বেনারস: শত শত বছরের ইসলামিক আগ্রাসন সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা এক পূণ্য নগরী



Updated: 15 July, 2023 8:02 am IST

© শ্রী সৌভিক রাতুল বসু

বিশ্বাস করুন আজও সিংহভাগ মানুষকে দেখে মনে হয় সত্যিই আমরা অমৃতের সন্তান। সৃষ্টির রহস্য কে গোটা পশ্চিমী দুনিয়া যখন ‘আকর পাপ’ বা ‘অরিজিনাল সিন’ এর লজ্জায় কম্বলের তলায় লুকিয়ে রেখেছে, আমরা তার বহু আগেই তাকে চূড়ান্ত আনন্দের স্বাদ বলে দৃপ্ত ঘোষণা করেছি ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা’। আমাদের পাপের বোধ, বিনাশের বোধ এমনকি যৌনতার বোধও আমরা এই আনন্দের নিরিখে মেপে থাকি বলেই আজও আমাদের দেশে বিবাহের একটা আলাদা স্থান রয়েছে। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে তাই ভারতে পরকীয়ার স্থান সবচেয়ে নীচে। দর্শনের উৎপত্তি আগে, আর সেই দর্শনের সাহায্যে সমদর্শী মানুষকে এককাট্টা করার জন্য যে সমাজ বিপ্লব বা আত্মিক বিপ্লব তাই হল ধর্ম। আর হিন্দুধর্মের তথা হিন্দু দর্শনের সারকথা হল ঐ আনন্দের অন্বেষণ। আর আনন্দ — যা মোক্ষ বললে মোক্ষ , মুক্তি বললে মুক্তি — খোঁজা উৎকেন্দ্রিকদের চিরকাল লালন করেছে বলেই কাশীও চিরটাকাল কাশী।

হিন্দু দর্শনের মূল জিনিস হল যাপন। হিন্দু দর্শনে কপটাতার কোন স্থান নেই। আমি যে ভাবধারা বা school of thoughts বিশ্বাস করি বা গলাবাজি করি, ঠিক সেই অনুযায়ী নিজের জীবনযাত্রা বা মানসিক স্থিতি যদি পরিচালিত না করতে পারি, তাহলে অন্তত নিজেকে সেই ভাবধারার মানুষ বলতেই পারা যাবে না।

চিরকালীন লালনের ক্ষমতা মানুষের নেই, ঈশ্বরের রয়েছে, তবু মানুষের মায়ার, মানুষের দীনতার, মানুষের অসহায়তার ভেতর থেকে গড়ে ওঠা জীবনবোধের এই ক্ষমতা মানুষের একান্ত নিজস্বই। জন্ম থেকে চল্লিশের কোঠায় পৌঁছনো অবধি মনে মনে একটা সযত্নে লালিত বিশ্বাস ছিল, ‘মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ অবশ্য পরবর্তীকালে জীবনবোধ আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল যে, ‘মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস করাটা বোকামি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবিতে বিশ্বনাথের আরতি দৃশ্য কেবলমাত্র দৃশ্য ও শব্দের একটা সাধারন মেলবন্ধনই মনে হত, অনন্যসাধারণ উচ্চতায় উঠত না, যদি না ক্লোজআপে সর্বজয়ার অসহায় দৃষ্টির আকুতিটুকু ধরা পড়ত। এই ভাবেই জীবন ঘটে চলে বয়ে চলে। আর এই ঘটে চলা বয়ে চলা এমনই নিরন্তর যে মহাকালের ফ্রেমে মনে হয় সময়টা বুঝি থেমে আছে। মানুষকে ও মানুষের আবেগকে ধারণ করে মানুষের মতোই বেড়ে উঠেছে বলে বেনারস চিরকালের। তাই এখনও বাবা বিশ্বনাথের আরতিতে কাঁসর ধুনোর মধ্যেও চোখে পড়ে কোন মহিলার মুখের আঁচড়, ছাতার তলায় চশমা চোখে মধ্যবয়সী পুরুষ দেখলে মনে হতেই পারে হরিহর। গলির চটা ওঠা দেওয়ালের আড়াল থেকে যেকোনো মুহূর্তে উঁকি দিতেই পারে অপুর কাজল চোখ। শহরটা যে বেনারস! এখানে জীবনের ক্ষয় নেই।

প্রাচীনতার মাপকাঠিটা ঠিক বয়স দিয়ে হয় না , হয় মেজাজ দিয়ে। আধুনিক বেনারস বা গঙ্গায় নৌকাবিহার করতে করতে যে বেনারস আমরা দেখি তা মূলত মারাঠা আর কিছুটা হলেও রাজপুতদের তৈরি বেনারস। মুসলিম অত্যাচারের কারণে সমগ্র উত্তর ভারতে ৩০০- ৪০০ বছরের বেশি পুরনো মন্দির তো পাবেন না। হিন্দু মন্দির এবং স্থাপত্য পুনর্নির্মাণ করার জন্য মহাপ্রানা অহল্যা বাই হোলকারের কাছে আমরা চিরঋণী থাকব। বেনারস বেঁচে আছে তার গলিতে, আরও ভালো করে বললে গলির সঙ্কীর্ণতায়। যে কোন পুরনো শহরের রক্ষাকবচ ছিল গলির সংকীর্ণতা। যেখানে বহিঃশত্রু ঘোড়ায় চেপে একজনের পেছনে আরেকজন আসতে বাধ্য হবে, ফলে আগ্রাসনের প্রাবল্য কমবে, আক্রমণ ঠেকানো যাবে সহজে। তবে বেনারসে প্রাচীনতা লুকিয়ে রয়েছে বেনারসের বাজারে — হিন্দু দর্শনের, হিন্দু ধর্মের।

বেনারসের বাজার তার সাবেক কালের চাহিদা এবং যোগানের সমীকরণটা দিব্যি ধরে রেখেছে। সে বেনারসি পানই হোক, ঠান্ডাই হোক, রাবড়ি কিংবা আতর — চাহিদাটি আদিকাল থেকে আজকের, যোগানটাও তাই। আদ্দিকালের চাহিদাটা সমকালে চাগিয়ে দেওয়ার জন্যই বেনারস তার সাবেক রূপটা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। এই শহরের নানাবিধ অনৈসর্গিক পাপ, নেশার আভাস, বাঈ নাচের ইঙ্গিত, সূর্য ঘড়িতে সময় হিসেব দেখতে জানা অতি বৃদ্ধ আসলে সবই একটা টাইম ক্যাপসুল। সর্বত্র নির্বিচার আধুনিকীকরণ থেকে একটুক্ষণ ব্যোমমার্গে ভেসে আসা ভালই তো।

নদীর স্রোতের মতো না হলেও জীবন দৌডোয় বেশ দ্রুতগতিতে। পন্ডিতরা বলেন — India bears all marks of history’s continuity । প্রশ্ন নয় এই দাগগুলো কতটা দূরের ? নয় কতখানি সময়ের ? বেনারসের সাড়ে তিন হাজার বছরের একটা ঘনীভূত স্পেস আছে । এখানে ভাষার উৎপত্তি থেকে স্যাটেলাইট ইমেজারি — সবই সমসাময়িক। এখানে রাস্তায় অত্যাধুনিক গাড়ির মাথায় বাঁধা লাল চেলিতে মোডা মৃতদেহ তেমন বেমানান কিছু নয়। এখানে সমান গুরুত্ব নিয়ে এখনও বেদ পাঠ হয়, খোলা আকাশের নিচে মড়া পোড়ে, কোপানো মাটির ওপর মল্লযুদ্ধ চলে আবার একই সঙ্গে নৌকোয় নৌকোয় অত্যাধুনিক বিদেশি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে। বেনারস আসলে বিরিঞ্চিবাবার দুই বাহুর বিপরীতমুখী আবর্তন। একটি অতীত , অন্যটি ভবিষ্যৎ। এখানে তো বর্তমান নেই।

বেনারসে তো মৃত্যু নেই। আছে শুধু মুক্তি অথবা মোক্ষ। আর মৃত্যু নেই বলেই আজও সে বেঁচে রয়েছে শত মুসলিম আক্রমণ সত্তেও। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে নবম শতাব্দীর প্রথম ধাপ অবধি রাজনৈতিকভাবে বেনারসের দখল পেন্ডুলামের মত ঘোরাফেরা করেছে বাংলার পাল বংশ, দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট এবং গুজরাট -রাজস্থানের গুর্জর প্রতিহারদের মধ্যে। দশম শতাব্দীর পর প্রতিহারদের হাত থেকে বেনারস চলে যায় চেদিদের অধিকারে। তখন অবধি বেনারসের চিরকালীন স্বর্ণযুগ। বেনারস প্রথম মুসলিম আক্রমণের শিকার হয় সুলতান মাহমুদের আক্রমণকালে নিয়ালতাগিনের হাতে । নির্বিচারে লুটপাট এবং ধ্বংসের সেই শুরু। একাদশ শতাব্দীতে কিছুদিনের জন্য গহদাবল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বেনারস চলে যায় মুসলিমদের হাতে। মুসলিমদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পীঠস্থান কে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া । ধর্মীয় উৎপীড়ন ,জোর করে ধর্মান্তরীকরন থেকে উপাসনালয় ধ্বংস ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা । মুসলিম আক্রমণের কারণে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ৩০০-৪০০ বছরের বেশি পুরনো মন্দির তো আর নেই । সবগুলিই ধ্বংস করা হয়েছিল। সুলতান মাহমুদ বেনারস ধ্বংস করেন ১০৩৫ খ্রীস্টাব্দে, কুতুবুদ্দিন আইবক ১১৯৪ খ্রীস্টাব্দে, ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩০০ খ্রীস্টাব্দে। এছাড়াও ধ্বংস করেছিলেন সিকান্দার লোদী , শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেব। বিশেষত ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে বিশ্বনাথ মন্দির, বিন্দুমাধব মন্দির এবং কৃত্তিবাস মন্দির পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বেনারসের ইতিহাসের এই দীর্ঘ কালো সময় হিন্দু ধর্মের আলোকবর্তিকা অনির্বাণ রেখেছিলেন শহরের অধিবাসীগণ এবং রাজপুত প্রধানরা।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে উত্তর এবং মধ্য ভারতের দখল চলে যায় মারাঠাদের হাতে। ১৭০০ সালে মারাঠাদের সর্বাধিনায়িকা তারাবাঈ ঘোষণা করেছিলেন যে মারাঠারা বেনারসের হৃত গৌরব ও সম্মান পুনরুদ্ধার করবে। এর ১০০ বছরের মধ্যেই মারাঠা রানী মহাপ্রাণা অহল্যা বাই হোলকার এবং বীর মহাদজি সিন্ধিয়ার হাত ধরে শুধু বেনারস নয় সমগ্র উত্তর এবং মধ্য ভারতের বহু মন্দির এবং তীর্থ সংস্কারের মাধ্যম দিয়ে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে।

তবে প্রবলভাবে পরকাল রয়েছে বেনারসে। যেমন মুক্তি ভবন। এখানে প্রতিটি ঘরেই এমন একজন আছেন যিনি কাশীতে মরতে চান। মৃত্যু আসন্ন হলে তাঁর ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে প্রিয়জনরা তাকে নিয়ে আসেন কাশীতে । স্বল্পবিত্ত এসব পরিবারের জন্যই মুক্তি ভবন। ১৫ দিন বিনা পয়সায় থাকা যাবে । রান্না করে খাওয়া যাবে প্রতিদিন। ভবনের নিজস্ব কীর্তনীয়ারা দিনে চারবার করে ঘরে ঘরে গিয়ে হরিনাম শুনিয়ে আসবেন। ১৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু হলে ভবনের নিজস্ব পুরোহিত বিনা পারিশ্রমিকে শেষ কাজটুকু করে দেবেন । আর বাকিটুকুর জন্য তো রয়েইছে লেলিহান অগ্নিশিখা।