ্ট।
শ্রী গণেশ সাফল্য এবং সৌভাগ্য প্রদানকারী রূপে হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈনদের দ্বারা পূজিত হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও শ্রী গণেশ কে দেখতে পাওয়া যায়। জাভা, ফিলিপাইন,বালি, কম্বোডিয়া, বোর্নিও, বার্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, চীন এমনকি জাপানেও মধ্যযুগের গণেশ মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূর্তি গুলি ভারতের সঙ্গে প্রাচীন ও মধ্যযুগে এইসব দেশগুলির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগের নমুনা প্রদর্শন করে। এই যোগাযোগ মুছে দেবার বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই সংযোগের অস্তিত্ব এখন রয়ে গেছে।